চট্টগ্রাম রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুপারিশ হয় বাস্তবায়ন হয় না

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন 

১১ জুন, ২০২১ | ১২:৪৩ অপরাহ্ণ

খুলশী থানার ৭নম্বর গলি এলাকায় মতিঝর্ণা পাহাড় কেটে ভবন নির্মাণ করায় মো. শাহজাহান কোম্পানিকে ১৪ লাখ টাকা এবং মনোয়ারা বেগমকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। একই সঙ্গে কাটা পাহাড়কে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের নভেম্বর মাসে পরিবেশ অধিদপ্তরের (মেট্রো) পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী এই রায় দিয়েছিলেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সরকারি জায়গা দখল করে তিনতলা ভবন নির্মাণ করছিলেন মো. শাহজাহান। পাহাড়ের সঙ্গে লাগোয়া নির্মিত ভবনটিতে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ রয়েছে। এভাবে প্রতিনিয়ত পাহাড় কেটে ন্যাড়া করা হচ্ছে। হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি। অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসনের নজরদারির অভাব, পাহাড় সুরক্ষায় স্থায়ী উদ্যোগ না নেওয়া, পাহাড়খেকো জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য থামাতে না পারায় নির্বিঘ্নে পাহাড় দখল করে গড়ে ওঠছে নানা স্থাপনা। অথচ ১৪ বছর আগেই পাহাড় সুরক্ষায় ৩৬ সুপারিশমালা দেওয়া হয়েছিল। ২০০৭ সালের ১১ জুন স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড় ধসে মারা যান ১২৭ জন। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে গঠন করা হয়েছিল পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। সরকারি তদন্ত কমিটি ভূমি ধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করেছিল। পাহাড় সুরক্ষায় ৩৬ সুপারিশমালা প্রদান করেছিল। এই ১৪ বছরে একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।

চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১৭ পাহাড়কে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে জেলা প্রশাসন। প্রতি বছর বর্ষা আসলেই পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তোড়জোড় শুরু হয়। হয় নানা কমিটি। নতুন নতুন সুপারিশমালা জমা পড়ে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়নি। এতে পাহাড় ধস ও মৃত্যুর ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পরিবেশবাদীদের।

জেলা প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা পূর্বকোণকে বলেন, কমিটির সুপারিশমালা বাস্তবায়ন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। কিন্তু কমিটির বেশিরভাগ সদস্য সরকারি চাকরিজীবী এবং বদলিযোগ্য। এসব কমিটিতে নতুন লোক আসে এবং চাকরিজীবনের মেয়াদকালের পর বদলি হয়ে যান। এই কারণে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয় না।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি কমিটি :

২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড় ও দেয়াল ধসে প্রাণহানির পর তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মোখলেছুর রহমানকে প্রধান করে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। এর পর থেকে চট্টগ্রামের দায়িত্ব পালন করা বিভাগীয় কমিশনাররা কমিটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন। কমিটির সদস্য সচিব হচ্ছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)। কমিটি গঠনের পর থেকে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি বহু সভা করা হয়েছে। তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এম এ এন ছিদ্দিককে প্রধান করে গঠিত কমিটি পাহাড় ধসে ২৮টি কারণ চিহিৃত করেছিল। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম একটি কারিগরি রিপোর্ট প্রদান করেন। পাহাড়ধসের ঝুঁকি কমাতে এবং তা থেকে রক্ষা পেতে রিপোর্টে তিনি দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প মেয়াদি অর্ধশত সুপারিশ করেন। এছাড়াও ২০১১ সালে টাইগারপাসের বাটালি হিলে দেয়াল ধসে ১৭ জনের প্রাণহানির পর গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও কারিগরি কমিটির সুপারিশের কথাগুলো উঠে এসেছে। তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর আলমকে প্রধান করে আরো একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি নগরীর পাহাড়গুলো সার্ভে করে কোন পাহাড় কোন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ এবং কিভাবে ঝুঁকি কমানো যায় এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রদান করেছিল।

পাহাড় ধসের চিহ্নিত কারণ

২০০৭ সালে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর ভূমি ধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করেছিল তদন্ত কমিটি। উল্লেখযোগ্য কারণগুলো ছিল, ভারী বর্ষণ, পাহাড়ের বালির আধিক্য, পাহাড়ের উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস গড়ে তোলা, পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটি অপসারণে দুর্বলতা ইত্যাদি।

৩৬ সুপারিশের উল্লে­খযোগ্য

এই সময় পাহাড় ধস রোধে ৩৬টি সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাহাড়ে জরুরিভাবে বনায়ন, গাইড ওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন-মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, বসতি স্থাপনাসমূহ টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না দেয়া, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনা নিষিদ্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।

সরেজমিন দেখা যায়, নগরীতে পাহাড় কাটা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন এলাকায় চলছে পাহাড় কাটা। খুলশী মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল ছাড়াও অতিসম্প্রতি বায়েজিদ-ফৌজদারহাট রিঙ্ক রোড এলাকায় যত্রতত্র পাহাড় কাটা চলছে। হচ্ছে বেদখল। রাজনৈতিক ছত্রছায়া ছাড়াও পুলিশ প্রশাসনের নামেও পাহাড় দখল ও পাহাড় কেটে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি ২১তম বলা হয়েছে, নগরীর মতিঝর্ণা ও বাটালি হিলের পাদদেশে ৪-৫ তলা ভবনও রয়েছে। পাহাড়ের মালিক জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ে। কিন্তু কোনো সংস্থাই পাহাড়-জমির লিজ দেয়নি। প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহল জমি দখল করে ভাড়া দিয়েছেন।

দেখা যায়, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, বাটালি হিলসহ বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে শত শত পরিবারের বসবাস রয়েছে। এসব পাহাড়ে গড়ে উঠেছে পাকা দালান, ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা। এসব ঘরবাড়ি ও বস্তিতে নাগরিক সুবিধার বিদ্যুৎ, পানির সুবিধা রয়েছে। কোনো কোনো বস্তিতে আবার গ্যাস সংযোগও রয়েছে। অল্প টাকায় ভালো নাগরিক সুবিধা পাওয়ায় মৃত্যুকূপ ছাড়তে চান না বসবাসকারীরা। এর পেছনে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অসাধু কর্মচারীদের যোগসাজশও রয়েছে।

জেলা প্রশাসন ও সরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি-বেসরকারি পাহাড়গুলোতে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে দখল করে বস্তিঘর তৈরি করে ভাড়ায় দিয়েছেন। জনপ্রতিনিধি, সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের কয়েক জনও পাহাড় দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারা জড়িত থাকায় কৌশলে রাতের বেলায়ও কাটা হচ্ছে পাহাড়। সর্ষে ভূত থাকার কারণে সহজেই রোধ করা যাচ্ছে না।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ১১ জুন ১২৭ জন, ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজারে পাহাড়ধসে লালখান বাজারের মতিঝর্ণায় একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১১ জন, ২০১১ সালে টাইগারপাস বাটালি হিলের দেয়াল ধসে ১৭ জন, ২০১২ সালে আকবরশাহ হাউজিং সোসাইটিসহ নগরীর তিন এলাকায় পাহাড়ধসে ২২ জনের মৃত্যু হয়। গত ১৪ বছরে ২০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

 

গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই

মো. কামরুল হাসান

বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম ও সভাপতি-পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি

 

২০০৭ সালের স্মরণকালের পাহাড় ধসের ঘটনার পর বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে একটা কমিটি করা হয়েছে। এখনো সেই কমিটি রয়েছে। আমি চাচ্ছি, সেই কমিটির একটা মিটিং করবো। কারণ ২০০৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সময়ের কারণে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রয়োজনীয়তাও অনেক বদলে গেছে। বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতি, ভৌগোলিক অবস্থান, পাহাড়ের অবস্থা খুবই অস্থির অবস্থা। এই প্রেক্ষিতে আমার ৩৬টি সুপারিশের প্রয়োজন নেই। আমি কিছু একটা করতে চাই। আমার কথা হচ্ছে, আমাকে পরিবেশ বাঁচাতে হবে। মানুষ বাঁচাতে হবে। এজন্য ৩৬ টি সুপারিশমালা নিয়ে কাজ করতে গেলে হিমশিম খেতে হবে। কারণ কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা করব, তা নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যাব। এজন্য মাত্র তিন-চারটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাই। পাহাড় সুরক্ষায় অতি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই। প্রধান কারণগুলো বাস্তবায়ন করা হলে পাহাড় সুরক্ষা করা যাবে। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে করা হবে।

 

উচ্ছেদ নেপথ্যে বড় বাধা প্রভাবশালীমহল

মো. নূরুল্লাহ নূরী

পরিচালক (মেট্রো)-পরিবেশ অধিদপ্তর সভাপতি, অবৈধ বসতি উচ্ছেদ উপ-কমিটি

 

পাহাড়ে অবৈধ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে হলে বিকল্প বসতির ব্যবস্থা করতে হবে। কোভিড মহামারির কারণে এ মুহূর্তে তা সম্ভব নয়। কারণ লালখান বাজার এলাকায় পাহাড়ে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষের বসতি রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক লোকের বিকল্প ব্যবস্থা করা সরকারের জন্য কঠিন বিষয়। তবে সরকার বসবাসের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করলেও কর্মস্থানের ব্যবস্থা না করলে তারা সেখানে থাকবে না। এজন্য স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ জীবন-জীবিকার কথা চিন্তা করতে হচ্ছে। নূরুল্লাহ নূরী বলেন, প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পাহাড় দখল করে অবৈধ বসতি গড়ে ওঠেছে। ২০১৯ সালে উচ্ছেদ করার সময় আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। আমরা বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার খুলে দিয়েছিলাম। বিদ্যুৎ বন্ধ হলে সবাইকে এমনিতেই চলে আসতে হবে। কিন্তু আমাদের উপর হামলা ও নানা ধরনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি কসাইখানায় পরিণত করারও হুমকিও দিয়েছিল। জীবন দিয়েও পারছি না। এজন্য সবার আগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছা প্রয়োজনীয় বেশি। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে পাহাড় সুরক্ষা করা যাবে।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট