চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

দেড় দশকে ৩৬ সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি

১১ জুন, ২০২২ | ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

 

চট্টগ্রামের নামকরণের ইতিহাসে ‘পাহাড়ের’ নাম জড়িয়ে রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় ৬শ বছর আগে হযরত বদর শাহ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে আগমন করেছিলেন। চেরাগী পাহাড়ে জিনপরীদের তাড়িয়ে চট্টগ্রামকে আবাদ করেছিলেন। পাহাড়-সাগর-নদী ঘেরা শৈলকিরীটিনী চট্টগ্রামের সেই পাহাড় এখন নিঃশেষ করে চলেছে মানুষই। আর সেই বিপন্ন প্রকৃতি পরিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে মানুষের ওপরই।
২০০৭ সালের ১১ জুন লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসে মারা গিয়েছিলেন ১২৭ জন। একই সময়ে আরও আট স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছিল।
এ পাহাড় ধসের পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে গঠন করা হয়েছিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম একটি কারিগরি রিপোর্ট প্রদান করেন। পরিবেশ অধিদপ্তরও একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছিল।
তদন্ত কমিটিগুলো ভূমিধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করেছিল। এবং পাহাড় সুরক্ষায় ৩৬ সুপারিশমালা প্রদান করেছিল। পাহাড়ধসের ঝুঁকি কমাতে এবং পাহাড় রক্ষায় দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এই ১৫ বছরে একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি প্রফেসর ড. ইদ্রিস আলী পূর্বকোণকে বলেন, সরকারি আমলা আসে আর যায়। কিন্তু ১৫ বছরে ৩৬ সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সরকারি কর্মকর্তাদের পেশাদারিত্ব ও দায়িত্ববোধ থাকলে ১৫ দিনেই এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যায়। শুধু বৃষ্টি হলেই মাইকিং করা হয়, পাহাড় পাদদেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসরতদের সরিয়ে আনা হয়। মানুষের জীবনকে নিয়ে এ ধরনের প্রহসন বন্স না হওয়া পর্যন্ত পাহাড় ও পরিবেশ রক্ষা হবে না। যার নজির দেখলাম রাঙামাটিতে। ২০১৭ সালে ভয়াবহ পাহাড় ধসে ১২০ জনের প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটবেই।’
ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পাহাড় কাটা শুরু হয়। পাহাড় কেটে বানানো হয় বাংলো, অফিস-আদালত। পাকিস্তান আমলেও পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরও পাহাড় কাটা থেমে নেই। ‘৯০ এর দশকের থেকে পাহাড়কাটা রীতিমতো মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় কেটে বসতি গড়ে ওঠেছে। নির্মাণ করা হয় নানা স্থাপনা।
সরেজমিন দেখা যায়, মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, আকবর শাহ, অক্সিজেনসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড়কাটা চলে আসছে। জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতা দাপট দেখিয়ে পাহাড় দখল ও পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে আসছেন।
জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘পাহাড়ে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ থাকায় নিম্ন আয়ের লোকজন মৃত্যুকূপে বসবাস করে আসছেন।’
২০১৩ সালে পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয় বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিঙ্ক রোড। সেই লিঙ্ক রোড ঘিরে এখন পাহাড় দখল ও পাহাড় কাটার মহোৎসব চলে আসছে।
এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৬০ সালে নগর ও আশপাশে ২০০টি ছোট-বড় পাহাড় ছিল। বেশির ভাগ পাহাড়ের মালিক সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। ৫৭ শতাংশ পাহাড় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথক দুটি গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া যায়।

পাহাড়ধসের ২৮ কারণ 

ভূমিধসে চিহ্নিত ২৮ কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল : ভারী বর্ষণ, পাহাড়ে বালির আধিক্য, পাহাড়ের উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস গড়ে তোলা, পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটি অপসারণে দুর্বলতা ইত্যাদি।

ধস ঠেকাতে ৩৬ সুপারিশ

৩৬ সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল : পাহাড়ে জরুরিভাবে বনায়ন, গাইড ওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, বসতি স্থাপনাসমূহ টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না দেয়া, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনা নিষিদ্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির বিভিন্ন সভায় কার্যবিবরী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ১৭ পাহাড় চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পাহাড়ে ৮৫৩ পরিবার ঝুঁকিতে আছে বলে হয়। নগরীর মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ের পাদদেশে ৪-৫ তলা ভবনও রয়েছে। পাহাড়ের মালিক জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ে। কিন্তু কোনো সংস্থাই পাহাড়-জমির লিজ দেয়নি। অবৈধভাবে দখল করে প্রভাবশালীরা বস্তিঘর তৈরি করে ভাড়ায় দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের পর থেকে গত ১৫ বছরে অন্তত দুইশ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট