চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বখতিয়ারুল আলম : একজন বিস্মৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

২২ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৪১ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার গৌরবময় সুবর্ণজয়ন্তী যখন দরজায় কড়া নাড়ছে তখন মুক্তিযুদ্ধের কত কথা, কত ঘটনা স্মৃতিপটে ভিড় করে আসছে। মনে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ, সম্ভ্রমহারা মা-বোন, ভিটামাটি হারানো কোটি শরণার্থী এবং সহযোদ্ধাদের কথা, যাঁদের কথা আমরা ভুলে গেছি। বখতিয়ারুল আলম চট্টগ্রাম শহরের এমনি একজন বিস্মৃত মুক্তিযোদ্ধা, আজ তাঁর কথা বলব।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম ১৯৪২ সালের ৩ মার্চ চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশ থানাধীন বর্তমান ৮নং শুলকবহর ওয়ার্ডের আবদুল মান্নান সওদাগর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। আবদুল মান্নান সওদাগর তাঁর পিতা, মাতা নছুমা খাতুন। পিতামহ আবদুল গণি সওদাগর, পিতামহী রহিমন বিবি, মাতামহ শুলকবহরের তফাজ্জল আলী চৌধুরী বাড়ির জমিদার হামদু মিয়া চৌধুরী, মাতামহী মাহমুদা খাতুন।

হামদু মিয়া চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী, স্বদেশভক্ত। তিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী রাজনীতির সমর্থক ছিলেন এবং তাঁর বিপ্লবীদলের প্রয়োজনে টাকা-পয়সাসহ নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। হামদু মিয়া চৌধুরী তাঁর জীবদ্দশায় কখনো ব্রিটিশদের সাথে আপস করেন নি। বখতিয়ারুল আলম শৈশবে বেশিরভাগ সময় নানা হামদু মিয়া চৌধুরীর সঙ্গেই কাটাতেন। মিয়া তাঁর প্রিয় নাতিকে স্বদেশ ও স্বজাতিকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। তিনি তাঁকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে স্বাধীনতার লাল গোলাপ ছিনিয়ে আনার বজ্রকঠিন শপথে বলীয়ান হয়ে কঠিন কঠোর সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হবার প্রেরণা জুগিয়েছেন।
প্রাইমারি শিক্ষা অর্জনের পর বখতিয়ার কাজেম আলী হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তৎকালীন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে (বর্তমানে সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। উক্ত কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে মানবিক বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৬৮ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম আইন কলেজে ভর্তি হন এবং এল এল বি পাস করেন।

সিটি কলেজে পড়ার সময় থেকেই বখতিয়ার ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি সিটি কলেজে পড়ার সময়ে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন। জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। তিনি যখনই ডাকতেন, যত রাতই হউক মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম তাঁর ডাকে ছুটে যেতেন। কারণ তিনি ছিলেন তাঁর পরম বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন কর্মী। ১৯৬৬ সালে লালদীঘির জনসভা হতে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করেন; বখতিয়ার এই জনসভা আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ এর নির্বাচনেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন।
বখতিয়ার বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ১৯৬৮ সালে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। একই সময়ে

ছাত্রলীগের নির্বাচনী জোট ‘অভিযাত্রিক’এরও সভাপতি ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ১৯৭১ সালে ১০ মার্চ বখতিয়ারুল আলমের সভাপতিত্বে সিটি কলেজ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন মৌলভী সৈয়দ, ইদ্রিস আলম, সাইফুুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, শফিউল বশর, সমীর সেন, মনির আহমদ। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য কলেজ ছাত্রলীগের শেষ প্রস্তুতি সভা।
একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। বখতিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। ছাত্র রাজনীতি করার সময় তিনি শহর ছাত্রলীগ সভাপতি মৌলভী সৈয়দের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মৌলভী সৈয়দ শহরেই আত্মগোপন করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরকে সংগঠিত করতে থাকেন। তিনিও বখতিয়ারকে শহরে থেকে যুদ্ধ করতে পরামর্শ দেন। তিনি বখতিয়ারকে পাঁচলাইশ, শুলকবহর, বাকলিয়া এলাকায় কাজ করার দায়িত্ব দেন। তাঁর শুলকবহরস্থ বাড়িকে মুক্তিযোদ্ধাদের সেল্টার হিসেবে তৈরি করার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী বখতিয়ার ঝুঁকি নিয়ে নিজের বাসভবনটিকে মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলেন এবং নিজেই এই সেল্টারের তত্ত্বাবধান করতেন। চাকসু’র প্রথম ভি পি ইব্রাহিম এই সেল্টারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন। বখতিয়ারুল আলমও ভি পি ইব্রাহিম এর বেইজকে সব সময় টাকা পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করতেন।

খাতুনগঞ্জের পোড়াভিটা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে যুদ্ধের একটি চিঠি পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায় ক্যাম্পটি ছিল মৌলভী সৈয়দের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। বখতিয়ারুল আলম চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। শহরের ষোলশহর এবং কদমতলীতে অপারেশনে অংশগ্রহণের কথা তিনি চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন গেরিলা কমান্ডার কাজী ইনামুল হক দানু, চাকসু ভি পি ইব্রাহিম, কুতুব উদ্দীন চৌধুরী, আবুল বশর, কামাল উদ্দীন, জামাল উদ্দীন, আবু তাহের চৌধুরী প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম আটক হন। স্থানীয় কিছু চিহ্নিত রাজাকার, আল বদরের সহযোগিতায় তাকে আটক করা হয়। তাঁকে আটক করার জন্য কয়েকটি গাড়ি নিয়ে ৫০জন পাঞ্জাবি সৈন্য তাঁর বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন। পাঞ্জাবিদের সঙ্গে কিছু স্থানীয় রাজাকার, আলবদরও ছিলে। পাক হানাদার বাহিনী তাঁকে চোখে কালো কাপড় এবং তাঁর দুই হাতকে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যায়। প্রথমে তাঁকে তৎকালীন বালতি কোম্পানির মুখে বর্তমানে বাদুরতলা আরাকান হাউজিং সোসাইটির সম্মুখে নিয়ে যাওয়া হয়।

তারপর তাঁকে কদমতলীতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তাঁর কাছ থেকে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে চাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে সার্কিট হাউজের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাঁর উপর শুরু করা হয় অকথ্য নির্যাতন। তাঁকে ৪৮ ঘণ্টা দড়ি দিয়ে উপরে ছাদের বিমের সঙ্গে পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে অত্যাচার করা হয়। রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে তাঁর মুখের উপরের পাটির ছয়টি দাঁত ফেলে দেয়া হয়। হাতের বাহুতে দেয়া দড়ির বাঁধন হাড়ে গিয়ে ঠেকে। এভাবে তাঁর উপর পাঁচদিন পর্যন্ত অত্যাচার ও নির্যাতন চালানো হয়।
এদিকে পাক বাহিনীর হাতে তাঁর আটক হবার খবর শুনে ঘরে তাঁর বাবা-মা বেহুঁশ হয়ে যান। তাঁর ভগ্নিপতি ছিলেন তৎকালীন সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম। তিনি খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে ছুটে আসেন। পাঁচদিন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া না যাওয়ায় তিনিও চিন্তিত হয়ে পড়েন।

প্রফেসর কালাম বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে খবর পান যে, বখতিয়ারুল আলমকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের ভিতরে টর্চার সেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং তার উপর চরম অত্যাচার নির্যাতন চলছে। ঐ টর্চার সেল বেলুচি ক্যাপ্টেন মালেক-এর অধীনে ছিল। প্রফেসর আবুল কালাম নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেয়ে সার্কিট হাউজে যান এবং ক্যাপ্টেন মালেক-এর সাথে দেখা করার অনুমতি চান। প্রফেসর আবুল কালাম উর্দু এবং ইংরেজি ভাষাতে সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। তিনি সার্কিট হাউজে ঢুকে ক্যাপ্টেন মালেকের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার পর টিপ সই দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলমকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম নন। বখতিয়ারুল আলমকে যখন তাঁর বাসায় শুলকবহরের আব্দুল মান্নান সওদাগর বাড়িতে তাঁর বাসায় নিয়ে আসা হয় তখন তাঁর জ্ঞান ছিল না। খবর পেয়ে শুলকবহরের অসংখ্য মানুষ তাঁকে দেখতে যান।

মুক্তিযুদ্ধে বখতিয়ারুল আলমের মা নছুবা খাতুনের অবদান উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করতেন। বিশেষ করে মক্তিযোদ্ধারা যখন অপারেশন শেষ করে গভীর রাতে কোনো এক সময়ে আব্দুল মান্নান সওদাগর বাড়িতে আসতেন তখন তিনি নিজ হাতে তাদের রান্নাবান্না করে খাওয়াতেন। এমনকি তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা আসলে ঘুম থেকে জেগেও তাদের রান্নাবান্না করে খাওয়াতেন এবং যতটুকু তার পক্ষে সম্ভব তিনি তা দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতেন। আশেপাশে কোথাও পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যদের আগমন কিংবা রাজাকার আল বদর সদস্যদের উপস্থিতি টের পেলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে লুকিয়ে রাখতেন এবং অন্যত্র পালিয়ে যেতে সাহায্য করতেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম ১৯৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর বিয়ে করেন। কনে রুবি আক্তার, তাঁর বাড়ি ফটিকছড়ি থানাধীন দক্ষিণ ধুমপুরস্থ কানু তালুকদার বাড়ি। পাকহানাদার বাহিনীর চরম নির্যাতনে বখতিয়ারুল আলমের মুখের উপরের পাটির ৬টি দাঁত পড়ে যাওয়ায় বিয়ের সময় আলগা পাটি লাগানো হয়েছিল।

মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ারুল আলম দীর্ঘদিন যাবৎ দুরারোগ্য রোগে অসুস্থ থাকার পর ২০০০ সালের ৩ এপ্রিল তাঁর হার্টের স্ট্রোক হয়। তাঁকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলে একদিন অতিবাহিত হওয়ার পর ৫ এপ্রিল ২০০০ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা, সিনিয়র সাংবাদিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট