খাদ্য
কুকুরের লেজটাই নড়তে দেখা গেল প্রথমে। তারপর পিঠ, পুরো গা।
প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম বাটি। বাটিতে মুরগির পালক যুক্ত পাখনা।
কুকুরটা গাপুস-গুপুস খাচ্ছে। যেন অনেকদিন অভুক্ত। কিন্তু শহরের কুকুরের এ রকম অভুক্ত থাকার কথা না।
কুকুরের সামনে একটা কিশোর। তার সামনে পলিথিনে অনেক পাখনা। হয়ত কোনো হোটেল বা পথের পাশে পেয়েছে।
সে একটার পর একটা দিচ্ছে। কুকুরটা অমনি গপ করে মুখে দিচ্ছে। গলায় আটকাবে কি আটকাবে না, দেখছে না। আশেপাশে বেশ কয়েকজন মানুষ। কারোর দিকে ওটার খেয়াল নেই।
ওরা টোকাই। কাঁধে বস্তা। পাখনা খাওয়ানো ছেলেটা ওদের সঙ্গী। আরো কয়েকজন তরুণ দর্শক গভীর মনোযোগে দেখছে।
ছেলেটা পলিথিন থেকে পাখনা বের করে বলে, মাইরা ফালায় গো, খাইয়া ফালায় গো।
কী মারে? বন্ধুর কাছ থেকে এমবি কার্ডের হিসাব নিতে নিতে তরুণটা জিজ্ঞেস করে।
সবাই সবাইরে মাইরা ফালাইতাছে।
তরুণটা হু হু করে হাসে। বলে, কে কাকে মারে দ্যাখা তো যায় না। তারপর বলে, ওই ব্যাটা, তুইও একটা খাইয়া ল।
জামালখান এলাকায় ধাক্কাধাক্কি করে দাঁড়িয়ে আছে খাবারের দোকান। ভাজা-পোড়ার গন্ধ। এত খাবার কে খায়?
মাঘের সন্ধ্যায় চোখ রেখে কুকুরটা হয়ত একটু দম নেয়। হয়ত বলে, মানুষ মানুষকে খাচ্ছে চিবিয়ে চিবিয়ে।
আজ শীত কম। অদূরে মায়ের কোলে পাঁচ-ছয় মাস বয়সী শিশু। অবাক তার চোখ। শিশুটি কী দেখছে?
এখন মানুষের যেমন ভঙ্গি, কুকুরটারও তেমন অবস্থা। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না; শুধু খেয়ে যাচ্ছে।
আগে মানুষ মুরগি খেত; এখন খায় চিকেন। আগে মানুষ পান্তাভাত খেত; এখন খায় ইয়াবা, বাবা। ক’দিন পর আরো কত কি খাবে!
মানুষ ও কুকুরের দাঁত-মুখ খিঁচানো, চিবানো থেকে নানা কথা বেরিয়ে আসে।
দুই চোখে আশ্চর্য দুটি মার্বেল, নাক শিকনিতে ভরা, শিশুটি অবাক তাকিয়ে রয়।
ফাঁদ
আমরা কয়েকজন নারী-পুরুষ উত্তর বিল পেরিয়ে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি জানি না। তবে হাঁটছি পশ্চিম দিকে।
এক লোক বলল, সামনে মদ পাওয়া যাবে।
মেয়েদের কেউ কেউ বলল, আমরা খাব। কেউ নাক কুঁচকে মুখে ঘৃণা এনে বলল, না না।
সামনে দেখি একটা ফাঁদ। ফাঁদের গর্তে আটকে আছে একটা মহিষ। মাথায় ও শিঙে রশি বাঁধা। ওমা! মহিষের পাশে একটা লোকও আটকে আছে। শক্তিশালী দেহ, চোখ-মুখ ভীষণ।
আমরা অবাক হয়ে তাকে দেখি। আপনি কে?
লোকটা বলে, ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে। তারপর বলে, আমি ভীম।
ভীম!
কৈবর্ত রাজা ভীমের নাম শোননি?
তাকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করি। তিনি রেগে গরগর করতে করতে মহিষের মাথার কাছে চলে যান। বলেন, সেনদের শয়তানিতে স্বাধীনতার সাধ ধুলায় মিশে গেল।
মহিষটা রক্তচক্ষু মেলে তাকায়। শিং নেড়ে ঢুসি মারবেÑএ সময় ভীম ভাস্কর্য হয়ে যান। ডান হাত ঊর্ধ্বে তোলা। হাতে দা।
আমরা সামনে গেলে ভীম প্রাণ খুলে হাসেন। দা দিয়ে আমার ডান পায়ের গোড়ালি কেটে ফেলতে চান। তবে কাটেন না।
হেসে বললেন, ভয় দেখালাম।
দৌড়ে জুগিপাড়ার পুকুরপাড়ে উঠে যাই। হাঁফাতে হাঁফাতে বেলতলায় বসি। একটা বেল পায়ের কাছে পড়ে।
কাঠবিড়ালি আমার দিকে তাকায়। তখন মামার কথা মনে পড়ে। মামা গতকাল বলেছে, মানুষ নানাভাবে নিজেকেই বড় দেখাতে চেষ্টা করে। যদি সে নিজের বাইরে একটু নজর দিত! তাহলে অনেকগুলো বিকেল, বিকেলের আলো মাখা মানুষ হরিণের মতো এসে হৃদয়ে ঢুকে পড়ত। বুঝতে পারি, হৃদয়ে ঢুকে পড়েছেন ভীম।
ফাঁদ থেকে উদ্ধার পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব?
কেউ জবাব দেয় না। প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি।
ভীমের চেহারায় মলিন ছায়া। তার দুঃখ রেখা আঁকে আমার মনে। রেখায় রং মেখে স্বপ্ন ফোটানোর চেষ্টা করি।
পূর্বকোণ/এসি