চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সুরক্ষিত ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে পৃথক ভোক্তা অধিকার মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয়তা
সুরক্ষিত ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে পৃথক ভোক্তা অধিকার মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয়তা

সুরক্ষিত ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে পৃথক ভোক্তা অধিকার মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয়তা

এস এম নাজের হোসাইন

১৫ মার্চ, ২০২০ | ২:৫৬ পূর্বাহ্ণ

অন্যান্য বছরের মত এবারও ‘বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২০’ বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হচ্ছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ‘ভোক্তাবাদ’ আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কর্তৃক মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ঐতিহাসিক দিনটির স্মরণে প্রতি বছরের ১৫ মার্চ বিশ্ব জুড়ে দিবসটি বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভোক্তা সংগঠনগুলো নানামুখী কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বে ভোক্তা আন্দোলনের মূল প্রবক্তা মার্কিন সিনেটর ও মাল্টিন্যাশনাল মনিটর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা রাল্ফ নাদের। ক্রেতা-ভোক্তাদের আর্ন্তজাতিক সংগঠন কনজুমারস ইন্টারন্যাশনাল বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান ও এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্রেতা-ভোক্তাদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে সেটা আজও এক বড় ধরনের প্রশ্ন। একই সাথে ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন ও কার্যকর করতে পেরেছি বা করেছি এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক নয়।
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হলোঃ টেকসই ভোক্তা (The sustainable consumar)। বাংলাদেশে বিষয়টি মুজিবর্ষের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারন করা হয়েছে “মুজিববর্ষের অ্ঙ্গীকার-সুরক্ষিত ভোক্তা অধিকার”। বিষয়টি আমাদের সকলের জন্য খুবই গুরত্বপূর্ণ। কারণ ভোক্তা অধিকার কী রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যবসায়ী, উৎপাদক, প্রশাসন-আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ ভোক্তাদের এখনও পরিস্কার ধারনার অভাব রয়েছে। সরকার ২০২০কে মুজিববর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছেন, বর্ষ পালনে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নেয়া হয়েছে। জাতির জনকের স্বপ্ন, চিন্তা ও চেতনার বিষয়গুলি সাধারন জনগণের মাঝে তুলে ধরাই বর্ষের মূল লক্ষ্য। আর সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে এই বর্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য, বিদ্যুৎ-পানি ও গ্যাসের মূল্য এই বছরে সহনীয় অবস্থায় থাকবে।
“ভোক্তা” শব্দের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। ভোক্তার ইংরেজী শব্দ কনজুমার যার অর্থ ভোগকারী। অর্থাৎ কেউ কোন পণ্য, খাদ্য, পানীয় দ্রব্য বা সেবা প্রদানকারীর সেবা গ্রহণ করে অর্থাৎ যারা ভোগ করে তাদেরকে ভোক্তা বলে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ২০০৯ এর আওতায় ভোক্তা হলেন “তিনিই যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন”। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা। আবার অনেকে বলে থাকেন মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে যে সমস্ত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাগুলি রাষ্ট্র্র ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত সেগুলিই ভোক্তা অধিকারের আওতায়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলির মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, যাচাই বাছাই করে ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাবার অধিকার, কোন পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওযার অধিকার, অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার, ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার উল্লেখযোগ্য। তবে অধিকারের পাশাপাশি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও বলা হলেও এ বিষয়গুলি সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার বিষয়টিও কম নয়। বিষয়গুলো হলো; পণ্য বা সেবার মান ও গুনাগুন সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হোন, দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করুন, আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হোন, ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে অধিকার সংরক্ষণে স্বেচ্ছার ও সংগঠিত হোন।
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে ক্রেতা-ভোক্তাদের লাগামহীন ভোগপ্রবণতা যেন পরিবেশের বিপর্যয় না ঘটায়, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা অর্জনের আকাক্সক্ষা, আবার আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ ধনীক ও ব্যবসায়ীপ্রীতি যেন পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করে না তোলে। আসলে আধুনিক ভোক্তাগোষ্ঠী, সরকার ও ব্যবসায়ীরা মিলে যেন প্রতিনিয়ত ধরিত্রীর গলা টিপে ধরছি। সে কারণে শুধুমাত্র ভোক্তাদের সচেতনতা হলেই চলবে না। আইনের প্রয়োগেও সমআচরণ, আর্থিকভাবে কম সক্ষমতাসম্পন্নদের প্রতি সুবিচারের মতো কার্যকর পদক্ষেপই পারে আমাদের আগামি প্রজন্মের জন্য এ পৃথিবীকে ন্যূনতম বসবাসের উপযোগী করে রাখতে।
একজন ব্যবসায়ী দু-চারটি পণ্যের উৎপাদক বা বিক্রেতা হলেও তিনি নিজে অসংখ্য পণ্যের ক্রেতা-ভোক্তা। ফলে এমন প্রবণতায় দিন শেষে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। মানহীন, ভেজাল ও কম পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার গ্রহণের ফলে আমাদের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অসংখ্য রোগের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হচ্ছে একেকটা স্থূলকায় শরীর। দুরারোগ্য সব ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য পরিবার হচ্ছে নিঃস্ব। সেকারণে ভোক্তা আন্দোলন ও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে জড়িতরা অনেকেই বলছেন খাদ্যে ভেজাল দেয়ার প্রবণতা মানুষ হত্যার চেয়েও ভয়াবধহ। কারণ কাউকে গুলি মেরে হত্যা করলে সে একবারেই মরে যাচ্ছে। আর খাদ্যে ভেজালের কারণে একজন মানুষকে ধুকে ধুকে পুরো জীবন যন্ত্রণা ভোগ করে মরতে হচ্ছে। এছাড়াও চিকিৎসা খাতে দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর বিদেশ চলে যাচ্ছে। পরিবার, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র এ সমস্ত আক্রান্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছে না। অথচ কার্যকরভাবে এ প্রবণতা বন্ধ বা হ্রাস করাও যাচ্ছে না, যা ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাদ্যে ভেজাল, দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে শুন্যসহনশীলতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাদ্যে ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং বিক্রয়কে ‘দুর্নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি হাইকোর্টও খাদ্যে ভেজালকে দুর্নীতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এসব ঘোষণায় দেশের নাগরিক হিসাবে আমরা খানিকটা স্বস্তি বোধ করছি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটছে তা দেখার বিষয়। জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোয় (এসডিজি) ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ’কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিফলন কতটুকু হচ্ছে আমরা সবাই জানি। নকল ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর খাদ্যে-পণ্যে বাজার সয়লাব। পণ্যের প্যাকেটে উৎপাদনের তারিখ না থাকা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয় করা, বেশি দাম রাখা, ফ্রি ডিসকাউন্টের নামে প্রতারণা, জেনেশুনে ভেজাল পণ্য বিক্রয় করা, এক পণ্যের দরদাম ঠিক করে অন্য পণ্য দেয়ার মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। এমনকি অসম্ভব বা অবাস্তব পণ্যের অফার-বাহারী বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের পকেট কাটার দৃষ্টান্তও কম নয়।
তাছাড়া ফরমালিন, কার্বাইড, দেয়ালের রঙ, শিল্পে ব্যবহৃত রঙ ও লবন, বিষাক্ত কেমিক্যাল, পোড়া মবিল, টেস্টিং সল্ট ইত্যাদির মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক খাদ্যে, ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংশে ব্যবহার করে আমাদের হার্ট, কিডনি, লিভার, ফুসফুসকে অকার্যকর করে দিচ্ছে। ডায়াবেটিস রোগ এখন অতি সাধারণ রোগে পরিণত হয়েছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও প্যাথলজিক্যাল টেস্টে মানহীন ও ভেজালের ছড়াছড়ি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নামক মূল্যসন্ত্রাসী চিহ্নিত হলেও বিচার হতে যুগের পর যুগ লেগে যায়। ফলে সাধারণ মানুষ অনেকটা নিয়তি ভেবে সবকিছু মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
দেশের ‘ভোক্তারা’ সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জনগোষ্ঠী হলেও সরকার প্রতিনিয়ত নানা বিষয়ে নীতি নির্ধারন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ একেবারেই নগন্য।
এ অবস্থায় ভোক্তাস্বার্থ বিবেচনা, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের স্বার্থের বিষয়টি তুলে ধরা, ভোক্তাস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন, চাহিদা, উৎপাদন, আমদানির সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষণ; সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে দরিদ্র, স্বল্প আয় ও নিম্নমধ্যবিত্তের ভোক্তারা যাতে বঞ্চিত না হয় সে লক্ষ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্দেশ্যে ১৫ থেকে ২০টি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিহ্নিত করে সেসব খাদ্য-পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব অর্পণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি পৃথক ডিভিশন অথবা পৃথক স্বতন্ত্র একটি ‘ভোক্তা অধিকার বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ সৃষ্টি করা উচিত। পৃথক মন্ত্রণালয় থাকলে অবশ্যই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতি নির্ধারক মহলে ভোক্তাস্বার্থের দিকগুলো বেশি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আসবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শনের স্বার্থে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

এস এম নাজের হোসাইন ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট