
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সহজ করা ও শুল্ক আদায়ের প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে এখন কিছু কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আর কিছু হাতে হওয়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের কাছে ভোগান্তির কথা তুলে ধরেছেন এক ব্যবসায়ী নেতা।
তিনি বলেছেন, “আল্লাহর ওয়াস্তে হয় অটোমেশন করেন, না হলে ম্যানুয়ালে ব্যাক করে দেন। আমরা বাঁচি।”
শনিবার এমসিসিআইয়ের কার্যালয়ে এনবিআর সংস্কার বিষয়ক এক রাউন্ড টেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহ–সভাপতি এ এম মাহবুব চৌধুরী।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হল- এর কর্মকাণ্ডে হাফ অটোমশেন, হাফ ম্যানুয়াল। আমরা বারবার বলছি এটাকে হয় পুরোপুরি অটোমেশন করুন, না হলে ম্যানুয়াল করুন।”
কাস্টমস হাউজের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দিনের অর্ধেক চলে যায়।
“সেখানে থাকা কর্মীকে (তার অফিসের) ফোন দিলে সে বলে দীর্ঘ লাইনের কথা। ও বসে আছে, কাজ এগোবে কীভাবে। কারণ যেহেতু অটোমেশন। আমরা উনাকে (কর্মকর্তাকে) বলছি, আল্লাহর ওয়াস্তে হয় অটোমেশন করেন, না হলে ম্যানুয়ালে ব্যাক করে দেন। আমরা বাঁচি।
“ম্যানুয়াল হলে শিটটা লিখে তিনজন লিখে স্বাক্ষর করবেন। তিন গ্রুপ মিলে একটি কম্পিউটার অপারেটর। সেখানে প্রিন্টার নেই। পেনড্রাইভে করে নিয়ে আরেক জায়গা থেকে প্রিন্ট করতে হচ্ছে। এতো কষ্ট চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে।”
দুই যুগে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের অটোমেশন ‘এক ইঞ্চিও এগোয়নি’ বলেও মাহবুব চৌধুরী মন্তব্য করেন।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ (পিইবি) আয়োজিত আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও এনবিআর সংস্কার কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ।
অনুষ্ঠান সঞ্চলনা করেন এমসিসিআই এর সাবেক সভাপতি নিহাদ কবীর। বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন।
সেখানে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “যদি অটোমেশন হয়, সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। অটোমেশন শুধু এনবিআরের হলে হবে না। এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও হতে হবে।”
উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের এক আমদানিকারক পণ্য রিলিজ করতে গেল তখন শুল্ক গোয়েন্দা তা আটকে দিল। নানা কাহিনী করল। শেষ পর্যন্ত কোনটাই প্রমাণিত হল না। এরপরে তাকে দীর্ঘদিন পরে এই পণ্য কীভাবে যাবে (খালাস হবে) সেটা নিয়ে শুনানি হল। শুনানিতে শুল্ক দিয়ে পণ্য নেওয়ারি নির্দেশ দিল। এগুলো করতে করতে ৪-৫ মাস হয়ে গেছে।
“তখন গেছে পোর্ট ড্যামারেজ মাফ করানোর জন্য। শিপিং উপদেষ্টা আদেশ দিলেন এই ড্যামারেজ ৫০ শতাংশ মাফ করার জন্য। এই আদেশ চট্টগ্রাম পোর্টে যেতে লাগছে ২১ দিন। আমার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটেছে।”
নিহাদ কবীর বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে এনবিআর সংস্কারের কথা বলে আসছি। এটাকে একসময় ‘অরণ্যে রোদন’ মনে হয়েছে। যারা পলিসি করে তারা কর সংগ্রহ করতে পারে না। এনবিআর সংস্কার কমিটি খুব ভালো কাজ করছে। তাদের প্রতিবেদন বাস্তবায়ন হলে রাজস্ব খাতে পরিবর্তন আসবে।”
হিসাববিদ ও এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেড পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, “এক অফিসে কর, ভ্যাট নেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। তাতে সরকারের ব্যয় সংকোচন হবে। রাজস্ব আদায় ও সহজ হবে। ব্যবসায়ীদের রাজস্ব দিতে অনেকগুলো অফিসে ধরণা দিতে হয়।”
এখন গোয়েন্দা সংস্থাও অনেকগুলো- সে বিষয়টিও তুলে ধরে তিনি বলেন, আয়কর গোয়েন্দা আছে আবার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলও (সিআইসি) আছে। আবার ভ্যাট অফিসে ভ্যাট গোয়েন্দা আছে। শুল্ক গোয়েন্দা। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কতগুলো এনবিআরের অফিসে ‘ধরণা দেবে’- প্রশ্ন করেন তিনি।
এমসিসিআই সভাপতি কামরান তানভীরুর রহমান বলেন, “আমাদের করভিত্তি দীর্ঘদিন ধরেই সীমিত রয়ে গেছে—দেশের ৩ শতাংশেরও কম নাগরিক আয়কর রিটার্ন জমা দেন। কর্পোরেট কর ফাঁকি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। প্রয়োগ ব্যবস্থা দুর্বল, যা প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
“সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো, আমাদের কর সংগ্রহ ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল, যেখানে রয়েছে ব্যাপক প্রশাসনিক স্বাধীনতা, যা একদিকে করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে, অন্যদিকে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে। এর ফলে তৈরি হয়েছে এক দুষ্টচক্র—কমপ্লায়েন্স কম, আস্থা কম এবং রাজস্ব কম।”
এতে করে ব্যবসায়ী মহলের দুটি সমস্যা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “প্রথমত, যারা সঠিকভাবে কর আইন মেনে চলে তাদের ওপর অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি হয়, অথচ যারা কর ফাঁকি দেয় তারা খুব সামান্য পরিণতির মুখোমুখি হয়। দ্বিতীয়ত, কর প্রশাসনে অস্থিরতা ও জটিলতা ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দেয়, প্রতিযোগিতার সক্ষমতা নষ্ট করে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে।”
পূর্বকোণ/পারভেজ