চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জলবায়ু ও রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিশ্বসম্প্রদায়কে দায়িত্ববান হতে হবে

২৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে আপনভূমি রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের যে আহবান জানিয়েছেন তা খুবই তাৎপর্যবহ। ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে ‘বান্দুং নীতিমালা’ সমুন্নত রাখা বিষয়ক এক সাধারণ আলোচনায় বক্তব্যকালে তিনি যথার্থই বলেছেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে তাদের নিজভূমে স্বেচ্ছায় ফিরে নেয়াই সংকটের একমাত্র সমাধান। রোহিঙ্গা সংকট একটি রাজনৈতিক সংকট এবং এর মূল গভীরভাবে মিয়ানমারে প্রোথিত। কিন্তু মিয়ানমার সরকার নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে বিষয়টিকে দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের উপর। এতে পুরো দক্ষিণ এশিয়াও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এক সময় সারাবিশ^কেই এর মূল্য দিতে হবে, যদি এখনই যুক্তিসংগত উপায়ে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মনোযোগ না দেয়া হয়।

বাকুর কংগ্রেস সেন্টারে আয়োজিত ন্যাম সম্মেলনের ‘সমসাময়িক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমন্বিত ও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে বানদুং নীতিমালা অনুসরণ’ শীর্ষক প্লেনারি সেশনে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী মানবিক কারণে এখন ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে পিছিয়ে দিতে পারে বলে যে শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তা যথার্থ। ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব দেখা দিয়েছে। পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। উজাড় হচ্ছে পাহাড়, বনভূমি। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের প্রধান টার্গেটও এখন রোহিঙ্গারা। এ অবস্থায় তারা স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়ার জন্যে হুমকিতে পরিণত হয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ‘টাইম বোমা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদি দ্রুত সময়ে যুক্তিপূর্ণ পদক্ষেপে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, সারাবিশে^ই এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে বিশ^সম্প্রদায়ের নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৪তম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণেও সমস্যার যুক্তিসংগত সমাধানে ব্যর্থতার ভয়াবহ পরিণাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চার দফা প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। চার দফা প্রস্তাবের মধ্যে আছে- ১. রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন এবং আত্মীকরণ। ২. বৈষম্যমূলক আইন ও রীতি বিলোপ করে রোহিঙ্গাদের আস্থা তৈরি। ৩. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান। ৪. রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণসমূহ বিবেচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য নৃশংসতার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। তখনও তিনি রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এবারও ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকটের যুক্তিপূর্ণ সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ^সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ এবং বিশ^নেতাদের উচিত হবে একটি নিরাপদ বিশে^র স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং আহবানকে আমলে নিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ সমাধানে এগিয়ে আসা।

উল্লেখ্য, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস থেকে ব্যাপক হারে এ দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ ঘটে। এর পর থেকেই বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে আন্তর্জাতিক পরিম-লে সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়ে আসছে। জাতিসংঘের পাশাপাশি বিশে^র শক্তিমান দেশগুলোর প্রতিও রোহিঙ্গা সমস্যার যুক্তিপূর্ণ সমাধানে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে। কিন্তু কারো কাছ থেকে জোরালো ভূমিকা দৃশ্যমান হয়নি। ফলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি মিয়ানমারের শর্ত মেনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেশটির সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হলেও মিয়ানমার সেই চুক্তি রক্ষা করেনি। এতে রোহিঙ্গা সংকট আরো ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সংকট সমাধানে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য আমলে নিয়ে রোহিঙ্গাদের সমনাগরিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোর দ্রুত সুনিষ্পত্তি করা। একইসঙ্গে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ ছাড়াই সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা। আমাদের বিশ^াস, জাতিসংঘসহ পুরোবিশ্ব মানবিকবোধে উজ্জীবিত হয়ে নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই পুনর্বাসনে সোচ্চারকণ্ঠ হবে।

বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য যদিও বাংলাদেশ দায়ী নয়, কিন্তু এর বিপর্যয়কর প্রভাব মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে এদেশকে। বিষয়টি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বসম্প্রদায়ের, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই এ বিষয়ক জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক পুরোপুরি মেনে চলার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, আর্থ-সামাজিকক্ষেত্রে আমাদের অনেক সাফল্য আছে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা এবং রোহিঙ্গা সংকটে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাংলাদেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ও জলবায়ু সমস্যা বিষফোঁড়া হিসেবে চেপে বসেছে এখন। অথচ এ দুই সংকট তৈরির পেছনে আমাদের হাত নেই। সংগতকারণে এই দুই সংকটের চাপ ও ক্ষতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দিতে বিশ^সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল তৎপরতা প্রত্যাশিত। এই দুই ইস্যুতে আমরা জাতিসংঘ ও বিশ^নেতাদের কার্যকর ভূমিকা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট