টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তে ফের বড় ধরনের অনুপ্রবেশের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির চলমান সংঘাত দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় অনুপ্রবেশের আশংকাও বাড়ছে। মিয়ানমারের সংঘাতে আতঙ্ক যেন পিছুই ছাড়ছে না। মিয়ানমারের মংডু এলাকার আরও সাড়ে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা ওঁৎপেতে আছে টেকনাফ সীমান্তের ওপারে। টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে তৎপর সীমান্তবর্তী কয়েকশ দালাল। এ অবস্থায় তাদের প্রতিরোধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে নাফ নদীতে টহল জোরদার করেছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপ জেটির প্রবেশদ্বারে বাঁশ দিয়ে দেয়া হয়েছে ব্যারিকেড। কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না জেটিতে। সতর্ক অবস্থানে টহল দিচ্ছে বিজিবি। টেকনাফ এবং নাফ নদী সীমান্তবর্তী ওপারে নলবুনিয়া, পেরাংপ্রু, নুরুল্লাপাড়া, আজিজের বিল, কাদির বিল, মেগিচং, মাংগালা, ফাদংচা এবং হাইসসুরাতা অঞ্চলে এসব রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং উপকূলরক্ষী কোস্টগার্ডের কঠোর অবস্থানের কারণে অনেক চেষ্টা করেও বাংলাদেশের তুমব্রু-ঘুমধুম, উখিয়ার রহমতের বিল-থাইংখালী, টেকনাফের হোয়াক্যং-খারাংখালী সীমান্ত দিয়ে কোনও রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫৪ কিলোমিটার বিস্তৃত নাফ নদী এখন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে দালালদের টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব রোহিঙ্গাকে কৌশলে বাংলাদেশে নিয়ে আসার তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে সীমান্তবর্তী দালাল চক্র। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি এসব দালাল চক্রকে প্রতিরোধই এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দালালদের প্রতিরোধে নাফ নদীতে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে।
২০১৭ সালে উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়া এবং টেকনাফের নাফ নদী দিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বাংলাদেশে। সংঘবদ্ধ দালাল চক্র প্রথম দিকে মাছ ধরা নৌকা এবং ট্রলার দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিল। ইয়াবা চোরাচালান ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোর অংশ হিসেবে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারের মংডু এলাকায় থেমে থেমে গোলাগুলি ও গোলাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। যার বিকট শব্দ ভেসে আসছে এপারে। সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে দিনরাত কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝে ওপারের ছোড়া গোলা বাংলাদেশেও এসে পড়ছে। হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়াতে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে।
শাহপরীরদ্বীপের বাসিন্দা জসিম মাহমুদ বলেন, ‘শনিবার ৫ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। এরপর থেকে সীমান্তে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না শাহপরীরদ্বীপ জেটি ঘাটে। থেমে থেমে মিয়ানমারে গোলাগুলি হচ্ছে। যার কারণে আতঙ্কে নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ রয়েছে। নাফ নদীতে শত শত ট্রলার নোঙর করা আছে। কেউ যেতে পারছেন না মাছ শিকারে। অনেকের জীবিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা’।
জেলে আব্দুর রহমান বলেন, ‘নাফ নদীতে এক হাজারের বেশি ট্রলার রয়েছে। এসব ট্রলারে মাছ শিকার করে ৫ হাজার জেলে। কিন্তু এখন এরমধ্যে অনেকে বেকার। মিয়ানমারের এসব কা- আর সহ্য করতে পারছি না। এভাবে আর কতদিন যাবে। আমরা কোথায় যাব? সীমান্ত সড়কে প্রতি ১০ ফুট পর পর অবস্থান করছে বিজিবি। আর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদীতে জলযান নিয়ে টহল জোরদার করেছে কোস্টগার্ড-বিজিবি’।
টেকনাফের কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার এইচএম লুৎফুল লাহিল মাজিদ বলেন, ‘মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে নাফ নদীর সীমান্ত দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। দালাল চক্র যেন সক্রিয় হতে না পারে, সে জন্য আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জেলে সমিতির সভাপতিদের ডেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে’।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘এখানে যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আছে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকে মিয়ানমারে রয়েছে। তাদেরকে এ দেশে আনার একটি প্রচেষ্টা পুরাতন রোহিঙ্গাদের মধ্যে থাকতে পারে। বিষয়টি বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ এবং স্থানীয় সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিনিধি, দালাল কেউ যাতে কাউকে বাংলাদেশে প্রবেশ করাতে না পারে, সেদিকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে’।
পূর্বকোণ/পিআর