চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দার্শনিক-শিক্ষাবিদ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সান্নিধ্য আজো পরম স্মৃতি

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

১৭ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:০৭ পূর্বাহ্ণ

দেশবরণ্যে মণীষী দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বিগত ১৯৯৯ সালের ১ নভেম্বর ইন্তেকাল করেছেন। তাকে নিয়ে বিস্তারিত লেখার সুযোগ ও যোগ্যতা আমার কম। বাংলাদেশে তিনি এমন একজন জনপ্রিয় মণীষী ছিলেন যার জীবদ্দশাতেই বহুবার বেশ কিছু জাতীয় পত্র-পত্রিকা তাঁর ব্যক্তিত্ব ও জীবনীর উপরে বিশাল আকারে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। দর্শন সাহিত্য ও মুসলিম চিন্তা-চেতনার জগতে তিনি ইতিহাসে চির অমর হয়ে থাকবেন। তবু কেন জানি, আমরা একটি জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় মুখের মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু কথা না বললে তার ও তার ভক্তদের কাছে অপরাধী হয়ে থাকব।

হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন: উজকুরূ মাওতাকুম খাইরা’ – অর্থাৎ তোমরা তোমাদের মরহুমদের ভাল ভাল বিষয়গুলো স্মরণ কর। ১৯৮৭ সাল থেকে, ৯১ সাল পর্যন্ত আমি ঢাকায় অবস্থান করি। লেখাপড়া করতাম গাজীপুর ইসলামী ভার্সিটিতে। চট্টগ্রাম থেকে রাজধানীতে গিয়ে লেখাপড়া করার অন্যতম কারণ ছিল সমকালীন মণীষীদের সংশ্রব লাভ করা। তাই ঢাকা নগরীতে গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার-সিম্পোজিয়াম খুব কমই বাদ দিতাম। কারণ এসব অনুষ্ঠানে মূল বিষয়ের সাথে জ্ঞানবৃদ্ধ ও বয়োবৃদ্ধ মণীষী অধ্যক্ষ আবুল কাসেম, সওগাত সম্পাদক মুহাম্মদ নাসির উদ্দীন, দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ, সৈয়দ আলী ভ্রাতৃদ্বয় (আশরাফ ও আহসান), আশরাফ সিদ্দিকী প্রমুখের ঐতিহাসিক স্মৃতি কথাগুলো আমাকে বেশ আনন্দ দিত। আজ একে একে এদের সবাই পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। সে সময় পত্র-পত্রিকা অফিসেও আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এ সুবাদে বিভিন্ন দৈনিকের অফিসে মণীষী দেওয়ান আজরফের সাক্ষাৎ মিলত।
তিনি সুযোগ পেলেই পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক, সম্পাদকের কাছেই বসতেন। এ সময় দেখতাম তার প্রতি দেশের লেখক

সাংবাদিক ও উচ্চতর চিন্তাশীল মহলের ভক্তি ও শ্রদ্ধা কত বেশী। আল্লাহ মরহুম দেওয়ান আজরফকে জান্নাতের উচ্চ আসন দান করুন।

তাঁর কথাগুলো আমাকে বেশ প্রভাবিত করত। একবার ঢাকা প্রেস ক্লাবে নজরুলের উপর এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন: মণীষীদেরকে আমরা যদি মূল্যায়ন করি তবে তাদের অবদানকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে। তাদের ব্যক্তি জীবনের খুটিনাটি নিয়ে শুধু সমালোচনা করলে চলবেনা, ব্যক্তি জীবন নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুললে তাদের অনেক অবদান থেকে জাতি বিমুখ ও বঞ্চিত হবে। মণীষীদের মধ্যে কম-বেশী দোষত্রুটি থাকবেই। টেলেন্টদের কখনো বিচ্যুতি ঘটে, ধাঁরালো ব্লেড যেমন বাঁকা কাটে। বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে একটু একরোখা ভাব, অস্বাভাবিকতা থাকবেই। তা নিরবে মেনে নিতে হয়। উল্লেখ্য, কবি নজরুলের প্রেম ও বিয়ে শাদী বিষয়ক কিছু অপবাদ প্রসংগে তিনি এসব বক্তব্য রাখছিলেন। মরহুম আজরফ ছিলেন শতাব্দীর সাক্ষী। উপমহাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক উত্তান-পতনের কথা, প্রিয় কবি নজরুল, গোলাম মোস্তাফা, প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহিম খাঁ প্রমুখ নিয়ে তার স্মৃতিচারণগুলো বিভিন্ন সেমিনারে তরুণদের বিমোহিত করতো। কারণ, এ উপমহাদেশের রাজনীতি, সাহিত্য ও দর্শনের মূল স্রােতধারায় ছিল তাঁর সক্রিয় অবস্থান।

দৈনিক পূর্বকোণ-এর সূচনালগ্ন থেকেই এতে লেখালেখির সাথে আমি সম্পৃক্ত। মাঝখানে কয়েক বছর ঢাকায় থাকলেও পূর্বকোণে লেখা বাদ যায়নি। কয়েক মাস পরপর চট্টগ্রামে আসলে শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আবুল মোমেন, শিশিরদা, বিশ্বজিত চৌধুরী প্রমুখ আমাকে সাবজেক্ট ঠিক করে দিতেন আর সে মতে ঢাকা থেকে লিখতাম। ১৯৯০ সালের শেষ দিকে শিশির দা, (পূর্বকোণের তৎকালীন ফিচার সম্পাদক) ও বিশ্বজিত চৌধুরী আমাকে ঢাকার কয়েকজন মণীষীর চট্টগ্রাম সম্পর্কে স্মৃতিচারণমূলক ইন্টারভিউ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফ, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ।

আমি প্রথমেই দেওয়ান আজরফকে টার্গেট করি। টেলিফোনে তার সাথে কথা বলি। হাতে পূর্বকোণ পৌঁছাই। সেদিন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বকোণ-এর গেট আপ, মেক-আপ দেখে তিনি পুলকিত হন এবং এতে লেখা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে, ‘চট্টগ্রামে তার প্রথম আগমনের উপর’ স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি প্রদান করেন। এ সুবাদে আমি কয়েকবার তার ঢাকা চামেলী, টিডি রোডস্থ ৩২৫/২, পূর্ব রামপুরা বাসায় যাই। প্রথমে যেদিন তার বাসায় যাই, তাদের পরিবারের একজন সদস্য (নাম জানা নেই, সম্ভবতঃ নাতি স্তরের কেউ হবে) আমাকে দু’তলায় শ্রদ্ধেয় আজরফ সাহেবের ব্যক্তিগত পড়ার রুমে নিয়ে গেল। সদা বিনয়ী, বয়সের বাড়ে ন্যূব্জ সাধক আজরফ সাহেব আমাকে পরম ¯েœহে ডেকে পাশে বসালেন। একজন শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও সাহিত্যিক-এর পাঠকক্ষটি তার ব্যক্তি জীবনের মতোই একেবারে সাদাসিধে, স্বল্প পরিসর। কক্ষটির প্রায় সবটুকু অংশ জুড়ে শুধু বই আর বই। বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্র-পত্রিকার প্রয়োজনীয় সংগ্রহ। শোবার খাটিয়াটির একপাশে সাড়ে তিন হাতের মত জায়গা ছাড়া অবশিষ্ট অংশটিও বই-পত্র দখল করে আছে। – (আগামী বৃহস্পতিবার সমাপ্য)।

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক কলামিস্ট,
টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট