চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নির্বাণোন্মুখ অগ্নিশিখা

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ৩:৫২ অপরাহ্ণ

সুজিত সাহা

 

২০০১ সালে কিছু স্বপ্নবাজ মানুষের হাতে সৃষ্টি জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। পর্তুগীজ আমলে এ বাংলায় সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণের ঐতিহাসিক ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসে তাক লাগিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সাহস ও উদ্যম বৃহৎ শিল্পে বাংলাদেশে নতুন বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল।

শূন্য দশকের মাঝামাঝিতে বিশ্ববাজারে বড় বড় বেশ কয়েকটি জাহাজ রপ্তানির মাধ্যমে বাজিমাৎ করে দেয় সবাইকে। প্রায় এক দশক ধরে ঘোরের মধ্যে ছিল ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের কার্যক্রমে বিভোর অন্যান্য খাতের উদ্যোক্তা, এমনকি সরকারি নীতি নির্ধারকরাও। সমুদ্রগামী বৃহদাকার জাহাজ নির্মাণ ও রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কিংবা দেশে বিক্রির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় বাংলাদেশের সুনামকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। তাদের এই সাফল্য সরকারও মুগ্ধ, কেননা বাংলাদেশের ভারী শিল্পখাতে উন্নতির শিখরে পৌঁছার চ্যালেঞ্জে একটি নতুন আত্মবিশ্বাসের নাম ছিল ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড।

ওয়েস্টার্ন মেরিনের সাফল্য দেখে একের পর এক প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তা গোষ্ঠী বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগে আকর্ষণ হয়ে দেদারছে ঋণ সহায়তা কিংবা কাঁচামাল আমদানিতে নানাবিধ সুবিধাও পেয়েছে খাতটি। কিন্তু একটি বৃহৎ ও চ্যালেঞ্জিং খাতকে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারি নীতি কাঠামো তৈরি হয়নি সেভাবে। একটি ভারী শিল্প খাতের টেকসই বিকাশের পথকে সুগম করতে করা হয়নি পরিকল্পিত কোন গবেষণাও। ফলে বিশ্বের তাবৎ অভিজ্ঞ জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশীয় এ প্রতিষ্ঠানের উত্থানের সেই গল্প আর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একের পর এক দেশীয় জাহাজ নির্মাণ খাতের উদ্যোক্তারা ব্যর্থতার মিছিলে যোগ দিয়েছে।

আর এই ব্যর্থতার গল্পে নেতৃত্ব দিয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড।

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড এ পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক জাহাজ নির্মাণ করে দেশে বিদেশে বিক্রি করেছে। কিন্তু এই বিপুল বিনিয়োগের ব্যাংকের দায় পরিশোধ করতে পারেনি অনেকগুলোর। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কিংবা উদ্যোক্তাদের ব্যর্থতার পাশাপাশি সরকারি নীতি সহায়তা জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডে না হওয়ায় দুই দশকের মধ্যেই দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প এখন গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। সরকার জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা এবং দীর্ঘমেয়াদে এগিয়ে নিতে সম্প্রতি একটি নীতিমালা তৈরি করেছে।

ওয়েস্টার্ন মেরিনের একের পর এক জাহাজ বিশ্ববাজারে রপ্তানির খবরে প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড ইমেজ এতটাই বেড়েছিল যে ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অনেকটা উদার হস্তে ঋণ দিয়েছে। এক পর্যায়ে ঋণ অনিয়মিত হয়ে পড়লে সরে আসতে চাইলেও পারছে না বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলো। এর প্রতিকার হিসাবে বেশ কিছুদিন ধরে ওয়েস্টার্ন মেরিনসহ এই খাতের উদ্যোক্তারা সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ প্রদানের দাবি করে আসছে। তাদের যুক্তি, একটি জাহাজের কার্যাদেশ পেয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়ে কাজ শুরু করলেই বিদ্যমান ঋণ গ্রহণ ও নিয়মিত পেমেন্ট পদ্ধতিতে লোকসান ছাড়া আর কিছুই জুটবে না উদ্যোক্তাদের কপালে।

একটি জাহাজের জন্য ঋণ নিয়ে ওই জাহাজটি ক্রেতাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়ার আগে ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য আবারও ঋণ নিতে হয় কোম্পানিগুলোকে। এজন্য বিশ্বে জাহাজ নির্মাণের মতো ভারী শিল্পে সিঙ্গেল ডিজিট ঋণ এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধযোগ্য ঋণের সুবিধা দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে এই সুবিধা পেতে বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারির জন্য সরকারের কাছে বিভিন্ন সময়ে দেনদরবার করেছে এই খাতের উদ্যোক্তারা। নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার মাধ্যমে সেই চ্যালেঞ্জে উদ্যোক্তারা কিছুটা জয়ী হলেও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো ঢের কঠিনই হবে।

শুরুর পর সরকার জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ডেড ওয়্যারহাউস (শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি সুবিধা) সুবিধা দেয়। দেয় নগদ সহায়তাও। কিন্তু জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য যে ধরনের সুবিধা প্রয়োজন সেটির বাস্তবায়ন করতে বিলম্ব হয়েছে। কিংবা উদ্যোক্তারাও সরকারকে এ বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে একটি সম্ভাবনাময় খাত অনভিজ্ঞ চর্চায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন ব্যাংকগুলোরই এই খাতে বিনিয়োগে ভীতি কাজ করছে।

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ বলছেন, শিপ বিল্ডিং খাতটি ভারী শিল্প খাত। বাংলাদেশের অপরাপর ভারী শিল্পের তুলনায় এই খাতে ভিন্ন আঙ্গিকে বিনিয়োগের রিটার্ন পাওয়া যায়। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হওয়ায় দেশের অন্যান্য খাতের মতো ঋণ প্রদান ও আদায় এ খাতে সম্ভব নয়। তাছাড়া কার্যক্রম শুরুর পর দেশি-বিদেশি বেশকিছু সার্টিফিকেট অর্জনের পর বিদেশি কার্যাদেশ আসতে শুরু করে এই খাতে। যার কারণে বিশেষ বিনিয়োগ নীতিমালা ছাড়া এই খাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ জরুরি। দীর্ঘমেয়াদে স্বল্প সুদ প্রদানে সরকারের নীতিমালা না থাকলে ব্যাংকও উদ্যোক্তাদের কথামতো বিনিয়োগ করবে না। সম্প্রতি সরকার শিপ বিল্ডিং খাতের উন্নয়নে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ‘বাংলাদেশ শিপ বিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রিজ  ডেভেলপমেন্ট পলিসি’ নামের এই নীতিমালা এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে দুই দশকেই মুখ থুবড়ে পড়া জাহাজ নির্মাণ শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখছে উদ্যোক্তারা।

এসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপ বিল্ডিং ইন্ড্রাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশ (এইওএসআইবি) জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশে ১৭টির  মতো জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জাহাজ রপ্তানির জন্য বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া ছোট পরিসরে অনেকেই জাহাজ নির্মাণের সাথে যুক্ত রয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ১৫০ মিলিয়ন ডলারের জাহাজ রপ্তানি করেছে। ওই সময়েই ১৩৭ মিলিয়ন ডলারের জাহাজ রপ্তানির কার্যাদেশ ছিল বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে দেশীয় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রপ্তানি আদেশ শূন্যের কোটায় নেমে আসে। তাছাড়াও বৈশ্বিক মন্দার কারণে এর পরের কয়েক বছরও জাহাজ রপ্তানির কার্যাদেশ ছিল না বললেই চলে। সর্বশেষ ২০২০ ও ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প কার্যত অচল হয়ে পড়ে। যদিও লক্ষাধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিকারী জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মাধ্যমে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আশা দেখিয়েছিল এই খাতের উদ্যোক্তারা। যার নেতৃত্ব দিয়েছিল ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন খুলনা শিপইয়ার্ড ১৯৫৭ সাথে প্রতিষ্ঠিত হলেও ২০০৭ সালে লাভের ধারায় ফিরে। বেসরকারি খাতের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের আবির্ভাব ২০০৭-০৮ এর দিকে। ওয়েস্টার্ন মেরিনের হাত ধরেই বেসরকারি খাতের বড় বিনিয়োগ আসে খাতটিতে। বড় বিনিয়োগের পর দ্রুত মন্দার কবলে পড়ে খাতটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশও বিশ্বমানের জাহাজ নির্মাণ করলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রদানের সীমাবদ্ধতায় দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। জাপানে যেখানে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ সুদে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে ঋণ দেয়া হয়। চীন, ভারত, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০-৩০ বছর মেয়াদী সুদে ঋণ দেয়া হয়। সেখানে এখানকার উদ্যোক্তারা দুই অঙ্কের সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় নামে। যার পরিণতি ভোগ করছে ওয়েস্টার্ন মেরিন এবং এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

দেশে প্রথম করপোরেট জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একমাত্র জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানও ওয়েস্টার্ন মেরিন। বিনিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা, বৈশ্বিক সংকট, অন্তর্দ¦ন্দ্ব ছাড়াও ভুল বিনিয়োগের কারণে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের যে ভূমিকা দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে সেখানে নতুন করে এগিয়ে নেয়ার দায়ও তাদের। সরকারি নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন, সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিকাঠামো তৈরির মাধ্যমে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায় তবে দেশের সম্ভাবনাময় শিল্পটি আবারও গতি পাবে। এতে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব ও কর্তব্য ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট