চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন

মালিকদের উপর বড় বোঝা

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ২:০০ অপরাহ্ণ

বেলায়েত হোসেন বেলাল

চট্টগ্রাম শহরে পরিবহন মালিকদের অবস্থা খুবই নাজুক। এখানে গত আড়াই বছর ধরে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। ২০২০-২০২১ পুরোটা সময় গণপরিবহন মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত। অথচ ওই সময়ে খাদ্য পরিবহনসহ বিভিন্ন মালামাল পরিবহনের যানবাহনগুলো জরুরি ভিত্তিতে চলাচল করেছে। গণপরিবহনের উপর তখন যে ধস নেমে আসে তা এখনো অব্যাহত আছে। শুধু করোনা মহামারী নয়। আরো কারণ আছে। চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। নির্মিত হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এসব কারণে সড়কের অবস্থা যানবাহন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচল করলে গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গর্তে পড়ে চ্যাসিস ভেঙে যায়। বডির নানা অংশ বেঁকে যায়। চেয়ার ভেঙে যায়। গাড়িগুলো নানামুখী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেকারণে একদিন রাস্তায় নামলে পরদিন ওই গাড়ি মেরামতের জন্য গ্যারেজে পাঠাতে হয়। এতে গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বেড়ে গেছে। আমরা শুনেছি ম্যাক্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ করছে। আমরা এও জানি যে, প্রকল্পের মধ্যেই সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বরাদ্দ করা আছে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণ করে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করছে না। প্রকল্পের পরিচালক সিডিএ’র কর্মকর্তাকে কীভাবে সন্তুষ্ট করছে জানি না। তবে বাস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যাত্রীরা কষ্ট পাচ্ছে। এমনকি সড়কে পানি পর্যন্ত ছিটাচ্ছে না। ধুলো-বালির কারণে সড়ক দিয়ে চলাচল করা দায় হয়ে পড়েছে।
২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন মালিকদের উপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২৫০ টাকার নো পার্কিং মামলার জরিমানা ৩০০০ টাকা হয়ে গেছে। একটি গাড়ি যদি মাসে ২/৩টি মামলা খায় তাহলে মাস শেষে মালিকের কিছুই থাকে না। একদিকে সড়কের বেহাল দশা। অপরদিকে মামলা। এই দুই কারণে মালিকরা এক প্রকার নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমাদের অনেক সদস্য (বাস মালিক) আছেন জমি এবং স্বর্ণ বিক্রি করে গাড়ি রাস্তায় নামিয়েছে। কিন্তু তাতে তারা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ ৬ মাস পর গাড়িগুলো আবারো একই অবস্থায় গ্যারেজে ফিরে গেছে। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন গ্যারেজগুলো যেমন শাহ আমানত সেতু এলাকা, কালুরঘাট এলাকা, সিটি গেট এলাকা, অক্সিজেন এলাকার গ্যারেজগুলো গাড়িতে ঠাসা। গাড়িগুলো পড়ে আছে। মালিকদের কাছে অর্থ নেই বিধায় তা মেরামত করতে পারছে না। করোনা মহামারীতে সরকার বিভিন্ন খাতকে প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল সরকার গণপরিবহন খাতকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। ন্যূনতম সহায়তাও করেনি। তাদের দুর্দশার কথা বিবেচনা করেনি। এসব কারণে এই ব্যবসায় নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করার কথা আর চিন্তা করছে না।
এসব কারণে আগামী ৬ মাস পর চট্টগ্রাম শহরে গণপরিবহনের তীব্র সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিবহন ব্যবসা সেবামূলক একটি ব্যবসা। কিন্তু এখানে গাড়ির মালিক, চালক এবং সহকারীদের রুটি-রুজির বিষয়টি জড়িত। শুধু সেবা দিলে চলবে না। তাদের সংসারও চালাতে হবে।
জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সরকার তার সাথে সঙ্গতি রেখে ভাড়া বৃদ্ধি করেছে একজন মালিক নেতা হিসেবে আমি মনে করি তা যথাযথ হয়নি। ২০১৫ সালে জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর সরকার ভাড়া বাড়িয়েছিল। এরপর আর ভাড়া বাড়েনি। কিন্তু এই সময়ে গাড়ি যন্ত্রাংশসহ অনেক কিছুর দাম বেড়েছে। একসময় একটি চাকা কিনতাম ৭ হাজার টাকায়। এখন লাগে ১৩ হাজার টাকা। গিয়ার বক্স কিংবা অন্যান্য যন্ত্রাংশের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে গেছে। তারপরও সরকার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা আমরা যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে মেনে নিয়েছি।
চট্টগ্রাম শহরে সরকার ভাড়ার যে তালিকা দিয়েছে আমরা তার চেয়ে কম নিচ্ছি। ২০১৫ সালে সরকার যখন ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা বা ১০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেছিল আমাদের স্টাফরা সেই ভাড়া আদায় করতে পারেনি। উঠানামা ৫ টাকা ভাড়া আদায় করলেও দূরের ক্ষেত্রে কম ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আজ যখন বিআরটিএ বা প্রশাসন তালিকার ভাড়া নিতে বলছে আমরা তা যদি আদায় করি যাত্রীরা মনে করবে আমরা বেশি ভাড়া আদায় করছি। বাস্তবতা হল আমরা তালিকার চেয়েও কম ভাড়া আদায় করছি।
চট্টগ্রাম শহরে ভাড়া নিয়ে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এটাও চট্টগ্রামবাসীর জন্য একটি ইতিবাচক দিক।
গ্যারেজ মালিকরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বসে আছে। গ্যারেজে মেরামতযোগ্য গাড়ি ঠাসা থাকলেও কাজ করতে পারছে না। কারণ গাড়ি মালিকদের কাছে টাকা নেই। নতুন করে বিনিয়োগের সামর্থ্য নেই।
যাত্রী সেবা অক্ষুন্ন রাখতে হলে শুধুমাত্র সরকারি গণপরিবহন দিয়ে সম্ভব হবে না। বেসরকারি মালিকদের বাঁচাতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুদ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তবুও আমরা ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করবো। সরকারের উচিত গাড়ি মালিকদের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় করে দেয়া। গত ৯ মাসে নতুন গাড়ি নামতে দেখিনি। রাস্তায় যারা কাজ করছে সবাই উদাসীন।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করতে গিয়ে তাদের চুক্তিতে ছিল জন ও যান চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়া। কিন্তু তারা তা করছে না। এনিয়ে পত্রিকায় লেখালেখিও অনেক হয়েছে। তাতেও সিডিএ এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না।
পরিবহন খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। নতুবা সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। সবাই কথা বলছে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। না হয় গণপরিবহন সেবা ভেঙে পড়বে। কারণ চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী।
এই শহরে অন্তত ১৩০০ বাসের রুট পারমিট আছে। কিন্তু চলাচল করে তার অর্ধেক। বাকি বাস চলে না। হিউম্যান হলারের পারমিট আছে অন্তত ১৭০০। চলাচল করে তার অর্ধেক। অটোটেম্পোর পারমিট আছে তিন হাজারের মত। তাও চলাচল করে অর্ধেক। যে গাড়ি একবার বিকল হচ্ছে তা গ্যারেজে চলে যাচ্ছে। কিন্তু মেরামত করে গ্যারেজ থেকে আর বের করা হচ্ছে না। আমার জানামতে অন্তত ৩০০ বাস ডাম্পিং করে কেটে বিক্রি করে ফেলেছে। কীভাবে চলবে এই গণপরিবহন। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা রাত দিন দেশের জন্য পরিশ্রম করছেন। কিন্তু তার আশপাশের কিছু লোক তার অর্জনকে বিনষ্ট করার জন্য সঠিক সময়ে নেত্রীকে সঠিক তথ্য জানাচ্ছে না।

লেখক : সভাপতি, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপ

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট