চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ফেনী নদীর পানি চুক্তি ভবিষ্যতের জন্য কৌশল?

নাওজিশ মাহমুদ

২০ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

ফেনী নদীর পানি চুক্তিকে কেন্দ্র করে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ায় বুয়েটে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ নামধারী তার কিছু সহপাঠী। যদিও ফেনী নদীর পানি চুক্তির বিরুদ্ধে আবরার ফাহাদের ফেসবুকে দেয়া মন্তব্যকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকা- তবু কেন জানি মনে হচ্ছে এটার পিছনে আরো বড় কোন রহস্য আছে, যা আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। আবরার ফাহাদের হত্যাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে ছাত্রলীগের মূল আদর্শের বাইরে গিয়ে যারা সন্ত্রাস করতো, নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল, তাদের রাজনীতি হয়তো বাধাগ্রস্ত হবে। শুধু ফেইসবুকের কারণে আবরারকে মেরে ফেলার বিষয়টি বিশ^াসযোগ্য মনে হচ্ছে না। তার সাথে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, র‌্যাবের ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান ও গ্রেফতার, অনেকের বাসা থেকে কোটি টাকার উদ্ধার প্রভৃতি কারণে রাঘব-বোয়ালরা নিজেদের বাঁচাতে, এই সকল অভিযানকে বাধাগ্রস্ত করতে কোন সুপরিকল্পিত দুরভিসন্ধি নেই তো? যারা হত্যা করেছে, তারা আবরারকে শিবির অপবাদে হত্যা করেছে। কিন্তু আবরার শিবির করে এই তথ্যটা কে সরবারহ করেছে? কেন করেছে, তা কোনদিন আমরা জানতে পারবো না। বুয়েটের মতো সেরা বিশ^বিদ্যালয়ে ভিন্নমত পোষণকারীকে খুন করার বিষয়টি বিশ^াসযোগ্য হচ্ছে না। বুয়েটের ছাত্ররা মেধাবী। বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা ঢাকা বিশ^^বিদ্যালয়ের আইবিয়েতে এবং বুয়েটে ভর্তি হয়। প্রধানমন্ত্রীর তড়িৎগতিতে খুনের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় জাতি ও রাষ্ট্র একটু স্বস্তির নিঃশ^াস ফেলেছে। ছাত্ররাও আন্দোলন করে ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের রাস্তা খুঁজছে। তবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের যে দাবী এবং বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মেনে নেয়াটা কোনটায় ভাল সিদ্ধান্ত হিসেবে মনে করার কোন কারণ নেই। এটা মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার অবস্থা হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি যে অর্থে আমরা বুঝি তা বর্তমানে চর্চা হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলি ছাত্রদের তাঁদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। আহমদ ছফার ভাষায়, ছাত্রসংগঠনগুলি রাজনৈতিক দলের শিশুশ্রমিক। বাম সংগঠন ও ইসলামী সংগঠনের ছাত্রসংগঠনের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি সত্য ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের বেলায়। ছাত্ররাজনীতির এই নৈরাজ্যের উৎস আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক দলসমূহ। আমাদের রাজনৈতিক দলে যদি গণতন্ত্র চর্চা না থাকে, অন্যের মতামতকে যদি শ্রদ্ধা করতে না শিখে, তা হলে ছাত্ররা কেন গণতান্ত্রিক আচরণ এবং অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে? তারা বুয়েটে ভর্তি হতে এসেছে ক্যারিয়ার গঠন করার জন্য।

বিরাট একটি অংশ হয়তো মেধা দিয়ে দেশ ও জাতিকে সেবা দিবে। বিরাট একটি অংশ চলে যাবে বিদেশে, আর একটি অংশ আমাদের দেশের সরকারী চাকুরীতে ঢুকবে। এদের একটি অংশের হাতেই আমাদের রাষ্ট্রের অর্থ লুটপাটের মহৌৎসব হয়। যদিও এর পৃষ্ঠপোষক আমাদের অসৎ রাজনীতিবিদ, অসৎ ব্যবসায়ী এবং অসৎ আমলারা। ছাত্ররাজনীতি আমাদের নৈতিকতা শিখাবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শিখাবে, দেশ ও জাতিকে ভালবাসতে শিখাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারিকুলামের বাইরে তথ্য ও জ্ঞান অনুসন্ধানে উৎসাহ যোগাবে। কোনটার চর্চায় তো নেই আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলোতে। ’৭১ এর আলবদর এবং ছাত্রশিবির (মুক্তিযুদ্ধের সময় নাম ছিল ছাত্রসংঘ) এর আচরণের কারণে পিটিয়ে মেরে ফেললে কী তাদের অপতৎপরতা রোধ করা যাবে। আতঙ্ক সৃষ্টি করে কী একটি মতাদর্শকে ধ্বংস করা যাবে। তাদের আরো উন্নত আচরণ, উন্নত আদর্শ এবং ভালোবাসা দিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাঁদেরকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে বুঝাতে হবে, তাঁরা ভুল পথে আছে। শিবির সন্দেহে পিটিয়ে মারা মানেই শিবিরকে আরো জনপ্রিয় হতে ও আরো বিস্তারে সহযোগিতা করা। তবে বিশ^বিদ্যালয়ে মুক্তচিন্তার দ্বার উম্মেচিত করতে না পারলে, চিন্তার বিকাশও রুদ্ধ হয়ে যাবে।

এবার মূল কথায় ফিরে আসি। আবরার ফাহাদ ফেনী নদীর পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলেও চুক্তির বিরোধীতা অনেকে করেছে। বিরোধী দল এবং অনেক বিশেষজ্ঞ এই নিয়ে হৈ চৈ করেছে। সবারই একই কথা বাংলাদেশ ভারতের কাছে মাথা নত করেছে। তিস্তার পানি না এনে ফেনী নদীর পানি দিয়ে এসেছে। চুক্তিটা করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে। কিন্তু এর ফায়দা বা সুবিধা নিবে কে? ত্রিপুরার অধিবাসীরা। যারা হয় আদিবাসী না হয় বাঙালি হিন্দু। যারা একসময়ের বাংলাদেশের ভূমিপুত্র ছিল। আমাদের পূর্বসূরীদের ভুল রাজনীতির খেসারতে দিচ্ছে। দ্বিজাতির তত্ত্বের বিষাক্ত ফল ভোগ করছে। বাংলাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্বকে অস্বীকার করেই জন্ম নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের চারিদিকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং ত্রিপুরায় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। হয়তো তারা হিন্দু ভারতীয় নাগরিক কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিচয় ওরা বাঙালি। বাঙালি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা বাঙলির সাথে একই আচরণ হবে সহমর্মিতার ভিত্তিতে। দ্বিজাতিতত্ত্বের দৃষ্টিভংগী থেকে মুসলিম জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভঙ্গী তাঁদের বিরোধীতা করা একেবারে ন্যায়সংগত। আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিভংগী একটু ভিন্ন। কারণ তত্ত্বের প্রতিক্রিয়ায় দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্ম। এই উভয়কে চ্যালেঞ্জ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান। সুতরাং আমরা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ভারতের সাথে অনেক বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করবো। বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিবো। এটাই স্বাভাবিক। এখানে ভারত বিরোধীতার নামে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার প্রচেষ্টা অধিকতর দৃশ্যমান। বিরোধীতাকারীরা ত্রিপুরার অধিবাসী আর রাষ্ট্রীয় স্বার্থের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে অক্ষম। এ অক্ষমতাকে কাটিয়ে উঠার জন্য দরকার মুক্তপরিবেশে আলোচনা এবং সমালোচনা।

যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি। মেরে ফেললে হিংসার বদলে হিংসা সৃষ্ট হবে। সমস্যার সমাধান হবে না। এই জন্য দরকার বিশ^বিদ্যালয়ে মুক্তচিন্তার চর্চার সুযোগ করে দেয়া। নতুবা চিন্তার বিকাশও রুদ্ধ হয়ে যাবে। ফেনী নদীর পানি চুক্তিটি আমি পড়িনি। বিস্তারিত জানি না। এই পানি ভারতে দিতে গেলে আমরা কি ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হবো, তা নিরূপণ করা হয়েছে কী না জানি না। এমনিতে ভারত ও বাংলদেশ সীমান্তে ফেনী নদীর পানি ওরা পাম্প বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চুক্তি না করলেও নিয়ে যেত। এটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আমাদের ভয়ের একটাই আশংকা, ফেনী নদী নাব্যতা হারাবে কী না অথবা সমুদ্রের লবণাক্ততা কতটুকু গ্রাস করবে তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে কী না? করে না থাকলে, যদি এই ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তা হলে একতরফা চুক্তি বাতিলের সুযোগ আছে কী না? সব জেনেই মূল্যায়ন করা যাবে এ চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে; এটা কি বাংলাদেশের কৌশল নাকি কূটনৈতিক ব্যর্থতা।

তবে এটা যদি কৌশল হয়। বাংলাভাষী ও বাঙালিদের শুভেচ্ছা স্বরূপ পানি দিয়েছে, তা হলে এটা অবশ্যই সুদূর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ পূর্বভারতের রাজ্যসমূহে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ যেমন আছে, তেমন রাজনৈতিক স্বার্থও আছে। তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো বাঙালি জাতীয়তাবাদের দৃষ্টি থেকে অবশ্যই করণীয়। এই ভালো আচরণের ফল অবশ্যই বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পুঁজি হিসেবে কাজে লাগবে। বাংলাভাষী বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতির বার্তাটি পৌঁছে দেয়া দরকার। তিস্তার পানি যদিও মমতার বিরোধীতায় আটকে আছে। তবু তিস্তার পানি উজানে সিকিম এবং বিহারের বাঁধের মাধ্যমে যে পানি নিয়ে যাচ্ছে, তা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের পানি দিতে মমতা ব্যানার্জি রাজনৈতিক কারণে বিরোধীতা করবে। তিনিও তো বাংলাভাষী এবং বাঙালি। আমাদের উচিত হবে তিস্তার ব্যাপারে মমতার আপত্তিকে কিভাবে নমনীয় করা যায়, তার উপায় বের করা।

আসামের নাগরিক তালিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন না হতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আশ^স্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এটি ইতিবাচক। তবে ভারতের বিভিন্ন মন্ত্রী উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। এটি বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। এসবের অবশ্যই আপত্তি জানানো উচিত। কিন্তু সরকারের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এই সীমাবদ্ধতার বাইরে কথা বলবে বিরোধী দল। বলবে আসামে যদি বাংলাদেশী নাগরিক থেকে থাকে তাহলে তাদের ফেরত দাও ভূমিসহ। অর্থাৎ বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাসহ তাদের ফেরত দিয়ে দাও। এটা সরকার বলতে পারবে না কিন্তু বিরোধী দলতো বলতে পারবে। কিন্তু বিরোধী দল এই ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ। শুধু সরকারী দলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের রাজনীতিবিদরা দেওলিয়াপনায় ভুগছে। তাঁদের এই দেওলিপনার শিকার হচ্ছে দেশ ও জাতি।

গ্যাস রপ্তানী নিয়েও প্রশ্ন আছে। এমনিতে আমাদের গ্যাস সংকট রয়েছে। সরকার থেকে বলা হচ্ছে এলপি গ্যাস রপ্তানী হবে। এলপি গ্যাসে কি আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ বা উদ্বৃত্ত? আমরা আমদানী করে আবার রপ্তানী কেন? বাংলাদেশের উপকুলে ভারতের রাডার স্থাপনের কারণে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা, তাও খতিয়ে দেখা দরকার। সরকারের উচিত চুক্তিসমূহ জনসমক্ষে প্রকাশ করা। যাতে বিতর্কের অবসান ঘটে।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া একটি রাষ্ট্রে জনগণ অবশ্যই প্রধান নিয়ামক শক্তি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের রাষ্ট্র উপনিবেশিক অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে পারে নি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর কোন সরকারই জনগণের উপর আস্থা রাখতে পারে নি। এখানে আমাদের সামষ্টিক ব্যর্থতা। ভারতে জনগণের মতামত না নিলেও বিরেধেী দলের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমাদের দেশে দায়িত্বশীল বিরোধী দল কখনও গড়ে উঠে নি। কারণ সরকারও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় না। জনগণও এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ। এখানেই আমাদের সংকট। গণতান্ত্রিক আচরণের সংকট। এই সংকট থেকে উত্তরণই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক
ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট