চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ইসলাম

মাহমুদ আহমদ

৩০ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:০৭ পূর্বাহ্ণ

আমরা জানি সকল নবী-রসুলগণই একেশ্বরবাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তারা সমাজে ধর্মহারা মানুষের মাঝে প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা দিয়ে স্রষ্টার আনুগত্য এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশে প্রার্থনা করার দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। মানুষের মধ্যে সাম্য, একতা, মানবতা এবং সহমর্মিতা প্রকাশের মাধ্যমে সহাবস্থানে বসবাসের শিক্ষা দেন। এক ধর্মাবলম্বী অন্য ধর্মাবলম্বীকে সম্মান করার আদেশ বিদ্যমান। বল প্রয়োগে ধর্মান্তরিত করার শিক্ষা কোন ধর্মীয় বিধানে নেই। কোন ধর্মই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা জঙ্গিবাদের শিক্ষা দেয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে। ধর্মপালন কিংবা বর্জন ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার। আল্লাহতায়ালা বলেন- তুমি বল, তোমার প্রতিপালক প্রভুর পক্ষ থেকে পূর্ণ সত্য প্রেরিত, অতএব যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক (সুরা কাহাফ: ৩০)।

অথচ আজ সারাবিশ্বে চলছে ধর্মের নামে অধর্মের কাজ। মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারী, হানাহানি এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ। এক ধর্মাবলম্বী অপর ধর্মাবলম্বীকে হত্যার প্রয়াস। এক জাতিগোষ্ঠী অপর জাতির ওপর আক্রমণ। সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার। এমনকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্ম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে সৃষ্টি হয়েছে আইএস, আল-কায়েদা, তালেবান, জামাতে মুজাহিদিন, হরকাতুল জেহাদ, লস্করে তৈয়েবা প্রভৃতি জঙ্গি সংগঠন।
গত কয়েক বছর ধরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত দেশ মিয়ানমারে জাতিগত এবং ধর্মীয় উন্মদনায় চলছে রোহিঙ্গা নিধন ও গণহত্যা। প্রাণ ভয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা জন্মভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং সেবা করছে। মানবতাবিরোধী এই কার্যকলাপ বিশ্ববিবেককে নাড়া দিচ্ছে। অনেক দেশ এর প্রতিবাদে নিন্দা জানিয়েছে। অথচ বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বৌদ্ধের শিক্ষা- ‘অহিংসা পরম ধর্ম। জীব হত্যা মহা পাপ’। ফলে আজ সেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাদের অবতারের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত। তাদের কার্যকলাপে সেই বাণী কলংকিত হচ্ছে। বৌদ্ধং স্মরণং গচ্ছামী তাদের অঙ্গীকার বিফলে যাচ্ছে।

মহানবী (সা.) মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে ইসলাম প্রচার করেছেন। অথচ বিরোধী মক্কাবাসীরা তার (সা.) এবং তার (সা.) অনুসারীদের ওপর নির্মম অত্যাচার করে। এর প্রতিবাদে তিনি (সা.) যুদ্ধে জড়িত হন নি। অত্যাচারের সীমা যখন ছাড়িয়ে যায় তখন তিনি (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যান। তারপরও মক্কার সেই বিরোধীরা মদিনায় গিয়ে আক্রমণ করে। তখন তিনি (সা.) আল্লাহতায়ালার নিকট থেকে নির্দেশিত হন- ‘যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে তাদেরকে (আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করার) অনুমতি দেয়া হল। কারণ তাদের ওপর যুলুম করা হচ্ছে’ (সুরা হাজ : ৪০)। ফলে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করা হয়। নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেন। তবে বিপক্ষে যুদ্ধে জড়িত নয় কিংবা বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয় নি। এমনকি মক্কা বিজয়ের পর সকলকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। হিন্দু ধর্মেও আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের বিধান প্রযোজ্য। যথা- সর্বথা যতমানা নাম যুদ্ধমভিকাঙ্খতাম। সাত্বে প্রতিহতে যুদ্ধং প্রসিদ্ধংনা পরাক্রামঃ। অর্থাৎ যুদ্ধের আকাক্সক্ষা না করে শান্তির জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালিয়েও যারা ব্যর্থ হয় তাদের জন্য যুদ্ধ করা অবশ্য কর্তব্য (মহাভারত, ৫/৭২/৮৯)।

পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.) সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে নিজ নিজ রীতি অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম পালনের শিক্ষা দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন- জেনে রাখ, যে ব্যক্তি কোন অঙ্গীকারাবদ্ধ অমুসলমানের ওপর যুলুম করবে, তার অধিকার খর্ব করবে, তার ওপর সাধ্যাতীত কোন কিছু চাপিয়ে দিবে বা তার অনুমতি ব্যতীত তার কোন বস্তু নিয়ে নিবে আমি পরকালে বিচার দিবসে তার বিপক্ষে অবস্থান করবো (আবু দাউদ)।

অমুসলমানদের উপাসনালয়ে হামলা ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। শুধু তা-ই নয় অমুসলমানরা যেগুলোর উপাসনা করে সেগুলিকেও গালমন্দ করতেও বারণ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন- তোমরা তাদেরকে গালি দিও না, যাদেরকে তারা আল্লাহকে ছেড়ে উপাস্য রূপে ডাকে, নতুবা তারা অজ্ঞতার কারণে শত্রুতাবশত: আল্লাহকে গালি দিবে (সুরা আনআম: ১০৯)। ফলে ইসলাম সকল ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এক সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টির ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে। কাজেই ধর্মীয় উন্মদনায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা বা অন্য কোন স্থাপনা ভাঙ্গা ও জ্বালিয়ে দেয়া এবং নিরীহ মানুষকে হত্যা করা কোন ধর্মীয় কাজ নয়।

বল প্রয়োগে কোন ধর্ম মত চাপিয়ে দেয়া কোন ধর্মই স্বীকৃতি দেয় না। অনেক ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী জেহাদের ঘোষণা করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু ইসলামে জেহাদের বড় তাৎপর্য হল নিজের আত্মশুদ্ধিকল্পে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। নিজের মাঝে মনুষ্যত্বের গুণাবলীর উৎকর্ষতা বিকশিত করা। আদর্শ ও ভালোবাসা সৃষ্টি এবং যুক্তির মাধ্যমে অপরকে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা করা। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শিক্ষা নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন- তুমি মন্দকে সর্বোৎকৃষ্ট আচরণ দ্বারা প্রতিহত কর। তাহলে দেখবে যার সাথে আজ তোমার শত্রুতা রয়েছে সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। (সুরা হামীম আস সাজদা : ৩৫)

অনেক উগ্রবাদী জঙ্গি হত্যাযজ্ঞ চালানোর উদ্দেশ্যে নিজে আত্মাহুতি বা আত্মত্যাগ করে। তাদের ধারণা এতে পরকালে স্বর্গ লাভ হবে। কিন্তু এটা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী। ইসলামে আত্মত্যাগ বা আত্মহত্যা নিষেধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, আর তোমরা আত্মহত্যা করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু (সূরা নিসা: ৩০)। কাজেই নিষিদ্ধ কাজ করা পাপ। ফলে আত্মঘাতী বোমারুদের জন্য পরকালে স্বর্গ নয় নরকই নির্ধারিত। আমাদের এই শান্তিময় দেশেও বিভিন্ন সময় ধর্মকে কেন্দ্র করে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে যা ধর্মীয় শিক্ষার বিপরীত। কেননা মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে সকলকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘হে মানবমন্ডলী! সাবধান, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। কেননা তোমাদের পূর্বের জাতিগুলি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে’ (ইবনে মাজা কিতাবুল মানাসিক)।
আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকে মুসলমান, হিন্দু, খৃস্টান এবং বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানে বসবাস করে আসছে। তাই এদেশে যারা ধর্মকে পুঁজি করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা প্রতিহত করতে হবে।

মাহমুদ আহমদ গবেষক ও কলাম লেখক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট