চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘শেকড় থেকে শিখরে’ মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে কেএসআরএম

১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:৫৭ অপরাহ্ণ

মিজানুল ইসলাম

 

কেএসআরএম কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের একটি স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৪ সাল থেকে গুণগতমান, সঠিক ওজন ও নির্ধারিত সময়ে সরবরাহের নিশ্চয়তার মাধ্যমে সারা দেশে মানুষের আস্থা ও আগ্রহই কেএসআরএমকে বিশ্বমানের ডিফর্মবার উৎপাদনে প্রেরণা যুগিয়েছে। অবকাঠামোগত ধারাবাহিক উন্নয়ন ও সরকারের ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সাথে সম্প্রসারিত হচ্ছে ইস্পাত শিল্পের বাজার। কেএসআরএম সেই সম্প্রসারিত ইস্পাত শিল্পের অন্যতম যোগানদাতা।
ইস্পাত শিল্প একটি প্রাচীন শিল্প। যা যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। যা এখনো চলমান। ইস্পাত এখন অনেক বেশি পরিশোধিতভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। কম বিদ্যুৎ, পানি ব্যবহার করে কীভাবে উৎকৃষ্টমানের ইস্পাত তৈরি করা যায় সেই বিষয়ে প্রতিনিয়ত চলছে গবেষণা। আর পরিবেশের বিষয়টিও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বর্তমানে। ইস্পাত উৎপাদনে কীভাবে পরিবেশের ক্ষতি কমানো যায় সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে সবার আগে।
বর্তমান সরকারের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও সাহস যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে একের পর এক উন্মোচিত হয়েছে নতুন নতুন সম্ভাবনা। নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কোটি মানুষের স্বপ্নের সেতু ‘পদ্মা সেত’ু নির্মাণ এখন শেষের পথে। যার গর্বিত অংশীদার কেএসআরএম। এটি নিঃসন্দেহে গর্বের ও আনন্দের। এই সেতুতে প্রথম স্টিল হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পথ সহজ ছিল না। এমবিইসি, সিআরইসি, ব্রিজ কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ আর্মি, বাংলাদেশ রেলওয়ের এবং বুয়েট থেকে আমন্ত্রিত টেকনিক্যাল টিম কেএসআরএমের ফ্যাক্টরির আধুনিক প্রযুক্তি, উৎপাদন সক্ষমতা, সঠিক মানদণ্ড অনুসরণ এবং দ্রুত সরবরাহের আধুনিক ব্যবস্থা সম্বলিত বিষয়াদি বিবেচনায় সন্তুষ্ট হয়ে প্রথম স্টিল সরবরাহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচিত করে। এটি অবশ্যই কেএসআরএম পরিবারের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে এবং এটি কেএসআরএমের পথ চলাকে আরো গতিময় করে নতুন বাংলাদেশ গড়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কেএসআরএম ৩৬ বছরেরও অধিক সময় ধরে ইস্পাত শিল্পে অবদান রেখে আসছে। এ দীর্ঘসময়ে সঠিক মানদণ্ড অনুসরণ করে রড সরবরাহ করে অর্জন করছে কোটি মানুষের আস্থা। শুধু তাই নয়, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বড় বড় স্থাপনাতেও ব্যবহৃত হচ্ছে কেএসআরএমের রড। অগুনিত মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনে রয়েছে কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয়। এসব হলো- আধুনিক প্রযুক্তি এবং গুণগত মানদণ্ড অনুসরণ করে রড উৎপাদন, নিজস্ব পরিবহনে সঠিক সময়ে রড ভোক্তার কাছে পৌঁছানো, দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সাইজ, দৈর্ঘ্য এবং গ্রেডের রড উৎপাদনের সক্ষমতা, সকল গ্রেডের রড উৎপাদন এবং নিজস্ব বিলেট থেকে রড উৎপাদন।
কেএসআরএম সবসময় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে অভ্যস্থ। আর তাই রড উৎপাদন প্রযুক্তিতেও পিছিয়ে নেই কেএসআরএম। শুরু থেকে কেএসআরএম Automated steel melting system চালু করি। বর্তমানে ইউরোপিয়ান Pomini প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ অটোমেটিক মেশিনে আধুনিক রি-রোলিং মিলে বছরে আট লাখ মেট্রিক টন রড উৎপাদন ও সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়াও Quality Scrap Collection ও সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করে EMS Process এর মাধ্যমে বিলেট উৎপাদন করে কেএসআরএম।
দেশের অন্যতম বৃহৎ ইস্পাত শিল্প প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় রড সরবরাহ করে আসছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু ছাড়াও আরো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রকল্প বা স্থাপনায় কেএসআরএমের রড ব্যবহার হয়েছে এবং হচ্ছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলো হচ্ছে- পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, পায়রা আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রথম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, গ্রেটার ঢাকা সাসটিনেব্যাল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প (বিআরটি-গাজীপুর-এয়ারপোর্ট), তৃতীয় শীতলক্ষা ব্রিজ, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ৪ লেইন প্রকল্প, মাতারবাড়ি আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা-খুলনা (এন-৮) সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন, কক্সবাজার, পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল প্রকল্প, লাকসাম আখাওরা রেললাইন প্রকল্প, দাসেরকান্দি সোয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ভেরামারা সিসিপিপি (৩৬ মেও) উন্নয়ন প্রকল্প, পূর্বাচল স্টেডিয়াম, গোপালগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট, কুমিল্লা ওভারপাস (ফ্লাইওভার), ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ইত্যাদি। এছাড়াও সমাপ্ত অসংখ্য প্রকল্পে কেএসআরএমের রড ব্যবহার হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
১৯৮৪ সাল থেকে শুরু হওয়া কেএসআরএম স্টিল প্লান্ট লিমিটেড মূলত কবির গ্রুপ-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান নামেই পরিচিত। উন্নত কাঁচামালের ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনে সচেষ্ট এবং সেই সাথে নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে কেএসআরএম। বুয়েটের মাধ্যমে পরীক্ষা করে উৎপাদন করা হয় ভূমিকম্প সহনশীল রড। এ কারণে কেএসআরএমের আলাদা ব্রান্ড ইমেজ তৈরি হয়েছে।
কেএসআরএম ইস্পাত শিল্পের একটি অতি পরিচিত নাম। সুদীর্ঘ সময়ের এই পথচলায় অর্জন করেছে মানুষের আস্থা। সমগ্র বাংলাদেশে কেএসআরএমের গতিময় যাত্রা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও বয়ে যাবে এই আশা রয়েছে।

আর তাই বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক আট লাখ মেট্রিকটনের অধিক করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেই সাথে ফ্যাক্টরির অবকাঠামো ও পরিবেশগত উন্নয়নসহ আধুনিক প্রযুক্তির স্থাপন করার পরিকল্পনাও আছে। পণ্যের উৎপাদনেও কিছু পরিবর্তন ও নতুন পণ্য আনার পরিকল্পনা রয়েছে। আবার রাউন্ড বার উৎপাদনের সাথে সাথে স্ট্রাকচারাল স্টিলের বাজার সম্প্রসারণেরও পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়াও আরও স্টিল Product যেমন Angle, Square Bar, Wire তৈরি করার পরিকল্পনা আছে।
বর্তমানে দেশে রডের চাহিদা রয়েছে। একটি টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাড়াতে হলে সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। ইস্পাত শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) তথ্যানুসারে দেশে বর্তমানে ইস্পাত শিল্পের বাজারের আকার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। যার বর্তমান পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টনের কাছাকাছি। বর্তমানে দেশের ইস্পাত খাতের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ৯০ লাখ টন। যদিও করোনা পরিস্থিতিতে তা ৩০-৩৫ লাখ টনে নেমে এসেছিলো। তবে সম্প্রতি উৎপাদন ক্ষমতা আবার বেড়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন শুরু হয়েছে পুরোদমে। এ খাতে উদ্যোক্তাদের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকা। তাই প্রয়োজন অর্থনৈতিক সহযোগিতা, জমি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান ও প্রকল্পের বাস্তবায়ন, নীরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কাস্টমস, ভ্যাট ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের ইস্পাত শিল্পবান্ধব সেবা প্রদান। এছাড়া প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা এবং স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান, বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও দ্রæত সময়ে পণ্য খালাসের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন ধরনের সরকারি শুল্ক ও কর হ্রাস করা এবং নতুন করারোপ না করা, পণ্য পরিবহনে ওজনের বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় প্রদান করা, Quality Assurance এর ক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি বাড়ানো, জি টু জি প্রকল্পের আওতায় মেগা প্রকল্পগুলোকে ট্যাক্স ও ভ্যাটের আওতামুক্ত করা এবং ওইসব প্রকল্পে বৈদেশিক মুদ্রায় সরবরাহকৃত পণ্যসমূহকে রপ্তানি হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। অন্যথায় এ শিল্পের কাক্সিক্ষত প্রসার সম্ভব নয়।
গত পাঁচ বছরে কেএসআরএম উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করেছে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে। এসবের মধ্যে আছে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে স্ক্র্যাপ বাছাই, দ্বৈত জ্বালানি চুল্লির ব্যবহার, আধুনিক এলআরএফ প্রযুক্তির সাহায্যে ইস্পাত পরিশোধন, ইএমএস মেশিনের সাহায্যে ইস্পাতের দুর্বলতা রোধ করা, স্বয়ংক্রিয় রোলিং মিল, টিএমটি প্রযুক্তির ইস্পাতের শক্তি বৃদ্ধি, উন্নত প্রযুক্তির স্পেকটেমিটার ও ইউটিএম সমৃদ্ধ অত্যাধুনিক ল্যাব, সয়ংক্রিয় বেল্ডিং মেশিন, পানি পরিশোধনের জন্য রয়েছে আধুনিক ডিএম প্ল্যান্ট এবং আরও প্ল্যান্ট। এছাড়া পরিবেশ দূষণের কথা মাথায় রেখে কেএসআএম বায়ু পরিশোধন ব্যবস্থা আরো উন্নত করা হয়েছে। যা কোনো ডাস্ট পার্টিকেল এবং দূষিত বায়ু পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া শতভাগ বোধ করে।
ইস্পাত শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এই শিল্পের বিকাশে। যা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরের নিরসনের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এসব সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভূমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির অপর্যাপ্ততা বা সংকট, বন্দর ও করনীতি, অর্থজোগান ও দক্ষ জনবল।
এসব সীমাবদ্ধতা ও সংকটের মাঝেও কেএসআরএম স্বপ্ন দেখি, এগিয়ে যেতে চায় বহুদূর। কেএসআরএমের ব্যবসার সবচেয়ে বড় শক্তি ও প্রেরণার জায়গা হচ্ছে পণ্যের গুণগত মান, নিজস্ব পরিবহনে দ্রুত সরবরাহের নিশ্চয়তা এবং সঠিক মান নিশ্চিতকরণ। মূলত এই কারণেই কেএসআরএম দেশের মানুষের একটি বড় ভরসার নাম। দেশের মানুষের আস্থাই হচ্ছে কেএসআরএমের সম্বল। এই শক্তিতেই ‘শেকড় থেকে শিখরে’ মন্ত্র নিয়ে কেএসআরএম এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের পথে।
কেএসআরএমের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, ‘বিগত তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিক ইস্পাত ব্যবসা এখন আমাদের পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিনের ঐহিত্য ধরে রাখার জন্য আমরা সবসময় চেষ্টা করি গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়টি। রডের মানের ক্ষেত্রেও আমরা আপোষ করি না। তাই দেশের কোটি কোটি মানুষের আস্থা অর্জন করেছে কেএসআরএম। আমরা তাদের আস্থা অটুট রাখার জন্য কাজ করছি নিরলসভাবে। রড উৎপাদনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানো হচ্ছে প্রায়শই। আমরা এই শিল্পের বিকাশে যেমন ভূমিকা রাখছি তেমন জাতীয় অর্থনীতিতে রাখছি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আমরা চাই এই শিল্পের আরও বেশি বিকাশ আরও বেশি সমৃদ্ধি। এক কথায় ইস্পাতে স্বনির্ভর বাংলাদেশ।’

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট