চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অর্থনীতিতে নোবেল এবং পুওর ইকোনমি

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য

২৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

২০১২ সাল। সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে আমি কর্মরত। বিগত বছরটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের নবীন বরণ হয়নি বলে ছাত্রনেতারা হঠাৎ দাবী করে বসল ‘নবীন বরণ’ অনুষ্ঠান করার জন্য। তখন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন প্রফেসর আবদুল গোফরান। তিনি বয়সে আমার তিন বছরের বড়। আমাকে খুবই দেখতে পারতেন।

আমার নাম ধরে তিনি কখনো ডাকতেন না। সম্বোধন করতেন ‘প্রফেসর সাহেব’ বলে। তিনি ছাত্রনেতাদের দাবীর মুখে বলে দিলেন যে, তোমরা একটি বাজেট পেশ করো, আমি একটি কমিটি গঠন করে দিই। কমিটির প্রধান করা হলো আমাকে। তখনকার সময়ে ছাত্রনেতারা নবীন বরণের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট নিয়ে মহাসমারোহে নবীন বরণ করার জন্য বিজ্ঞান ভবন-১ এর সামনে বিশাল স্টেজ নির্মাণ করলো।

মহা ধুমধামের ভেতর দিয়ে যথাসময়ে নবীন বরণ শুরু হলো। যেহেতু আমি কমিটির প্রধান সেহেতু আমাকেই সভাপতির আসনে বসিয়ে বক্তব্য শুরু হলো। বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানেরা বক্তব্য দিতে এসে নিজ নিজ বিভাগের এবং বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা করে এটা প্রমাণ করতে চেষ্টা করলো যে, বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে উনি যে বিষয়ের অধ্যাপক সেই বিষয়টি সেরা। যেমন- ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের এক অধ্যাপক (সহকারী অধ্যাপক) তো বলেই ফেললেন, জীবনে হিসাব, জন্মে হিসাব আর জন্মান্তে হিসাব। হিসাব ছাড়া আর কিছুই নেই। সুতরাং হিসাব বিজ্ঞান বিষয় হচ্ছে সেরা বিষয়। অবশ্য সম্মানিত অধ্যক্ষ আবদুল গোফরান সাহেবও ছিলেন হিসাব বিজ্ঞানের। অপর এক অধ্যাপক বলেই দিলেন, হিসাব হলেই চলবে না। সমগ্র হিসাবের ব্যবস্থাপনা সুন্দর হতে হবে। অবশ্য উক্ত অধ্যাপক ছিলেন ব্যবস্থাপনা বিভাগের। সবার শেষে আসলো আমার পালা। বললাম- অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষক হলাম আমি। ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের মধ্যে সাহিত্য ছাড়া একমাত্র নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় অর্থনীতিতে। সুতরাং আধুনিক বিশে^ অর্থনীতি বিষয়ের গুরুত্ব কেমন তা সহজে বুঝা যায়।

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা আলফ্রেড নোবেল তাঁর উইলে বলে যাননি। সমসাময়িক বিশে^ বাস্তব অবস্থাকে উপলব্ধি করে ১৯৬৯ সাল থেকে এ বিষয়ে একটি পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। মূলত নোবেলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ‘দ্যা ব্যাংক অব সুইডেন’- পুরস্কারটি প্রবর্তন করে। যেহেতু এই পুরস্কারও নোবেলের অন্যান্য পুরস্কারকে অনুসরণ করে সেহেতু একই সময়ে ঘোষণাও প্রদান করা হয়। তাছাড়া পুরস্কারের প্রাইজমানিও অন্যান্য নোবেল পুরস্কারের মতো একই অঙ্কের।

২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া তিন জনের নাম ঘোষণা করেছে সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স। তাঁদের একজন হলেন, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি অভিজিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়, তাঁর স্ত্রী এস্তার ডুফলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের মাইকেল ক্রেমার। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর পর চতুর্থ বাঙালি হিসেবে এবার নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অভিজিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়। এর আগে প্রথম বাঙালি হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পরস্কার লাভ করেন অমর্ত্য সেন। নোবেল কমিটি জানিয়েছে দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে গবেষণার জন্যই তাদের তিনজনকে পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তাঁদের গবেষণা গোটা বিশ^কে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার নতুন হাতিয়ারের সন্ধান দিয়েছে। মাত্র দুই দশকে তাঁদের গবেষণা পদ্ধতির উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখাকে বদলে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম পাথেয় মডেল।

১৯৬১ সালে মুম্বাইয়ে জন্ম অভিজিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের। তিনি প্রাথমিকে পড়াশোনা করেন সাউথপয়েন্ট স্কুলে। ১৯৮১ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ^বিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সেই বছরই ¯œাতকোত্তর পড়তে চলে যান জহরলাল নেহেরু বিশ^বিদ্যালয়ে। এরপর হার্ভাড বিশ^বিদ্যালয়ে ‘ইনফরমেশন ইকোনমিক্স’ এর ওপর পি-এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক অধ্যাপক হিসেবে এমআইটিতে কর্মরত আছেন। তাঁর বাবা দীপক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক।

আর মা নির্মলা বন্দোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতার ‘সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্স’-এ অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। অধ্যাপক অভিজিত বন্দোপাধ্যায় বিশে^র দরিদ্র মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন নিয়ে গবেষণার জন্য স্ত্রী এন্থার ডাফলোকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘আব্দুল লতিফ জামিল প্রোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব’- নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষামূলক যে গবেষণা করেছেন মূলত সেটাকে মূল্যায়ন করে এবার তাঁদেরকে অর্থনীতিতে নোবেল দেয়া হয়। এর আগে নোবেল বিজয়ী অভিজিত বন্দোপাধ্যায় জাতিসংঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর লেখা চারটি বই বিশ^জুড়ে সমাদৃত হয়। তার মধ্যে ‘পুওর ইকোনমি’- বইটি ‘গোল্ডম্যান সাচস বিজনেস বুক’- সম্মানে ভূষিত হয়। তাঁর স্ত্রী এন্থারের জন্ম ১৯৭২ সালে প্যারিসে। এক সময় তিনি অভিজিতের ছাত্রী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে এন্থার তখন পি-এইচ.ডি করছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) তে। অভিজিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর সুপারভাইজার। ১৯৯৭ সালে এন্থার ভারতেও এসেছিলেন অভিজিত বন্দোপাধ্যায়ের সাথে। এর বছর কয়েক পরে তাঁরা এক সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। ২০১২ সালে এ দম্পতির এক সন্তান আসে। ২০১৫ সালে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন। এর আগে আরেক বাঙালি অর্থনীতিবিদকে বিয়ে করেছিলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিত। কলকাতার মেয়ে অরুন্ধুতী তুলি বন্দোপাধ্যায় তাঁর প্রথম স্ত্রী। তিনিও একসময়ে এমআইটি-এর অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপিকা ছিলেন।

২০১৯ সালে ‘সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স’- তিন অর্থনীতিবিদকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। ‘বৈশি^ক দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ পরীক্ষা ভিত্তিক পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য এই তিন অর্থনীতিবিদকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। তাঁদের গবেষণা বিশ^ব্যাপী দারিদ্র্যের বিরোদ্ধে লড়াই এ অর্থনৈতিক দক্ষতাকে উন্নত করেছে। মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে তাঁদের পরীক্ষামূলক পদ্ধতিগত উন্নয়ন এখন বিশ^ব্যাপী গবেষণার সমৃদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে। বিশ^ব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সর্বোত্তম উপায় কী হতে পারে সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য উত্তর পাওয়ার জন্য একটি নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন এ বছরের বিজয়ীত্রয়ীরা। তাঁরা দেখিয়েছে উদ্ভাবিত ডিজাইন অনুসরণ করে, ছোট ছোট পরিসরে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা ব্যক্তিদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রশ্নগুলোর সবচেয়ে ভাল উত্তর পাওয়া যায়।

অভিজিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় ও এন্থার ডুফলো তাঁদের ইস্যুভিত্তিক গবেষণাগুলো বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ করতেন। তাদের পরীক্ষামূলক গবেষণা পদ্ধতিগুলো আধুনিক বিশে^র উন্নয়ন অর্থনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। তাঁদের পদ্ধতি অনুসরণ করে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। তাঁদের গবেষণার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে ৫০ লাখেরও বেশি ভারতীয় শিশু স্কুলে প্রতিকারমূলক প্রশিক্ষণের আওতাধীন বিভিন্ন প্রোগ্রাম থেকে সরাসরি উপকৃত হয়েছে। অর্থাৎ দরিদ্র ব্যক্তিরা কিভাবে সরাসরি উপকৃত হয়ে নিজদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে তা নিয়ে লিখিত বইটিই হচ্ছে ‘পুওর ইকোনমি’। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক অধ্যাপক হিসেবে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে কর্মরত অভিজিত বন্দোপাধ্যায় আসলে দরিদ্র জনগোষ্ঠির কথাই ভেবেছেন।

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট
ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট