চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বৃদ্ধাশ্রম যেন না হয় বাবা-মায়ের শেষ আশ্রয়স্থল

শাহিদা আক্তার জাহান

২৯ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

প্রতিনিয়ত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে আমাদের জীবন। বরফ বিক্রেতার যেমন যত সময় অতিবাহিত হয় তার পুঁজি তত নিঃশেষ হয়। আমাদের জীবনও টিক তেমনি। যতদিন যাচ্ছে আমাদের হায়াত তত হ্রাস পাচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে জন্মই যেহেতু হয়েছে মৃত্যু একবার আসবেই। জীবনের বিভিন্ন ধাপ শৈশব-কৈশোর, প্রৌঢ় এবং অবশেষে বার্ধক্য পেরিয়ে আমাদের মৃত্যু হয়। শৈশব কাটে মা-বাবার বড়দের স্নেহ ছায়ায়, কৈশোর কাটে অত্যন্ত দূরন্তপনায়; বড়দের শাসন-নির্দেশনায়। যৌবনকাল অতিবাহিত হয় নিজস্ব স্বাধীনতার নানামুখী তৎপরতায়। পৌঢ়ত্ব পার হয় জীবনে পাওয়া না-পাওয়ার হাল-খাতার হিসেব কষতে কষতে। তারপর আসে বার্ধক্য। বার্ধক্যকে বাড়ে নির্ভরতা। এই নির্ভরতা আপন জনের উপর। গর্ভে ধারণ করে যাদেরকে একটু পরশ স্নেহ আর যতেœ বড় করেছেন। স্বাবলম্বী করেছেন। পথ চলতে শিখিয়েছেন, জীবনের প্রতিক্ষার সাথে যুদ্ধ জয়ী হয়ে সফল হতে জোর দিয়েছেন। সদাচারণের প্রথম হকদার হলো পিতা-মাতা। এমনকি ধর্ম শাস্ত্রে এমনি বলা হয়েছে।

সন্তানের কাছে মাতা-পিতার প্রাপ্য অধিকারই তাদের হক। সৃষ্টি জগতে মানুষের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ প্রদর্শনকারী ব্যক্তি হচ্ছে মাতা-পিতা। তাই মাতা-পিতাই তার সর্বাপেক্ষা আপনজন। মাতা-পিতার প্রতিই সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য সর্বাধিক। সন্তানের জন্য অবধারিত মাতা-পিতার প্রতি অবশ্য পালনীয় এসব দায়িত্ব কর্তব্যই মাতা-পিতার হক রূপে আখ্যায়িত হয়।
মাতা-পিতার হক সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেনÑ ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কোন বস্তুকে শরীক করো না এবং মাতা-পিতার প্রতি উত্তম আচরণ কর।’ (নিসা ৩৬)

সন্তানের জন্য পিতা-মাতার খেদমতের সুযোগ বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। সহজে স্বর্গ পাওয়ার গ্যারান্টি যা পবিত্র কোরান হাদিসে বলা আছে।
একজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তার আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাবে। এটাই স্বাভাবিক। আমাদের উচিৎ যারা প্রবীণ, বয়োজ্যেষ্ঠ তারা যেন তাদের যথাযথ ভক্তি, সম্মান ও যতœ পান। আমাদের বুঝতে হবে যে দয়া করে না, অধিকার এবং আন্তরিকতার সাথে তাদের সময়গুলো আপনজন, ছেলে-মেয়েদের সাথে কাটে।
জাতিসংঘ ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ হিসেবে জনসংখ্যার ৬.১ শতাংশ প্রবীণ নর নারী, ২০২৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ১০.১ শতাংশ। উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশেও এর প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর হয়ে দেখা দিবে। বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘণবসতিপূর্ণ একটি দেশ, এদেশের অধিকাংশ প্রবীণ সাধারণ পরিবারে বসবাস করেন। এদের খাওয়া-দাওয়া ভরণপোষণ, চিকিৎসা ইত্যাদির ভার সন্তানদের উপর। আজ সামাজিক-পারিবারিক ও ধর্মীয় ম্ল্যূবোধের অভাবে এবং অর্থনৈতিক সামাজিক পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবার ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে করে প্রবীণরা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছে। অথচ এক-দু দশক আগেও আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সাথে সাথে এর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমারা যারা আমাদের বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে অবহেলা করছি, তাদেরকে পরিবারের বোঝা মনে করে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে রেখেছি তারাতো কখনো পরিবারের বোঝা ছিল না। তারা তো বৃদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে আসেননি। আজ তারা তো আমাদের জন্য বৃদ্ধ হয়েছে। তারাতো আমাদেরকে কখনো বোঝা মনে করেনি। আমরা সন্তানরা তাদের সবচেয়ে আদরের ছিলাম, অনেক ত্যাগ করে তারা আমাদেরকে সবচেয়ে ভাল খাবারটি খাইতে দিত। আমাদের মানুষ করার জন্য তারা বিন্দুমাত্র অবহেলা করেনি। তাদের সমস্ত আদর ভালোবাসা যতœ দিয়ে আমাদের বুকে আগলিয়ে লালন-পালন করে বড় করে তুলছেন। সন্তানের প্রতি বাবা-মার যে ভালোবাসা তা পৃথিবীর এক মাত্র নিস্বার্থ ভালবাসা। তাদের ভালবাসার তো কোন চাওয়া পাওয়ার হিসেব ছিল না। প্রিয় সন্তানদের জন্য তাদের জীবনটা উৎসর্গ করতেও কষ্টবোধ করেননি। তাদের দায়িত্ব পালন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু কালের পরিক্রমার আমরা হয়ে যায় বাবা-মার কাছে অতি নিষ্টুর নিমর্ম। ছোটবেলায় তাদের সমন্ত উপার্জন আমাদের জন্য ব্যয় করেন। বৃদ্ধ বয়সে আমাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখন আমরা তাদের করি অবহেলা। ভুলে যায় একদিন তারা পরিবারের অভিভাবক ছিল। আজ তারা আমাদের সংসাবের বোঝা। তাদেরকে অবহেলা করে এক প্রকার জোর করেই পাঠিয়ে দিই বৃদ্ধাশ্রমে। যে সন্তানদের মানুষ করতে দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন।

সে স্বপ্ন নিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন আসলে নিজ সন্তান সত্যিকারে মানুষ হয়নি অমানুষ হয়েছে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে প্রকৃতিও প্রতিশোধ নেন। কালের বিবর্তনে আমরা সবাই এক সময় বার্ধক্যে উপনীত হব। আমাদের সাথেও তেমন আচরণ হবে, যেমন আচরণ আমরা আমাদের বাবা-মার সাথে করেছি। আজ বৃদ্ধাশ্রমে আমরা যাদেরকে পাঠাচ্ছি তারাও একদিন সবাই কোনো না কোনো পরিবারের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। সময়ের বিবর্তণে আমাদের ভালোবাসা থেকে তারা বঞ্চিত। বৃদ্ধ বয়সে সবার একটাই চাওয়া সন্তান, নাতি-নাতিনদের নিয়ে আনন্দে সময় কাটাবে তারা। কিন্তু বাস্তবে এই সমাজ ব্যবস্থা শেষ বয়সে তাদেরকে জীবন্ত মৃত্যুর মুখে রেখে আসে। যে বাবা-মা অন্ধের যষ্ঠির মত আলো দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন সুখের আশায়, বৃদ্ধ বয়সে কেন ঠাঁই হয় না আমাদের সংসারে।
বৃদ্ধাশ্রমের মত ঘটনা কতটা অমানবিক, কতটা বিবেক বর্জিত এবং অপত্তিকর, সেটা সহজেই বুঝা যায়। সমাজ, রাষ্ট্র, লেখক এবং পরিবারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিৎ। পরিবার, প্রতিবেশী, রাষ্ট্র, লেখক, বুদ্ধিজীবীরা এ প্রতিরোধে শামিল হবেন এটাই সময়ের দাবী।
রাষ্ট্র এ ব্যাপারটা আইনের আওতায় আনতে পারে। কু-সন্তান, কু-পুত্র বধূকে গুরুতর শাস্তির আওতায় আনতে পারে। সোজাকথা হলো, সকলকে সকলের জায়গা থেকে এই অনাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে এবং প্রতিরোধ গড়তে হবে।

সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরা সংশোধিত হয়ে গেলে। মনে আনতে হবে। পিতা-মাতার কারণে আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। পৃথিবীর ভালো বাতাসে লালিত হয়ে বর্তমান জীবন পেয়েছি। তারাই আমাদের আলোর মুখে দেখিয়েছেন। নানা রকম প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন, দিন দিন বড় করে তুলেছেন। মানুষের মত মানুষ করে গড় তোলার চেষ্টা করেছেন; যদিও আমরা অনেকে মানুষ না হয়ে অমানুষই হয়েছি।

একথা সত্য যে, পাশ্চাত্যের মতো আমাদের দেশেও পিতা-মাতা-সন্তান সম্পর্কে কোথাও কোথাও ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করেছে। সে কারণে দেশে এখন দিন দিনই বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা। সে সংখ্যা যে অদূর ভষিষ্যতে আরও ফুলে ফেঁপে উঠবে না সেটাই বা কে জানে? কিন্তু তা হতে দেওয়া ঠিক হবে না।
আসলে মা-বাবা তার সন্তানদের জন্য যা করেন। তা তাদের পক্ষে জীবনেও শোধ করা সম্ভব নয়। বুড়ো বয়সে তারা চান একটু শান্তি, ভালবাসা ও সুন্দর আচরণ। এ বয়সে তারা একটু আদর, ঐ স্নেহমাখা ভালবাসা পেলেই যেন খুশি। মা-বাবা চান সন্তানরা যেন তাদের কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শেখেন। পালন করে। আমাদের মনে রাখা উচিৎ আজ যিনি সন্তান, তিনি আগামী দিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবা যেহেতু কোমলমতি হয়ে যান, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই প্রত্যেক সন্তানের চরম দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর যেন কোন

পিতা-মাতার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রমে না হয়। সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটি নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী। মনে রাখা সমীচিন যে, আমরাও একদিন বৃদ্ধ হব। আমরা যদি আমাদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি। আমাদের সন্তানরাও হয়তো একদিন আমাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। সুতরাং, আমাদের উচিত বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রম নয়, কাছে রাখা, ভালোবাসা, আমাদের শৈশবে তারা যেমনটি করেছিলেন। অতএব, বৃদ্ধাশ্রম নয় নিজ আবাসস্থলই হোক মা-বাবার শেষ আশ্রয়স্থল।

লেখক- সদস্য, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট