চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

আদর্শ শিক্ষকের পথিকৃৎ ওবাইদুল হক

মুসলেহউদ্দিন মুহম্মদ বদরুল

২৩ অক্টোবর, ২০১৯ | ১:৩৪ পূর্বাহ্ণ

যিনি শিক্ষা দান করেন তাঁকে বলা হয় শিক্ষক। কোন এক প-িত ব্যক্তি বলেছেন শিক্ষকের আদ্যাক্ষর শি=শিষ্টাচার, ২য় অক্ষর ক্ষ = ক্ষমা, ৩য় অক্ষর ক = কর্তব্যপরায়ণ তথা এক কথায় যাঁর নাম শিক্ষক। ইংরেজিতে ঞঊঅঈঐঊজ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ঞ = ঞৎঁঃযভঁষ (সত্যবাদী) ঊ=ঊফঁপধঃরড়হ (শিক্ষা) অ=অপঃরাব (সক্রিয়) ঈ=ঈযধৎধপঃবৎ (চরিত্র) ঐ= ঐড়হবংঃ (সৎ), ঊ=ঊহবৎমবঃরপ (উদ্যোমী) জ=জবংঢ়ড়হংরনষব (দায়িত্ববান)। আসলে উল্লেখিত গুণগুলো যাঁর মধ্যে রয়েছে তিনিই শিক্ষক। শিক্ষার্থী যে কেউ হতে পারে। কিন্তু সবার পক্ষে শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষক হতে হলে আগে নিজেকে শিক্ষিত হতে হবে। সর্বোপরি ভাল মানুষ হতে হবে। সততা ও নৈতিকতাই হবে একজন শিক্ষকের চরিত্রের অলংকার। শিক্ষকের কোন জাত নেই, ধর্ম নেই, বর্ণ নেই শ্রেণী নেই। তাঁর একমাত্র পরিচয় তিনি শিক্ষক।

বৃটিশ ও পাক আমলে সমাজের সবচেয়ে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও প-িত ব্যক্তিরাই শিক্ষকতাকে মহান ব্রত হিসেবে বেছে নিতেন। শিক্ষকতা শুধু একটি চাকুরী নয়। যাঁরা শিক্ষকতাকে একটি চাকুরি হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাঁরা আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন নি। তাঁরা ক্লাসরুমে গতানুগতিক পাঠদান করেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেন। সত্যি কথা বলতে কি, এরকম শিক্ষকের সংখ্যাই আমাদের সমাজেঅনেক বেশি। তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, একজন শিক্ষক হওয়া আমাদের দেশে খুব সহজ হলেও একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া বর্তমানে খুব কঠিন।

আজ আমি একজন আদর্শ শিক্ষকের কথা সম্মানিত পাঠকবর্গ সমীপে উপস্থাপন করতে চাই, যিনি সদ্য লেঅকান্তরিত হয়েছেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ফটিকছড়ি উপজেলায় জাঁহাপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আদর্শ শিক্ষকের পথিকৃৎ, পরম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব ওবাইদুল হক সাহেব। পাক আমলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে এমএড ডিগ্রী লাভের পর তিনি করাচী এয়ারফোর্স ও কাপ্তাই পাওয়ার হাউসে কিছুকাল চাকুরীতে নিয়োজিত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি ফটিকছড়ির জাঁহাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করে শিক্ষকতাকে জীবনের মহান ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন। এর পরে নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজানের গহিরা এ জে ওয়াই এম এস উচ্চ বিদ্যালয়, পটিয়ার হাবিলাসদ্বীপ উচ্চ বিদ্যালয়, এম ই এস উচ্চ বিদ্যালয়, আলকরণ নূর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়, পোস্তারপাড় উচ্চ বিদ্যালয় এবং সর্বশেষ ইস্পাহানী জুট মিলস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসাবে ২০০০ সালে অবসর নেন। অবসরকালীন সময়ে তিনি চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ সানমুন স্কুল এন্ড কলেজ এবং কদম মোবারক উচ্চ বিদ্যালয়, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম এর পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

মানুষ গড়ার মহান এই কারিগর এর সাথে আমার কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না। ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে শহরের একটি কমিউনিটি হলে বিবাহত্তোর অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকাটা আমার জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। কারণ, পাত্রের জনক হচ্ছেন আমার ছেলে বেলার শিক্ষক। মা-বাবার পরে যাঁর প্রাণভরা দোয়া ও ¯েœহের পরশে আমার জীবন ধন্য হয়েছে। ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভা-ার গ্রামের আলহাজ¦ মাহবুবুল আলম মাস্টার সাহেব তাঁর ৩ পুত্রের মতই আমাকে সমান দৃষ্টিতে দেখেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। স্যারের নিকট প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের পাঠ চুকিয়ে ছিলাম ষাটের দশকের শেষের দিকে। আল্লাহর মেহেরবাণীতে গুরু-শিষ্যের বন্ধন এখনও অটুট।

দেখা হলেই সত্তরোর্ধ বয়সী স্যার যখন বলেন অ বদরুল ক্যান আছস তুই’ তখন এক অনাবিল আনন্দ শিহরণে শিহরিত হই।ঐদিন রাতে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছুতেই স্যারের সেই চিরাচরিত ভঙ্গিতে কুশলাদি জিজ্ঞাসার এক পর্যায়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন একজন নবতিপর শিক্ষাগুরুর সাথে। বয়স্ক হলেও চেহারা ও শারীরিক অবয়বে ব্যক্তিত্বের ছাপ বিদ্যমান পরিলক্ষিত হল। স্বাভাবিক চলাফেরা করেন। আমার পিতৃ পরিচয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোক আবেগাপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন। পাশাপাশি বসে অনেকক্ষণ পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করলেন। আমাকে পেয়ে ওনার কথা যেন শেষই হতে চায় না। জানলাম, আমার বাবা মৌলভী হাফিজুর রহমান বিএবিটি এই বয়োবৃদ্ধ ভদ্র লোকের শিক্ষক ছিলেন। চল্লিশের দশকে ফটিকছড়ি উপজেলার জাঁহাপুর হাইস্কুলে সিনিয়র ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে তিনি পেয়েছিলেন আমার বাবাকে।

শুনছিলাম, একজন প্রাক্তন গুণমুগ্ধ ছাত্রের নিকট বাবার কর্ম ও কৃতিত্বের কথা। ইংরেজি বিষয়ে আব্বার গভীর পা-িত্বের কথা। কথার ফাঁকে প্রবীণ এই শিক্ষাগুরু ক্ষোভ ঝারলেন বর্তমান শিক্ষকদের প্রতি। বললেন, কিছু শিক্ষক নামধারী ব্যক্তির চরিত্রে নীতি ও নৈতিকতার ধ্বস নেমেছে। তাঁরা প্রকৃত শিক্ষক নন। তিনি বলেন, শিশু-কিশোরদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যিনি ভূমিকা রাখেন তিনি হলেন শিক্ষক। এ কারণে শিক্ষকতা পেশা সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে শিক্ষকতাকে কোন পেশা হিসেবে না দেখে, এবাদত হিসেবে গণ্য করেন। তাই কেউ যেন মনে না করে, একাডেমিক শিক্ষা শেষে শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে বরং এ সম্পর্ক শিক্ষক যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিনের। যে শিক্ষকের আদর্শ নেই, যে শিক্ষক বিজ্ঞানমসস্ক নয়, যে শিক্ষক সেক্যুলার নয়, তিনি শুধু তথ্য ও জ্ঞান দিয়ে ছাত্রদের সাহায্য করেন। ছাত্রের আত্মিক বিকাশ ও নৈতিক পূর্ণতার ক্ষেত্রে তাঁর কোন ভূমিকা থাকে না। শিক্ষার আলোর ফেরিওয়ালা ওবাইদুল হক সাহেব অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম। তিনি তাঁর শিক্ষক সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় বলছিলেন, ‘আমার স্যার হাফিজ মিয়ার দিকে তাকালে নিজেকে মনে করতাম ওনার সামনে আমি কিছুই না। আবার উত্তর সূরীদের দিকে তাকালে মনে হয় আমার সামনে ওরা কিছুই না। প্রবীণ শিক্ষাগুরু বলছিলেন, ‘একজন আদর্শ শিক্ষকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো – ‘বিনয়’। যে যতবেশি শিক্ষিত, সে তত বেশি বিনয়ী। স্যারের কথার সাথে নবী বংশের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম সাদেক (আ.) এর কথার মিল খুঁজে পাই। জ্ঞানের এই সাধক শিক্ষকদের বিনয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে বিনয়। বিনয় হচ্ছে শিক্ষকদের সৌন্দর্য। অতি অল্প সময়ের পরিচয় ও আলাপচারিতায় মনে হল, ওবাইদুল হক সাহেব সর্বগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ, যাঁর মধ্যে পার্থিব ও ধর্মীয় গুণাবলির কোন কিছু অবশিষ্ট নেই। বিবাহনুষ্ঠানে টেবিলে এক সাথে খাওয়ার পর আলোকিত মানুষটির প্রস্থানে আলো জ¦লমল কমিউনিটি হল যেন অন্ধকারে ঢেকে গেল, আমার তাই মনে হল। গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শুক্রবার সকালে এই বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী, মানুষ গড়ার মহান কারিগর ওবাইদুল হক সাহেব ৯৪ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত রোগে চট্টগ্রাম নগরীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে….রাজেউন)

একজন শিক্ষকের চির বিদায় মানে একটি জনপদ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া। শিক্ষার একটি আলোকিত প্রদীপ নিভে যাওয়া। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি কোনো মুমিন মুসলমান জুমআর দিনে কিংবা জুমআর রাতে মৃত্যুবরণ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহতাআলা তাঁকে কবরের ফিতনা হতে নিরাপদ রাখেন (মসনাদে আহমদ, তিরমিজি, বাইহাকি, মিশকাত)। এ হাদিসটির ব্যাখ্যায় এসেছে যে ফিতনা দ্বারা কবরের মুনকার নাকিবের জিজ্ঞাসাবাদ অথবা কবরের আজাবকে বুঝানো হয়েছে। উক্ত হাদিস শরীফের আলোকে ওবাইদুল হক সাহেব নিঃসন্দেহে একজন মুমিন মুসলমান। কারণ, একজন ইংরেজি শিক্ষিত লোক হয়েও তিনি ধর্মভীরু, দ্বীনদার, পরহেজগার, মুত্তাকী মুসলমান ছিলেন।

মরহুম ওবাইদুল হক সাহেব এর স্মৃতির প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে স্বরচিত একটি কবিতা নিবেদন করে শেষ করছি : ওপারের বাসিন্দা আজ তুমি/বান্দাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তকমা করেছো অর্জন/ ইথারে এখনও শুনি তোমার কণ্ঠধ্বনি/দুজাহানের সফলতা পেয়েছো জানি/ লও সালাম হে শিক্ষাগুরু, বিদগ্ধ গুণীজন/হক, সত্য ও সুন্দরের পথে চলেছো আজীবন/কথন, বচন ও ভূষণে ছিলে অতুলনীয়, অনুপম।
আল্লাহ মরহুমকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। আমিন।

মুসলেহউদ্দিন মুহম্মদ বদরুল প্রাবন্ধিক, নির্বাহী সম্পাদক, মদীনার আলো

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট