চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বৌদ্ধ উৎসব কঠিন চীবর দান

ড. প্রণব কুমার বড়–য়া

২৮ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:২৮ পূর্বাহ্ণ

বৌদ্ধ ধর্মে দানের গুরুত্ব অপরিসীম। বোধিজ্ঞান লাভের জন্য যে দশটি পারমী পূর্ণ করতে হয়, তম্মধ্যে সর্বপ্রথম হল, দানপারমী। দান হল স্বত্ব ত্যাগ করে শুদ্ধাচিত্তে যাচককে দেয়া-দানের প্রকারভেদ আছে যেমন ধনসম্পত্তি দান, পুত্রকন্যাদান, দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গদান, এমনকি স্বীয় জীবনও দান। দান একটি পুণ্যকর্ম-দান মানুষের ত্রাণ করে। সেজন্য দাতার তিনটি গুণ থাকা দরকার-একটি হলো সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থ, দ্বিতীয়টি হলো দানের জন্য চেতনা থাকা, তৃতীয়টি হল, যাকে দান করা হয় তিনি যেন শীলবান এবং শুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী হন। দান আর সাহায্য এক জিনিষ নয়- দানের জন্য মনের মধ্যে প্রফুল্লতা থাকতে হয়। দান দেয়ার সময় দাতাকে শ্রদ্ধা সম্পন্ন হতে হবে। শ্রদ্ধা মানে সাধারণ বিশ^াস নয়, শ্রদ্ধা হল জ্ঞানদ্বারা প্রতিষ্ঠিত দৃঢ় বিশ^াস। অতএব দান বৌদ্ধ ধর্মে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

এছাড়াও বৌদ্ধধর্মে আরও বিভিন্ন প্রকারের দান আছে, যথা সংঘদান, অষ্টপরিস্কার দান, বিহার দান এবং কঠিন চীবর দান। এদের মধ্যে কঠিন চীবর দানকে দানশ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। বৌদ্ধ মতে দানের উপযুক্ত ক্ষেত্র হল পবিত্র ভিক্ষু সংঘ। কারণ সংঘ হচ্ছে বিশুদ্ধ, বন্দনার যোগ্য, দক্ষিণার যোগ্য, সত্য পথের পথিক, আহ্বানের যোগ্য এবং অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র।

বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশি^নী পূর্ণিমা এই তিনমাস ব্যাপী বর্ষাব্রত পালন করে স্ব স্ব বৌদ্ধ বিহারে বর্ষাব্রত পালন শেষে তারা আশি^নী পূর্ণিমায় প্রবারণা পালন করেন। এটা ভিক্ষুদের আত্মশুদ্ধি ও আত্মসমর্পণের ধর্মীয় বিধান। প্রবারণার পর ভিক্ষুরা বের হয় গ্রামে নগরে বন্দরে জনপদে অনুষ্ঠেয় কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য। এ যেন এক ধর্মযাত্রা, লক্ষ্য হল মানবকল্যাণ, ভিক্ষুদের এই অভিযাত্রার উদ্দেশ্য হলো, হিংসা, বিদ্বেষ সন্ত্রাস ও মাদকতা থেকে উত্তরণের অভিপ্রায়ে মৈত্রী, করুণা, শান্তি, সৌহার্দ্য ও সংহতির চর্চা ও পুণ্যময় জীবনে উন্নীত হওয়া। ভিক্ষুদের আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বর্ষাব্রত পালনের মধ্য দিয়েই এর সূচনা এবং তিন মাস পর আশি^নী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত দানানুষ্ঠানের পূর্ণতা প্রদান। এই কঠিন চীবর দানেরও সীমা আছে, তা হলো আশি^নী পূর্ণিমার পর দিন থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত। এখানেও নিয়ম হলো, যে বিহারে ভিক্ষুরা বর্ষাব্রত পালন করেন একমাত্র সেই বিহারেই কঠিন চীবর দান হতে পারবে-আর যে ভিক্ষু বর্ষাব্রত পালন করেন তিনিই কঠিন চীবর লাভের যোগ্য। সে রকম, এক বৌদ্ধ বিহারে দু’বার কঠিন চীবর দান হতে পারে না-তেমনি এক ভিক্ষু দু’বার কঠিন চীবর গ্রহণ করতে পারে না।

ভিক্ষুদের ব্যবহার্য বস্ত্রকে চীবর বলা হয়। এগুলি হলো, উত্তরাসঙ্গ বা বহির্বাস, সংঘাটি বা দোয়াজিক আর হলো অন্তরবাস অর্থাৎ যেটা পরিধান করা হয়। এদের মধ্যে যে কোন একটি চীবরকে দানের মাধ্যমে বিনয়ের বিধি মতে কঠিন করা হয় এবং এটা হয় কঠিন চীবর। বৌদ্ধরা জাঁকজমকের সাথে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভিক্ষুদের কঠিন চীবর দান করে প্রতিবছর। গৃহীরা বিভিন্ন বিহারে দান দিতে পারে। চীবর তৈরির ব্যাপারেও নিয়ম আছে। প্রথম নিয়ম হলো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কাপড় তৈরি করে সেলাইয়ের পর রঙ করে প্রস্তুত করা চীবর, দ্বিতীয়টি হলো, বাজার তৈরি কাপড় কিনে সেলাই ও রং করে প্রস্তুত চীবর তৃতীয়টি হলো- পূর্বে প্রস্তুত করা চীবর। পূর্বে বৌদ্ধদের ঘরে ঘরে তাঁত ছিল তাই প্রথম নিয়মে চীবর তৈরি করা হত। এখন অবশ্য উপজাতীয় বৌদ্ধদের মধ্যে দু’এক জায়গায় এভাবে চীবর তৈরি হয়। আর এভাবে তৈরি চীবর দান করলে এর ফল একটু বেশি হয়। তবে অন্য চীবরের ফলও কোন অংশে কম নয়। ত্রিপিটকে জানা যায়, গৌতম বুদ্ধই এই কঠিন চীবর দানের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ভিক্ষু সংঘকে আহ্বান করে বলেছিলেন হে ভিক্ষুগণ আমি অনুজ্ঞা প্রদান করছি, বর্ষাবাস সমাপক ভিক্ষুগণকে কঠিন চীবর আস্তীর্ণ করবে। চীবর আর কঠিন চীবরের পার্থক্য হলো, কঠিন চীবর তৈরির জন্য কতকগুলি নিয়ম অনুসরণ করা হয়। অতপর গৃহীদের দান করা চীবর ভিক্ষুরা সীমাঘরে গিয়ে বিনয়কর্মের মাধ্যমে কঠিনে আস্তীর্ণ করেন।

কঠিন চীবর দানের ফল সম্পর্কে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি যদি সুমেরু পর্বত সমান দানসামগ্রী একত্রিত করে দান করে তার ফল কঠিন চীবর দানের ষোল ভাগের এক ভাগও হয় না। এই দানের ফলে মানুষের সুগতি হয়, পরজন্মে দুঃখ পায় না। রাজচক্রবর্ত্তীর মত জীবনলাভ করে, অন্নবস্ত্রের অভাব হয় না। অন্যসব দানের চেয়ে কঠিন চীবর দানের ফল ষোল ভাগের এক ভাগও হয় না যেখানে, এটা স্বয়ং বুদ্ধ বলেছেন, সেখানে কঠিন চীবর দানের ফল সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তাই এই দানকে দানশ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। দান মানুষকে ত্রাণ করে, অর্থাৎ দুঃখ থেকে মুক্ত করে, দুঃখের দরজা বন্ধ করে দান সুগতি লাভের পথ। এরকম দানের মাধ্যমে মন প্রসারিত হয়। সংকীর্ণতা দূরীভূত হয়, লোভ, দ্বেষ, মোহ দূরীভূত হয়, মৈত্রীপরায়ণ হয়, মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করে। তাই প্রত্যেকের জীবনে একবার হলেও কঠিন চীবর দান করা কর্তব্য।

এ দানের সামাজিক সাংস্কৃতিক দিকও আছে। যেই গ্রামে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয় সে বিহারে দূর-দূরান্ত থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সমবেত হন, তাদের আগমনে গ্রামে ধর্মীয় বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। বৌদ্ধরা তাদের যথাযোগ্যভাবে স্বাগত জানায়, তাদের সেবাযত্ন করে, দান-দক্ষিণা দেয় এবং আহার্য প্রদান করে, শীলগ্রহণ করে। দিনব্যাপী আনুষ্ঠানমালার মধ্যে সকালে বুদ্ধ পূজা হয়, শীল গ্রহণ করা হয়, ভিক্ষুদের খাদ্যভোজ্য প্রদান করা হয়। দুপুরে অতিথি ভোজনও হয়। বহু দূর থেকে ভক্তপ্রাণ নরনারী আগমণ করে। বাড়িতে বাড়িতে ভাল রান্না হয়, প্রবাসী ঘরে ফেরে দূর দেশ থেকে, গ্রামের বিবাহিত মেয়েরা নাইয়র আসে অর্থাৎ বাপের বাড়ি আসে। গ্রামবাসী এক মাস আগে থেকেই চীবর দানের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দূর নিকট হয়, পর আপন হয়। শুধু গ্রামবাসী নহে, অন্যান্য অঞ্চলের নরনারীও এতে যোগ দেন। দানে অংশ নেয়, এমনকি দানের সময় উপস্থিত থেকে অনুুমোদন করলেও পুণ্যাংশ লাভ করা যায়। সমস্ত গ্রামে উৎসবের হাওয়া বয়ে যায়, আত্মীয়স্বজনের সমাগম হয়। বিহার প্রাঙ্গণে মেলা বসে যায়, ছোটখাটো দোকানও বসে, মেয়েদের জন্য কাচের চুড়ি হলো অন্যতম আকর্ষণ।

বিকেলে অর্থাৎ দুপুর দুটোর পর অনুষ্ঠিত হয় দানসভা। সেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমাগম হয়। এই সভা একটি সম্মেলনে পরিণত হয়। ধর্ম ব্যাখ্যার জন্য শুধু বৌদ্ধ পন্ডিত নহে অন্যান্য ধর্মের পন্ডিত ও বুদ্ধিজীবীরা অংশ নেয়। কোন কোন অনুষ্ঠানে বিশেষত শহরের অনুষ্ঠানে মন্ত্রীবর্গ এবং সংসদ সদস্যরাও যোগদান করে। অনুষ্ঠান পরিণত হয় সম্প্রীতির মিলনমেলায়। প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ ভিক্ষুরা সভাপতিত্ব করেন- ধর্মদেশনা করেন। গৃহীদের প্রতিনিধিরা গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তারা বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন ব্যাখ্যা করেন। এভাবে একটি সাম্প্রায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তারা সুন্দরভাবে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। আকর্ষণীয় প্যান্ডেল ও মঞ্চ তৈরি করা হয়। কঠিনচীবর দান অনুষ্ঠান বৌদ্ধদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়-এই যে মিলনমেলা তাই হলো কঠিন চীবরদান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক।

প্রতি বিহারে সন্ধ্যায় প্রদীপ পূজা হয়, অর্থাৎ বুদ্ধমূর্তির সামনে ভক্তরা প্রদীপ জ¦ালায়। পঞ্চশীল গ্রহণ করে, শেষে আকাশে ফানুস উড়ানো হয়। সবশেষে হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কোন কোন বিহারে নাটকও মঞ্চস্থ হয়। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। এই উপলক্ষে আকর্ষণীয় স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বুদ্ধিজীবীদের বাণীও প্রদান করা হয়, যা স্মরণিকায় ছাপা হয়। এভাবে বৌদ্ধদের শুভ কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানের শুভ সমাপ্তি হয়। এটা সম্প্রীতির উৎসব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট