চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্তনক্যান্সার সচেতনতা মাস তৃণমূল জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা জরুরি

রেজা মুজাম্মেল

২৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

দেশের তৃণমূল গ্রাম পর্যায়ের ৯০ শতাংশ মহিলাই স্তন ক্যান্সারের সঙ্গে পরিচিত নন। তাছাড়া স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আগে ৮০ শতাংশ রোগী এ রোগের নামই শুনেননি। আর ৯৫ শতাংশ রোগী জীবনে কোনো দিন নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করে দেখেননি। অন্যদিকে বাংলাদেশে স্তনক্যান্সার আক্রান্ত মহিলাদের ৪০ শতাংশই শনাক্ত হয় ৫০ বছর বয়সের পর। এটি কেবল নিজেকে নিয়ে নিজের অসচেতনতার কারণে। অথচ এর বিপরীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৫০ বছর বয়সী মহিলাদের শনাক্ত হয় মাত্র ২০ শতাংশ। সচেতনতার কারণে প্রাথমিক ধাপেই তাদের স্তনক্যান্সার শনাক্ত হয়। তাই ভয়াবহ মরণব্যাধি ক্যান্সার নিয়ে গ্রাম পর্যায়ের মানুষদের সচেতন-সজাগ করা জরুরি। দেশের বৃহত্তর জনোগোষ্ঠীর বসবাস গ্রামে। তাই স্তনক্যান্সারসহ অন্যান্য ক্যান্সার নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষদের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সচেতন করা না হলে আগামীতে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করার সম্ভাবনা আছে। বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই ক্যান্সারের মত ভয়াবহ মরণব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। পুরো অক্টোবর মাস জুড়ে চলছে স্তনক্যান্সার সচেতনতা মাস। এ নিয়ে নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।

দুই. স্তনক্যান্সার নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতন করতে সরকারের বর্তমানে বহাল থাকা স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোকে কাজে লাগানো যায়। এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। কারণ এসব ক্লিনিক একবারেই গ্রামপর্যায়ে। বর্তমানে সারাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে ১৩ হাজার ৭৪৩টি। এখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নিয়োজিত আছেন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)। ২০০৯ সালে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালুর পর থেকে গত ১০ বছরে ৬২ কোটি ৫৭ লাখ সুবিধাবঞ্চিত বেশি রোগী সেবা গ্রহণ করেছেন (জনকণ্ঠ ২৭ এপ্রিল ২০১৯)।

প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন নারী, পুরুষ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করছেন। সেবাগ্রহীতাদের ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। ফলে তৃণমূলের এ স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোকে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে। এর জন্য প্রয়োজন কেবল কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের বিভিন্ন ক্যান্সার নিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা। একটু আন্তরিক, সচেতন এবং দায়িত্বশীল হলেই কাজটি করা সম্ভব। এর মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ের বড় একটি জনগোষ্ঠীকে ক্যান্সারসহ নানা রোগ নিয়ে সচেতন করা যাবে। গত ১০ বছরে সেবা গ্রহণকারীদের হাতে যদি একটি করে স্তনক্যান্সার সচেতনতার লিফলেট দেওয়া হতো, তাহলে তারা এ ব্যাপারে অবগত হত। তাছাড়া প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমেও গ্রামএলাকায় স্তনক্যান্সার শনাক্তের পদ্ধতি সম্পর্কে জানানো সম্ভব। সিএইচসিপিরা গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি যান, আর রোগীও কমিউনিটি ক্লিনিকে আসেন। ফলে তারা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষদের অনেক বেশি সচেতন করার সুযোগ আছে। তাই ‘শেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন’ (নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা)সহ কয়েকটি বিষয় অবগত থাকলে প্রাথমিক পর্যায়ে স্তনক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব।

তিন. দেশে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ক্যান্সার রোগ। সঙ্গে বাড়ছে স্তনক্যান্সারও। অনেকটা নীরব ঘাতকের মতই নিভৃতে ছড়াচ্ছে। বিষয়টি কেউ বুঝতে পারেন, কেউ বুঝতে পারেন না। কখনো বুঝে ওঠার পর চিকিৎসার আর এতটুকু সুযোগ থাকে না। অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে শেষ পর্যায়েই শণাক্ত করা হয়। কিন্তু এখন সময় এসেছে সচেতনতা, নিজের প্রতি নিজের দায়িত্বশীলতা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্তনক্যান্সারকে জয় করার। দূর করতে হবে সকল জড়তা-হীনতাকে। অন্যদিকে, চট্টগ্রামসহ দেশে ক্যান্সার রোগের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক অপ্রতুল। বর্তমানে চমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে ৪৬টি শয্যা আছে। প্রতিদিন বহির্বিভাগে ১০০ থেকে ১২০ জন রোগী সেবা গ্রহণ করে। তাছাড়া সপ্তাহে ক্যান্সার আক্রান্ত প্রায় ১৫০ রোগীকে ব্রেকিথেরাপি দেওয়া হয় এবং সপ্তাহে ১৫ থেকে ২০ জনকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। এ ওয়ার্ডে আগত নতুন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের প্রতি চারজনের একজন স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত। কিন্তু রোগীর তুলনায় এ সেবাব্যবস্থা অনেক কম।

চার. স্তনক্যান্সার কেমন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, তার কিছু পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৩ শতাংশ নারী স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করছেন প্রায় ১৭ শতাংশ। এদের অধিকাংশ মহিলারই বয়স ৪০ থেকে ৫৪ বছর। বছরে কেবল ৮ হাজার ৩৯৬ জন মহিলা স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। বছরে গড়ে দেড় লাখ মহিলা স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। বর্তমানে জরায়ু ক্যান্সারের পরই স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হচ্ছে বেশি। আগামী ২০২৫ সালে এটি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রথম কারণ হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে গ্লোবাল ক্যান্সার স্ট্যাটিটিক্স ২০১৮ (গ্লোবাবোক্যান) এর তথ্য মতে, প্রতি বছর নতুন করে স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে ২০ লাখ ৮৮ হাজার ৮৪৯ জন নারী। তাই স্তনক্যান্সার প্রতিরোধে প্রতি বছর নারীদের একবার করে হলেও স্তনপরীক্ষা করা জরুরি। তবে এখন পুরুষরাও স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। যদিও এর হার কম। এক হিসাবে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর ৪১ হাজার নারী স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত হন, এর বিপরীতে মাত্র ৩০০ জন পুরুষ এ রোগে আক্রান্ত হন।

পাঁচ. ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিআরসিএ-১ ও ২ নামের জিনের অস্বাভাবিক মিউটেশন স্তনক্যান্সারের জন্য দায়ী। আবার কখনো মা, খালা, বড় বোন বা মেয়ের স্তনক্যান্সার থাকলে, পারিবারিক জিনগত কারণে, যাদের বারো বছরের আগে ঋতুস্রাব হয় এবং পঞ্চাশ বছরের পরে মেনোপজ বা ঋতুস্রাব বন্ধ হয়, তারাও ঝুঁকিতে থাকেন। তাছাড়া অনিয়মিত, দীর্ঘস্থায়ী বা নির্দিষ্ট সময়ের আগে মাসিক হলে তাতে স্তনক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। আবার এমন অনেক কিশোরী আছে যাদের ১৩-১৪ বছরের মধ্যে মাসিক হওয়ার কথা থাকলেও দেখা যায় ১০ বছরেই মাসিক হয়ে যায়, তাদেরও স্তনক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। অবিবাহিত ও নিঃসন্তান নারীদের স্তনক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। কারণ তারা সন্তানকে কখনো স্তন পান করাননি, তাই ঝুঁকি বেশি থাকে। অন্যদিকে, বর্তমানে কুসংস্কার, লজ্জা ও সচেতনতার অভাবসহ নানা কারণে স্তনক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর সঙ্গে আছে খাদ্যাভ্যাস, বয়স, অধিক ওজন, দীর্ঘদিন ধরে হরমোনের ওষুধ খাওয়ার কারণেও স্তনক্যান্সারের ঝুঁকি আছে। তাই ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রয়োজন পরিবার ও নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া, কায়িক পরিশ্রম করা, প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিটি শরীর চর্চা, পরিমিত খাবার খাওয়া ও ¯œায়ুচাপমুক্ত জীবন যাপন করা।

ছয়. ক্যান্সার এখন এক নীরব ঘাতকের নাম। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে এটিকে প্রতিরোধ করা যায়। স্তনক্যান্সার এবং এর ঝুঁকি সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত থাকলে এ রোগ প্রতিরোধ করা খুবই সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণ সচেতনতা। নিজের প্রতি নিজের দায়িত্বশীলতা। জড়তা-হীনতা দূর করা। লজ্জা পরিত্যাগ করা। ২০ বছর বয়সের আগে অবশ্যই স্তন পরীক্ষা করা। যথাসময়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। তবেই পরাজিত হবে দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধি।

রেজা মুজাম্মেল গণমাধ্যমকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট