চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

মাদ্রাসা শিক্ষা: শাসনের সংস্কৃতি পাল্টাতে হবে

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১২ মার্চ, ২০২১ | ১১:৩০ পূর্বাহ্ণ

হাটহাজারীতে মারকাজুল কোরআন ইসলামী একাডেমি মাদরাসায় ইয়াসিন ফরহাদ (৭) নামে এক শিশু শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধরের ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। এই ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন অভিভাবক, শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনেরা। এছাড়াও এই ঘটনায় প্রশাসন কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।

হাটহাজারীতে শিশু শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনা ছাড়াও চট্টগ্রামে ইতিমধ্যেই এই ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এমনকি যৌন নিপীড়নের মতো অভিযোগও ওঠেছিল। অথচ ইসলাম ধর্মে শিশু নির্যাতনের বিষয়ে বিধি-নিষেধ রয়েছে।

এদিকে, শিশু নির্যাতনে দায়ে গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষক হাফেজ ইয়াহিয়াকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতনের ঘটনা সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এই ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন অভিভাবক, শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনেরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি প্রফেসর সিকান্দর খান বলেন, ‘আমাদের সময়ে শিক্ষার্থীদের মারধর করা হতো। বর্তমানে শিশুদের মারধরের বিষয়ে নিষিদ্ধ রয়েছে। শাস্তি দিয়ে শাসন করার মানসিকতা ছেড়ে ভালবাসা দিয়ে শিক্ষাদানের কথা রয়েছে। এজন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিটিআই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষায়ও এই ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।’

মাদ্রাসা ছাড়া বাসা-বাড়িতে, স্কুল-কলেজ ও দ্বীনী শিক্ষায় শিশুদের উপর শাসন নামের নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। এসব ঘটনার কারণে রাগ-ক্ষোভে অনেকেই পড়ালেখাই ছেড়ে দেয়। এরপর গুরুতর অপরাধেও লিপ্ত হয়ে পড়ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, শিশুদের শাসন করার ক্ষেত্রে শরীয়ত নির্দেশিত পন্থা ও সীমা উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে জানান ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশিষ্টজনেরা।

শিশুদের শাসন করার বিষয়ে পথ দেখিয়েছে ইসলাম ধর্ম। ফাতাওয়া আলমগীরীতে বলা হয়েছে, কোনো শিশু বা ছাত্র তার সাথীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তা শোনামাত্রই মেজাজ বিগড়ানো যাবে না। কেননা, শরীয়তে এক পক্ষের অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা নেই। উভয় পক্ষের কথা না শুনে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। অথবা একজনকে শাস্তি দেয়া যাবে না। অন্যথায় খোদ ফায়সালাকারীই জালেম সাব্যস্ত হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, সবার কথা শোনার পর যখন ফায়সালা করার ইচ্ছা করবে, মনের মধ্যে কোনরূপ রাগ স্থান দেয়া যাবে না। কারণ, রাগের সময় বিবেক বুদ্ধি লোপ পায়। ফলে অধিকাংশ সময়ই রাগের মাথায় ফায়সালা ভুল প্রমাণিত হয়।

বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও তুহফাতুল উলামা-এ বলা হয়েছে, রাগান্বিত অবস্থায় ফায়সালা দেয়া বা শাস্তি প্রদান করা শরীয়তে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শরীয়তে আরও বলা হয়েছে, নাবালেগ বাচ্চাকে বেত বা লাঠি দিয়ে প্রহার করার কোনো অবকাশ নেই। প্রয়োজনে ধমকি-ধামকি দিয়ে, কান ধরে উঠ-বস করিয়ে, এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রেখে বা বিকেলে খেলা বন্ধ রেখে শাস্তি দেয়া যেতে পারে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন তালুকদার পূর্বকোণকে বলেন, ‘শিশুদের বেত্রাঘাত করা আইন নিষিদ্ধ ছাড়াও শরিয়তেও নিন্দনীয় অপরাধ। এবং অমানবিক কাজ। শিশুদের উপর নির্যাতন ও মারধর করা শিক্ষকসুলভ আচরণ বলা যায় না।’তিনি বলেন, মাদরাসাগুলোতে কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়। কোরআনের বিধান অনুসরণ করে শিক্ষাদানের পরামর্শ দেন এই ইসলামী চিন্তাবিদ।

প্রশিক্ষিত করতে হবে মাদ্রাসা শিক্ষকদের

প্রফেসর সিকান্দর খান, উপাচার্য-ইস্ট ডেল্টা ইউনির্ভাসিটি

ইস্ট ডেল্টা ইউনির্ভাসিটির উপাচার্য প্রফেসর সিকান্দর খান বলেন, অর্থনৈতিক অবস্থা, জ্ঞানের অভাব ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাবে শিশু-শিক্ষার্থী মারধর ও নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে মাদ্রাসাগুলোতে। এজন্য মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থাকা অত্যন্ত জরুরি।

শিক্ষাবিদ সিকান্দর খান বলেন, হেফজখানা হচ্ছে কোরআন শিক্ষার উত্তম কেন্দ্র। সেখানে মারধর করে শিক্ষাদান হয়। তা মেনে নেওয়া যায় না। ভ্রান্ত ধারণা ও উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে তা হয়। এজন্য শিক্ষক নিয়োগের আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে পিটিআই প্রশিক্ষণ বাধ্যবাধক। মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগে তা উপেক্ষিত।

প্রফেসর সিকান্দর খান বলেন, বাংলাদেশে শিশু শিক্ষাব্যবস্থায় নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও মাদ্রাসা শিক্ষায় ঘন ঘন শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। অথচ শিক্ষাদানের মূল বিষয় হচ্ছে মানুষকে ভালবেসে শিক্ষা দেওয়া। মারধর ও নির্যাতন না করার বিষয়ে ধর্মে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন।

ইসলামে শিশুদের প্রহার করা নিন্দনীয় অপরাধ

ড. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক, আরবি বিভাগ , চবি

শিশুদের বেত্রাঘাত করা শুধু রাষ্ট্রীয় আইনে নিষিদ্ধ নয়; বরং শরিয়তের দৃষ্টিতেও শিশুদের প্রহার করা একটি নিন্দনীয় অপরাধ ও অমানবিক কাজ বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন তালুকদার। সম্প্রতি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মারকাজুল কুরআন ইসলামিক একাডেমির হেফজ বিভাগের এক শিশু শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাতের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে গতকাল পূর্বকোণের এক প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন এ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, শুধু মাদরাসায় কেন? বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা শিক্ষার্থীদের ওপর মারপিটের মতো যে আচরণ দেখতে পাই-সেটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। এগুলো অবশ্যই পরিত্যাজ্য। বিশেষ করে মাদরাসার হেফজ খানাগুলোতে-যেখানে কুরআনের শিক্ষা দেওয়া হয়। যেখানে ইসলামের শিক্ষা দেওয়া হয়। সে মাদরাসাগুলোতে কুরআনের বিধান অনুসরণ করা, আল্লাহর হুকুম মান্য করা সবার আগে তাদের দায়িত্ব। সুতরাং কোনো মাদরাসায় শিশুর উপর নির্যাতন, অত্যাচার বা শাসন, বেত্রাঘাত এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাকে কিছুতেই শিক্ষকসুলভ আচরণ বলা যায় না।

ইসলাম শান্তির ধর্ম উল্লেখ করে ড. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ধর্মীয় শিক্ষার নামে শিশুদের প্রহার করা মাদরাসা শিক্ষা ও হেফজুল কুরআন মাদরাসার উপর একটা কালেমা লেপনের অপচেষ্টা। যারা এ ধরনের কর্মকা- করবে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন মানবতার মহান শিক্ষক। আল্লাহর রাসূল কাউকে প্রহার করেছেন এমন প্রমাণ নেই। বরং স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসা ছিলো নবীজির শিক্ষা পদ্ধতি। নবী কারীম (সা.) বলেছেন, ‘যে বড়দের সম্মান করে না এবং ছোটদের স্নেহ করে না সে আমার উম্মত নয়’। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘(হে রাসূল)! আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহে আপনি উন্মাদ নন। আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’। তিনি বলেন, মসজিদে নববী ছিল ইসলামের দীনি প্রতিষ্ঠান। উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বলতে পারেন। সেখানে কোনো ছাত্র প্রহরিত হয়েছে তার নজির নেই।

শিশুরা আতঙ্কিত হয় এমন কোনো শাসন না করার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘বেত্রাঘাতের মাধ্যমে শাসন নয়, আখলাক-চরিত্র, উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেটা করতে পারলে তা হবে দক্ষ শিক্ষকের পরিচয়। সারা বাংলাদেশে হাফেজদের ‘হোফজুল করআন’ নামে একটি একটা সংগঠন আছে, তাদেরকে আমি দৃষ্টি আর্কষণ করবো- তারা যেন এ ধরনের অমানবিক কর্মকা-গুলোর লাগাম টেনে ধরে এবং প্রহার বিষয়ক শরীয়ার বিধানসহ নির্দেশনা জারি করে। এছাড়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যতবড় কিংবা ছোট হোক না কেন আবশ্যই থানা সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। তাহলে এ ধরনের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডগুলো হবে না বলেও তিনি মনে করেন।

শিশুদের মারধর করা ইসলাম পরিপন্থী

মুফতি অছিয়র রহমান, অধ্যক্ষ-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা

 

জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি অছিয়র রহমান আলকাদেরী নবী করিম (সা.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি। এজন্য সাহাবীরা ছোট শিশুদের নবী করিম (সা.) এর কাছে নিয়ে আসতেন। আর নবীজি শিশুদের স্নেহ, মায়া-মমতা ও ভালবাসা দিতেন। তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। শিশুদের মারধর ও রক্তাক্ত করা ইসলাম পরিপন্থী। কোরআন শিক্ষার নামে কী শিক্ষা দিচ্ছি? ইসলামী চিন্তাবিদ অছিয়র রহমান বলেন, এতিমখানা, হেফজখানা, এবতেদায়ী ও প্রাইমারি শিক্ষায় শিশুদের ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক শিক্ষাদান করতে হবে। মারধর করা জুলুমে নামান্তর। এতে কোরআন ও ইসলামী শিক্ষার প্রতি শিশুদের অনীহা সৃষ্টি হতে পারে। ভয়ে শিশুর শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর অভিশাপ পড়বে ওই শিক্ষকের ওপর। শিশুটি যতক্ষণ ক্ষমা করবে না, আল্লাহ রাসুলও তাকে ক্ষমা করবেন না।    

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট