চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

জ্ঞানের আলো ছড়াতে পাঠকের দ্বারে দ্বারে

১৭ মে, ২০২২ | ৫:৩৬ অপরাহ্ণ

মরিয়ম জাহান মুন্নী

লালখান বাজার মোড়ে বইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন কাপাসগোলা মহিলা কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাদিয়া ও তার মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গাড়িটি। যথাস্থানে গাড়িটি পার্কিং করা হলে মা-মেয়েসহ জাফরুল্লা চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি ছুটে আসেন গাড়ির কাছে। হাতে থাকা আগের পুরাতন বই ফেরত দিয়ে আবার নতুন বই নিতে তাদের এই অপেক্ষা। তিনজনেই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করেছেন পছন্দের কিছু নতুন বই।

গ্রাহক কম হওয়ায় এই স্পট থেকে দ্রুতই ভ্রাম্যমাণ গাড়িটি ছুটে যায় নতুন গন্তব্য সিআরবি’র শিরীষতলায়। এভাবেই ২২ বছর ধরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানে জ্ঞানের আলোর মশাল নিয়ে নিরন্তর ছুটে চলছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বয়স্ক নারী-পুরুষ সবার হাতেই তুলে দিচ্ছেন নানা রকমের বই।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, পাঠকের মধ্যে পড়ার অভ্যাস তৈরি করতেই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিটি ছুটে চলছে নগরীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। লাইব্রেরির ভেতরে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানারকম বই। চট্টগ্রাম নগরীতে বিশ্বসাহিত্যের দুটি ভ্রাম্যমাণ গাড়ি বইপ্রেমীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এই দুই গাড়ির ছোটটিতে ৬ সহস্রাধিক এবং বড় গাড়িটিতে ১৬ সহস্রাধিক বই রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ ভ্যানদুটিতে শিশুদের গল্পের বই, সায়েন্স ফিকশনসহ কার্টুনের বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, জীবনীগ্রন্থ, ভ্রমণ কাহিনী, অনুবাদ, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, খেলাধুলাসহ নানারকমের বই। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গাড়িটি বিকেল পাঁচটা সিআরবির শিরীষতলায় এসে দাঁড়াতেই কলেজের কিছু শিক্ষার্থী ও কয়েকজন বাবা মায়ের সাথে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থী ছুটে আসেন গাড়ির সামনে। এখানে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দেখা যায় রূপকথার গল্প ও সায়েন্স ফিকশনের বইগুলো। হৈ-হুল্লোড় করে আনন্দের সাথে রবিন, নাইম, নাফিজা, ফাহমিদা ও তারিন কয়েকজন বন্ধু মিলে বই সংগ্রহ করেন।

ভ্রাম্যমাণ ভ্যান থেকে বই সংগ্রহ করতে আসা রোজীনা আফরোজ তান্নি নামের ৭ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা স্কুল শিক্ষিকা মেহেরুন বেগম বলেন, মেয়ের পড়ার আগ্রহ জন্মাতে প্রায় এখান থেকে বই নিতে আসি। আজও এসেছি নতুন কিছু বই নিতে।

ফাহমিদা ও তারিন জানায়, তিন বছর ধরে এ লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়ছি। এখানে যে বেশি বই পড়তে পারে তাকে অনেক সময় পুরষ্কৃত করা হয়। বই নিতে আমাদের ফেরতযোগ্য ১০০ টাকা দিয়ে সদস্য হতে হয়েছে। একটি বই পড়া শেষ হলেই সেটা জমা দিয়ে আরেকটা বই নিয়ে যাই। তবে মাঝেমধ্যে কিছু নতুন বই খুঁজলে পাওয়া যায় না এটাই একটু সমস্যা।

খবর নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। তবে চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে ২০০১ সালের মে মাসে। সারাদেশে ২৯টি গাড়ির মাধ্যমে চট্টগ্রামে আছে দুইটি। চট্টগ্রামে বর্তমানে দুই লাইব্রেরিতে সদস্য আছে ৩১ হাজার ২০৯ জন। এরমধ্যে অধিকাংশই শিক্ষার্থী। তবে চট্টগ্রামে মেয়েদের বই পড়ার আগ্রহ বেশি দেখা যায়। এছাড়া চাইলে যে কেউ সদস্য হতে পারবে। ১০০ টাকা জমা দিয়ে সাধারণ সদস্য ও ২০০ টাকা জমা দিয়ে বিশেষ সদস্য হতে পারবে। সদস্য হওয়ার পর মাসে ১০ টাকা করে চাঁদা দিতে হবে।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চট্টগ্রাম ইউনিটের কর্মকর্তা মো. মাসুদ আলম বলেন, চট্টগ্রামে আমাদের দুটি গাড়ি আছে। এ দুই গাড়ির মধ্যে বড় গাড়িতে আছে ১৬ হাজারেরও বেশি বই। আর ছোট গাড়িতে আছে ছয় সহস্রাধিক বই। দুইটি গাড়ির মধ্যে বড় গাড়িটি শহরে এবং ছোট গাড়িটি শহরের পাশাপাশি পটিয়া ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সপ্তাহে একদিন করে যায়।

চট্টগ্রামে পুরুষদের চেয়ে নারীদের বই পড়ার আগ্রহ বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্রাহকের আগ্রহের তুলনায় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কম। চট্টগ্রামে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কিছু গাড়ি সামনে বাড়তে পারে। যেগুলো চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোতে দেয়া হবে।

প্রতি বছর বই মেলা শেষে লাইব্রেরিতে নতুন বই যোগ করা হয়। চট্টগ্রাম শহরে সপ্তাহে ছয়দিন বই পাওয়া যায় ৪০টি স্পটে। এরমধ্যে শুক্রবার পাথরঘাটা গির্জার দক্ষিণ পাশে, ফিরিঙ্গি বাজার, সদরঘাট রোডসহ আরো কিছু স্পটে। শনিবার সরকারি পলিটেকনিক্যাল কলেজ, রউফাবাদ সরকারি শিশু পরিবার, বালুচরা, অক্সিজেন, লালখান বাজার ও সিআরবি। মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি সময়গুলো মানুষের কাছে বই পৌঁছে দিচ্ছে এ লাইব্রেরি।

তবে কর্মকর্তা মো. মাসুদ আলম বলেন, বই পৌঁছে দিতে গিয়ে প্রায়ই কিছু সমস্যায় আমাদের পড়তে হয়। অনেকে বই নিয়ে আর ফেরত দিতে আসেন না। অনেকে আবার বিভিন্ন কারণে শহর ছেড়ে অন্য শহরে চলে যায়। তখন এ বইগুলো আর পাওয়া যায় না।

জানা যায়, লাইব্রেরির মাধ্যমে বইপড়ায় উৎসাহ যোগানোর পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের রয়েছে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা। লাইব্রেরির সদস্যদের নিয়ে রচনা, বির্তক, চিত্রাংকন, সুন্দর হাতের লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ, রক্তদান, ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্টস্থানে ফেলা এবং ইভটিজিং বিরোধী জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পালন করা হয়।

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট