চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

অনলাইন টিকেটে রেলের বারোটা!

হ মাসে ২০ কোটি টাকার টিকিট বিক্রি রেল পায় ১০ কোটি টাকা হ টিকিট প্রতি বাড়তি ২০ টাকা থেকে মাসে লোপাট দেড় কোটি টাকা

আল-আমিন সিকদার

২৩ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:২২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচলিত একটি কথা আছে, ‘সাত-পাঁচ চৌদ্দ, দুই টিয়া নয়দ্দো। আঞ্চলিক এ কথাটির অর্থ দাঁড়ায়, ‘চৌদ্দ টাকার হিসাব গড়মিল করে বারো টাকা দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া’। এ বাক্যটির মতোই বাংলাদেশ রেলওয়ের আয় থেকে প্রতিমাসে প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সিএনএস’। রেলওয়ের টিকেটিং সেবা সহজীকরণ করতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সিএনএস’ এর সাথে চুক্তি হয় বাংলাদেশ রেলওয়ের। প্রথমদিকে কম্পিউটার সেন্ট্রাল সিট রিজার্ভেশন টিকেটিং সিস্টেম (সিসিএসআরটিএস) এর ভিত্তিতে কাজ শুরু করে সংস্থাটি। চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেটিং সিস্টেমে অনলাইন যুগের সূচনা করে সংস্থাটি। তাদের নিজস্ব তৈরি এপস্ এর মাধ্যমে ই-টিকেট বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যাত্রীদের সুবিধার্থে প্রতিদিন মোট টিকেটের ৫০ শতাংশ টিকেট দেয়া থাকে অনলাইন এপস্ এ। আর এ ৫০ শতাংশ টিকেটকে পুঁজি করে প্রতিমাসে রেলের আয় থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে সংস্থাটি।

রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বছরে রেলের টিকেট সংখ্যা ১ কোটি ৯৬ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০টি। যে সিটের বিনিময়ে রেল বছরে আয় করেছে ৪৭৭ কোটি ৯৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৪৪ টাকা। যেহেতু নিয়ম অনুযায়ী মোট টিকেটের অর্ধেক অংশ অর্থাৎ বছরে ৯৮ লাখ ১৮ হাজার ১৬০টি টিকেট বিক্রি হবে অনলাইন এপস এর মাধ্যমে। সে অনুযায়ী বছরে অনলাইন থেকে রেলের আয় হবে ২৩৮ কোটি ৯৭ লাখ ১৫ হাজার ৩২২ টাকা। মাসে অনলাইন এপসের ৮ লাখ ১৮ হাজার ১৮০টি টিকেটের বিনিময়ে আয় হচ্ছে ১৯ কোটি ৯১ লাখ ৪২ হাজার ৯৪৩ টাকা। তবে অনলাইন এপস্ চালু হওয়ার পর প্রতিমাসে একই টিকেট বিক্রি করে রেলওয়ের কোষাগারে মাত্র ১০ কোটি টাকা করে জমা দিয়েছে সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, প্রতিটি অনলাইন টিকেট সংগ্রহ করতে যাত্রীদের গুণতে হয় অতিরিক্ত ২০ টাকা। তবে টিকেটের কোথাও এ ২০ টাকা উল্লেখ থাকে না। টিকেট প্রতি প্রাপ্ত এ ২০ টাকা থেকে ৪ টাকা যায় সরকারি বিটিআরসি ও বিকাশ-ব্যাংক খাতে যায় ৪ টাকা। বাকি ১২ টাকা থেকে যায় সিএনএস এর কাছে।

যেখান থেকে মাসে ৯৮ লাখ ১৮ হাজার ১৬০ টাকা আয় করে সংস্থাটি। তবে এ টাকার কোন অংশই যায় না রেলের কোষাগারে।
এছাড়াও অনলাইন টিকেটের কারণে ভোগান্তিতে পড়ার অভিযোগও করেছে যাত্রীদের। যাত্রীদের অভিযোগ, ‘প্রতিটি ট্রেনের অগ্রিম টিকেট দেয়া হয় নির্ধারিত দিনের ১০ দিন পূর্বে। অনলাইনের পাশাপাশি কাউন্টার থেকেও দেয়া হয় অগ্রিম টিকেট। তবে এপস এ ৫০ শতাংশ টিকেট থাকায় কাউন্টারে চাহিদা অনুযায়ী টিকেট থাকে না। বেশিরভাগ মানুষই কাউন্টার থেকে টিকেট কিনতে যায় তবে টিকেট থাকে না। অন্যদিকে এপস এ থাকা টিকেট বিক্রি না হলে ৫ দিন পর কাউন্টারে ফিরে আসলেও তা অবিক্রিত থেকে যায়। কারণ, একজন যাত্রী নির্ধারিত দিনের টিকেট না পেলে সে পাঁচ দিন পর আর পুনরায় কাউন্টারে যায় না। তবে অনলাইন এপস এর টিকেট সাধারণ যাত্রীরা না পেলেও কালোবাজারিরা ঠিকই সংগ্রহ করে ফেলে। এতে সাধারণ যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়ে’।

রেলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, নিজস্ব কোন প্রোগ্রামার না থাকায় বিভিন্ন খাতে ব্যয় দেখিয়ে মাসে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংস্থাটি। তারা জানান, বাংলাদেশের সবচেয় সম্পদশালী সংস্থা রেল। আর এ রেলকেই অনলাইনের জন্য ভর করতে হচ্ছে বেসরকারি সংস্থার ওপর। রেল চাইলেই নিজস্ব অর্থায়নে অনলাইন এপস এবং তা পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে পারে। এতে প্রতি মাসে আর অন্যের পাঠানো টাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না রেলওয়েকে। কারণ, প্রতি সপ্তাহের অনলাইন এপস এর মাধ্যমে বিক্রিত টিকেটের দাম ১০ দিন পর পর রেলওয়েকে দেয় বেসরকারি সংস্থাটি। আর সেখানেই নানা খাতে ব্যয় ও হিসেবে গড়মিল করে রেলের কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। এতকিছু জানার পরেও রেলের নিশ্চুপ থাকার পেছনে হয়ত অনেক কারণও রয়েছে। তবে চাইলে এ লোকসান থেকে ফিরে আসতে পারবে রেল বলে মন্তব্য করেছেন তারা।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা এস এম মুরাদ হোসেন পূর্বকোণকে বলেন, ‘অনলাইন টিকিট প্রতি বাড়তি ২০ টাকা থেকে যে আয় হয় তার কোন অংশই রেলওয়ের রাজস্বে যুক্ত হয় না। এই টাকা কোথায় যায় তা শুধুমাত্র বলতে পারবে অনলাইন এপস পরিচালনাকারী বেসরকারি সংস্থা সিএনএস। এছাড়া টিকিট বিক্রির টাকা ফাঁকির যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন সে বিষয়ে আমি তেমন কিছু জানি না। মূলত এপস্ এ ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রি করার কথা থাকলেও এপস্ এ যায় ৪০ শতাংশ টিকিট। এখান থেকে অনেক সময় অবিক্রিত থাকা টিকিটগুলো পাঁচদিন পর পুনরায় কাউন্টারে ফেরত আসে। তারা টিকিট বিক্রির যে হিসেব দেয় সে অনুযায়ী টাকাও দেয়। তবে অনলাইনে টিকিট বিক্রির মোট ফলাফল তারই হিসাব করে। তবে সামনে এপস থেকে শুরু করে সকল অনলাইন পরিচালনা করবে রেল। খুব শীঘ্রই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এতে করে টিকিট বিক্রির সকল টাকা রেলের কোষাগারেই জমা পড়বে।’

এছাড়া টিকিট কাটা নিয়ে যাত্রীদের দুর্ভোগের বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘অগ্রিম টিকিটগুলো একসাথে অনলাইন ও কাউন্টারে ওপেন করা থাকলে যাত্রীরা স্টেশন ও এপস দুটোর মাধ্যমেই সংগ্রহ করতে পারবে। এ বিষয়টি নিয়েও আমরা রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি।’

এদিকে টাকার ঘাটতি ও রেল সম্পদ লুটের বিষয়ে জানতে বেসরকারি সংস্থা সিএনএস এর মহা ব্যবস্থাপক শামিমের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি প্রতিবেদকের কল রিসিভ করেননি। পরে তার মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোন উত্তর আসেনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট