চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

ঘরমুখো মানুষকে পৌঁছে দিয়ে রাস্তায়ই ইফতার সারেন তারা

মরিয়ম জাহান মুন্নী

৩০ মার্চ, ২০২৩ | ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ

‘সারাদিন ভালো আয় হয় না। ইফতারের আগমুহূর্তে ভালো আয় হয়। তাই রোজা রেখেই ভাড়া মারি।’ মুখের ঘাম মুছতে মুছতেই কথাগুলো বলছিলেন রিকশাচালক দাউদ মিয়া। তিনি নগরীর ২ নম্বর গেট এলাকা থেকে ৬০ টাকায় ভাড়া নিয়ে আসেন এখানে। ভাড়া চুকিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যান রিকশাযাত্রী। গত সোমবার ইফতারের আগ মুহূর্তে নতুন চান্দগাঁও থানার সামনে রাস্তার ধারে বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। শুধু দাউদ মিয়া নন, নগরীতে প্রতিদিন শত শত রিকশা-ট্যাক্সি চালকসহ বিভিন্ন পরিবহন শ্রমিকেরা রোজাদারদের পৌঁছে দেন বাসাবাড়িতে। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে মিলেমিশে ইফতার করতে। কিন্তু সেই পরিবহন শ্রমিকেরা ইফতার সারেন ফুটপাতে, রাস্তার ধারের টং ও ঝুঁপড়ি দোকানে। পরিবার-পরিজনদের দূরে রেখে। ভালো আয়ের আশায় ইফতারের আগ মুহূর্তে ঘরমুখো মানুষদের বাড়িতে পৌঁছে দেন তারা। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসায় কথা বলায় আগ্রহ নেই দাউদ মিয়ার। ভাড়ার টাকা গুণে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে পকেটে ভরেন তিনি। কোমর থেকে মোবাইল ফোন বের করে সময় দেখে নিলেন। দেখলেন ইফতারের সময় বাকি রয়েছে আর মাত্র ১১ মিনিট। তারপরও ভাড়া ধরার ইচ্ছে ছিল তার। তিনি বললেন, পথে-ধাটে ইফতার করতে হয়। তাই চার-পাঁচটি খেজুর গুঁজিয়ে রাখি। আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ইফতার সেরে নিতে পারি।

 

দাউদ মিয়ার বাসা শেরশাহ বাংলা বাজার এলাকায়। ভাড়া নিয়ে ছুটেন এদিক-ওদিক। কথা বলার ফাঁকেই ঘনিয়ে এল ইফতারের সময়। দু-এক মিনিটের মধ্যেই আজানের ধ্বনি ভেসে আসার অপেক্ষা। রিকশাটা রাস্তার ধারে রেখে ঢুকে পড়লেন ফুটপাতের একটি দোকানে। ইফতারের সাইরেন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পকেটে থাকা খেজুর আর দোকানের ছোলা, পেয়াজু, বেগুনি দিয়ে ইফতারি সারলেন তিনি।

 

একই সময়ে ইপিজেড থেকে ভাড়া নিয়ে ওই স্থানে আসলেন ট্যাক্সিচালক মনির আহমদ। ভাড়া চুকিয়ে দ্রুত বাসার পথ ধরলেন ট্যাক্সিযাত্রী। ইফতারের সময় আছে আর দু-এক মিনিট। গত্যন্তর না দেখে তিনিও ঢুকে পড়লেন ওই দোকানে। খাজা ঝাল বিতানে। বেঞ্চ পেতে বসলেন। রাস্তার ধারে পাতা বেঞ্চে চাপাচাপি করে বসলেন আটজন। তাদের সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। রিকশা ও ট্যাক্সিচালক।

 

দোকানি মো. কাউছার ও তাঁর সহকারী তাড়াহুড়ো করে সবার পাতে পাতে ইফতারির প্লেট পৌঁছে দেন। অপেক্ষা করছেন সাইরেন বাজানো বা আজানের। কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বললেন, প্রায়শই ফুটপাতে ইফতার সারতে হয় তাদের। পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ইফতার করার ভাগ্য তাদের কমই জোটে।  ওই ঝাল বিতানে প্রতি প্লেট ইফতারির দাম ৫০ টাকা। প্লেটে রয়েছে ছোলা, দুইটা খেজুর, একটা জিলাপি, দুইটা বেগুনি, দুইটা আলুর চপ, দুইটা পেয়াজু, মুড়ি। দেওয়া হয় এক গ্লাস সরবতও। দোকানে ছিল না হালিম, ফিরনি, পায়েস, চিকেন, মাটন হালিম বা অন্য কোনো দামি খাবার। ততক্ষণেই মসজিদের মাইকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি। তৃপ্তি ভরে ইফতার শুরু করলেন তারা।

 

দাউদ মিয়া বললেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম বাড়তি। দিনের আয় রোজগার দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। ইফতারের আগ মুহূর্তে রাস্তায় মানুষের ভিড় বেড়ে যায়। তখন ভাড়া ভালো হয়। কিছুটা রোজগার হয়। তাই সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের মায়া ছেড়ে রাস্তার ধারে ইফতার করি।’ তিনি বলেন, বাড়তি টাকা পেলে ছেলে-মেয়েদের মুখে কিছুটা ভালো খাবার দিতে পারবো। ঈদে একটা জামা কিনে দিতে পারবো। সেই আশায় রোজা রেখে কষ্টসাধ্য কাজটি করতে হয়।

 

আরেক রিকশাচালক ইলিয়াস বলেন, ‘আমিসহ চার জনের পরিবার। গ্রামে বাবা-মা ও একটি বোন আছে। আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সারাদিনে যা আয় হয়, ইফতারের আগ মুহূর্তে তারচেয়ে ভালো আয় হয়।’ তিনি বললেন, ‘ঈদে বাচ্চাদের নতুন পোশাক কিনে দিতে হবে। মা-বাবা ও বোনের জন্য নতুন কাপড় কিনতে হবে। তাই রোজা রেখে কঠিন কাজটি করতে হয়।’

 

ট্যাক্সি চালক মনির বলেন, ‘যাত্রীরা ভাবেন ভাড়া বেশি, আমাদের অনেক লাভ হয়। অথচ সারাদিনের আয় দিয়ে মালিকের জমা ও অন্যান্য খরচ পোষাতে পারি না। ভালো খাবার জুটে না। কারণ বাজারে সবকিছুরই দাম বাড়তি। তবে ইফতারের আগে ভাড়ায় ভালো রোজগার হয়। অফিস বা ঈদ বাজার থেকে সবাই বাসাবাড়িতে ছুটতে তাড়াহুড়ো করেন। তাই কষ্ট হলেও এই সময় ভাড়া মারি।’

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট