চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সৈয়দা আমাতুল্লাহ আরজু

পরিবর্তনের এক নিপুণ কারিগর

মো. ফারুক ইসলাম

৬ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৪১ পূর্বাহ্ণ

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর জাগো গো ভগিনী প্রবন্ধে সমাজের পিছিয়ে থাকা নারীদের শিক্ষিত হয়ে উঠতে তাগাদা দিয়েছিলেন। বেগম রোকেয়া বুঝতে পেরেছিলেন সমাজের একটা অংশকে বাদ দিয়ে কখনো একটা দেশ ও সমাজের উন্নয়ন সম্ভব না। তাই তিনি নারীদের শিক্ষিত হয়ে সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছিলেন। তবে যুগের সাথে সাথে বদলে গেছে পরিস্থিতি। বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা অবদান রাখছেন দেশের প্রতিটা সেক্টরে। বেগম রোকেয়া একদিন যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আজ সে স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন ঘটছে। এমন কোন জায়গা নেই নারীরা যেখানে অবদান রাখছেন না। আজ তেমন একজন নারীর কর্মকা- উপস্থাপন করছি যিনি আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে পাল্টে দিয়েছেন প্রত্যুন্ত অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র। তাঁর নাম সৈয়দা আমাতুল্লাহ আরজু। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যাঁর প্রথম কর্মজীবন শুরু। ব্যাংকের লোভনীয় চাকরি পেয়েও যিনি শিক্ষকতা পেশাটাকে বেছে নিয়েছিলেন ভালোবেসে। নগরীর চান্দগাঁওস্থ এন.এম.সি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০০৬ সালের ১৮ জানুয়ারি সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেই শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি বান্দরবান সদরে যোগদান করেন সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে। যোগদানের পর থেকে সেখানে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

নিজের দক্ষতা আর সততা দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন শিক্ষকদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই বান্দরবান সদর থেকে বদলি হয়ে চলে আসেন কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত বোয়ালখালী উপজেলার সহকারী শিক্ষা অফিসার হিসেবে। যোগদানের পর প্রথম দায়িত্ব পান উপজেলার খরণদ্বীপ ক্লাস্টারের। শুরুতেই শিক্ষকদের সাথে নিয়ে নেমে পড়লেন বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর উন্নয়ন, সৌন্দর্য বর্ধন, লেখাপড়ার মানোন্নয়ন, শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির কাজে। ক্লাস্টারের সকল শিক্ষকদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। এরই মধ্যে সহকর্মী আবু তোরাব মোহাম্মদ হোসাইনের বদলির কারণে বোয়ালখালীর দুর্গম এলাকা হিসেবে পরিচিত কানুনগোপাড়া ক্লাস্টারের দায়িত্বটা তাঁর কাঁধে চাপে। পিছিয়ে পড়া এলাকার স্কুলগুলোর অবস্থা পরিবর্তনে ওনার মতো একজন অফিসারের প্রয়োজনটা বুঝতে পেরে বদলি সহকর্মী আবু তোরাব মোহাম্মদ হোসাইন তাঁকেই কানুনগোপাড়া ক্লাস্টারের দায়িত্বটা দিয়ে যান। কানুনগোপাড়া ক্লাস্টারের অধিকাংশ বিদ্যালয় দুর্গম এলাকায় হওয়ায় যেখানে কোন নতুন অফিসার ওই ক্লাস্টারের দায়িত্ব নিতে চাইতেন না, সেখানে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন উক্ত ক্লাস্টারের দায়িত্ব। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পরিদর্শন করতে থাকেন একেকটা বিদ্যালয়। ক্লাস্টারের আন্তরিক শিক্ষকদের নিয়ে নেমে পড়েন বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নে। সাথে সাথে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও চলমান। শিক্ষকদের প্রেষণা দেয়ার জন্য প্রতি ক্লাস্টারে যেসব শিক্ষক খুব কম সংখ্যক ছুটি কাটিয়েছেন তাঁদের পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করলেন। স্লিপ, রুটিন মেইনটেন্যান্স এবং ক্ষুদ্র মেরামতের অর্থ যেন সঠিকখাতে খরচ হয় সে ব্যাপারে সার্বক্ষণিক তদারকি তো আছেই। শিক্ষকদের সঠিক সময়ে আগমন-প্রস্থান নিশ্চিত করতে শনিবার ছুটির দিনেও তিনি কাউকে না জানিয়ে স্কুল পরিদর্শনে বের হন। এতে করে শিক্ষকদের মাঝে এসেছে গতিশীলতা, বেড়েছে কাজের প্রতি স্পৃহা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রদত্ত প্রতিটা কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পাশাপাশি শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন অনেক সফলতা। ওনার নিদের্শনায় কাজ করে ২০১৭ সালে কানুনগোপাড়া ক্লাস্টারের তথা বোয়ালখালীর শেষ সীমানার দক্ষিণ কড়লডেঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. ফারুক ইসলাম জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে ফিলিপাইনে বৈদেশিক শিক্ষা সফর ও প্রশিক্ষণ শেষ করে এসেছেন। ২০১৮ সালে ওনার নির্দেশনায় খরণদ্বীপ ক্লাস্টারের চরণদ্বীপ দেওয়ান বিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসমাত ফারজানা জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে সম্প্রতি বৈদেশিক শিক্ষা সফর ও প্রশিক্ষণে মালয়েশিয়া ঘুরে এসেছেন। তাছাড়া শ্রেষ্ঠ ঝরে পড়া রোধ ক্যাটাগরীতে খরণদ্বীপ প্রমদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। শুধু তাই নয়, খেলাধুলায়ও তার ক্লাস্টারের স্কুলগুলোর সফলতা ঈর্ষণীয়। তার সহযোগিতা আর নিদের্শনায় ২০১৭ সালে দক্ষিণ কড়লডেঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলে শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে জেলা পর্যায়ে সেমিফাইনাল খেলে। এছাড়া উক্ত স্কুলের দুইজন খেলোয়াড় জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় আর সেরা গোলদাতার পুরস্কার লাভ করে। ২০১৯ সালে আবারো একই স্কুলের ছেলে ও মেয়েরা বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে জেলা পর্যায়ে অংশগ্রহণ করবে। শিক্ষকদের প্রিয় অফিসার হিসেবে সৈয়দা আমাতুল্লাহ আরজু’র সুনাম শুধু নিজ ক্লাস্টারের মধ্যে নয়, উপজেলার অন্যান্য ক্লাস্টারের শিক্ষকদের কাছেও তিনি অনুপ্রেরণার উৎস। শিক্ষকদের যেকোন সমস্যায় বন্ধের দিনেও ছুটে যান তিনি শিক্ষকদের কাছে। প্রতিটি বিদ্যালয়কে সাজানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলোর চেহারা পাল্টে দিয়েছেন তিনি। যেখানে সদরের স্কুলগুলো আধুনিক সুযোগ সুবিধায় সকলের নজর কাড়ার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে তার উল্টো চিত্র। খরণদ্বীপ ও কানুগোপাড়ার স্কুলগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের হলেও অবকাঠামো, সৌন্দর্য আর শিক্ষকদের কর্মদক্ষতায় সদরের স্কুলগুলোকে হার মানিয়েছে। তিনি বেশ কয়েকবার ক্লাস্টার পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর ক্লাস্টারের শিক্ষকরা তাঁকে ছাড়েননি।

তিনিও শিক্ষকদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে দুর্গম এলাকায় ছুটছেন প্রতিনিয়ত। নিশ্চিত করছেন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। তাঁর বন্ধু সুলভ আচরণ, সহযোগিতা আর পরিশ্রমের কারণে খরণদ্বীপ আর কানুনগোপাড়া ক্লাস্টারের অধিকাংশ স্কুল সেজেছে লাল-সবুজ রঙে। স্কুলের সামনে ফুলের বাগান করা, স্কুলের সম্পদ রক্ষনাবেক্ষণ করা, বিদ্যালয়ের সীমানা আর কমিটি গঠন সংক্রান্ত সকল সমস্যা সমাধান করে যাচ্ছেন দক্ষতার সাথে।

এসএমসি, পিটিএ কমিটির গতিশীলতা ঠিক রাখতে তিনি ক্লাস্টারের বিভিন্ন স্কুলের কমিটির সাথে বিদ্যালয়ের উন্নয়নে নান পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সকলকে নিয়ে একসাথে কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, মা ও অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টিতে তাঁর অবদানর অনস্বীকার্য। মা ও অভিভাবক সমাবেশের পাশাপাশি সেরা মা ও বাবাকে সম্মাননা প্রদানের নিয়ম চালু করেছেন তাঁর ক্লাস্টারে।

ইতিমধ্যে অনেক স্কুলে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কার্যক্রমটা চলছে। শিক্ষার্থীদের বিনোদনের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্কাউটিং কার্যক্রম, বিভিন্ন খেলাধুলা, বৃক্ষরোপণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খাতা, কলম, পোশাক প্রদানের জন্য এলাকাবাসীদের বিদ্যালয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সৈয়দা আমাতুল্লাহ আরজুর ভাষায়- তিনি যখন কাজ করেন তখন নিজেকে নারী হিসেবে দেখেন না। বরং একজন মানুষ হিসেবে সকল প্রতিকূলতাকে জয় করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে, শিক্ষকদের সাথে যদি সুন্দর ব্যবহার আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পক গড়ে তোলা যায় তাহলে কাজগুলো সহজেই আদায় করা যায়। এছাড়া শিক্ষকরাও আন্তরিকতা দিয়ে বিভিন্ন কাজে অংশ গ্রহণ করেন। পাঠক, আমরা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প পড়েছি। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালাদের মতো আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুৃষ আছেন যাঁরা নিজের কর্মদক্ষতা দিয়ে মানুষের মনে ঠাঁই করে নিয়েছেন। বোয়ালখালী উপজেলার সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার সৈয়দা আমাতুল্লাহ আরজুও তেমন একজন আলোর ফেরিওয়ালা।

যাঁর কর্মদক্ষতায় পাল্টে গেছে বোয়ালখালী উপজেলার দুর্গম এলাকার স্কুলগুলোর চিত্র। সে সাথে প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সফলতার রূপকার তিনি। যাঁর অনুপ্রেরণা আর সহযোগিতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্লাস্টারের শিক্ষকরা। এমন একজন পরিবর্তনের রূপকারের হাত ধরেই প্রাথমিক শিক্ষা অনেকদূর এগিয়ে যাবে, নিশ্চিত হবে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা এটাই প্রত্যাশা।

লেখক- শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট