চট্টগ্রাম বুধবার, ০১ মে, ২০২৪

চবি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের বিদ্যমান সংকট ও সমাধানে করণীয়

ড. মো. আবুল কাসেম

৯ নভেম্বর, ২০২৩ | ৯:২৫ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালনা করে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তান ও পোষ্যদের উন্নতমানের পাঠদান করা। এক সময় প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ছিল সারা দেশ জুড়ে। আমাদেরও একটা প্রত্যাশা ছিল যে আমাদের ছেলে-মেয়েরা এমন একটা স্কুলে বা কলেজে পড়াশোনা করবে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পাঠদান করাবেন। বর্তমানে তার অবকাঠামো এবং শিক্ষার মান নিয়ে অভিভাবক মহল হতাশাগ্রস্ত। এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য সুপারিশসহ উপস্থাপন করা হলো।
অবকাঠামো : অবকাঠামোর দিকে তাকালে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে যে এটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান। যার কোন বাউন্ডারি ওয়াল নেই, নাম ফলকসহ গেট নেই, ছেলে মেয়েদের জন্য কম্পিউটার ল্যাব, মাল্টিমিডিয়া ও কমনরুম কোনটাই এখানে নেই। অনেকগুলো ক্লাস রুমের জানালা ভাঙ্গা, বৃষ্টির পানি অনায়াসে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়ে, ছাদ থেকে বিভিন্ন সময় ইট ও সুরকির স্তর খসে পরে, শিক্ষার্থীরা সবসময় আতঙ্কে থাকে। প্রবেশগেটের দিকে তাকালে মনে হবে তাকে দেখভাল করার কেউ নাই। কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে থাকা অবস্থায় এ প্রতিষ্ঠানটির ফলাফলের উপর সবার দৃষ্টি থাকতো, আজ তাকে ক্যান্সারের মতো সবাই এড়িয়ে চলে। তার এই পরিণতির জন্য আমরা শিক্ষকরাই অনেকাংশে দায়ী। কয়েকবছর আগে এক অনুষ্ঠানে এক শিক্ষক তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে যাচ্ছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে একটি ছেলে বাসায় এসে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল আব্বু স্কুলটাতো আগের জায়গায়ই আছে, এটা কোথায় এগিয়ে যাচ্ছে? এই কোমলমতি বাচ্চার প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের কাছে আছে?
বর্তমানে প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রায় ১৩০০ ছাত্র-ছাত্রীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১৯ জন ও শিক্ষিকা আছেন ২১ জন। প্রশাসনগুলো গত ২৬/২৭ বছরে প্রায় ৩৪ জনকে বিষয়ভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নিয়োগ প্রদান করেছেন বলে অভিযোগ আছে। যাদের মধ্যে আমাদের শিক্ষকদের আত্মীয়-স্বজনই বেশি। অন্যদিকে কলেজ শাখায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য স্থায়ী কোন শিক্ষক নাই, আছেন ১০ জন খণ্ডকালীন শিক্ষক। উল্লেখ্য, ২০১২ সালে ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইইআর) প্রতিষ্ঠা করে কলেজের ১৮ জন শিক্ষককে আইইআর এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার ফলে কলেজে শিক্ষকের পদসমূহ বিলীন হয়ে যায়। শর্ত ছিল যে এই ১৮ জন শিক্ষক বিএড ও এমএড ডিগ্রি সম্পন্ন করবেন এবং আইইআর এর ক্লাসের পাশাপাশি কলেজের ক্লাসসমূহও চালিয়ে নেবেন। পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় সব শর্তই শিথিল হয়ে যায়। প্রথমদিকে কলেজের কিছু ক্লাস নিলেও বর্তমানে তারা কোন ক্লাস নিচ্ছেন না। এরই মধ্যে অনেকের প্রমোশন হয় এবং ৬৫ বছরের পূর্ণ করে ৬ জন শিক্ষক অবসরেও চলে যান। প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই ৬টি পদ কি কলেজ ফিরে পাবে? নাকি আইইআরেই থেকে যাবে? এ অবস্থায় কলেজের শিক্ষার গুণগতমান কিভাবে রক্ষা করবে বা তার দায়িত্বই বা কে নেবে?
স্কুল এবং কলেজের দুরবস্থার কারণে কয়েকশত সিনিয়র শিক্ষক তাদের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এই প্রাণপ্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে এসেছেন। প্রায় ৪৫ জন শিক্ষক ক্যান্ট পাবলিক আবাসিক এলাকায় বসবাস করছেন। বর্তমানে শিক্ষক, কর্মকর্তারা যারা ক্যাম্পাসে বসবাস করছেন তারাও তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে চবির স্কুলে না পাঠিয়ে শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তাকে শহর এবং ক্যাম্পাস উভয় স্থানেই বাসস্থানের ব্যবস্থা রাখতে হচ্ছে। আবার ছেলেমেয়ের স্কুলের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে অনেক শিক্ষককে কয়েকবার বাসা বদল করতে দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ চট্টগ্রাম শহরে ভাল স্কুলের ব্যবস্থা করতে না পেরে তাদের পরিবারসহ সন্তানদেরকে ঢাকায় স্থানান্তর করতে হচ্ছে। যার ফলশ্রæতিতে ছেলেমেয়েরা শারীরিক-মানসিক এবং অভিভাবকরা আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তারই বিরূপ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, গবেষণা ও ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিবেশের উপর। গত কয়েকবছর আগেও ৩০ থেকে ৪০ জন সিনিয়র শিক্ষক সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস ক্লাবে সচরাচর দেখা যেত। ক্যাম্পাসের যেকোনো সমস্যায় বা দুর্ঘটনায় তারা এগিয়ে আসতো। সিনিয়র শিক্ষকদের ক্যাম্পাস ছাড়ার প্রবণতাকে রোধ করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মানের অবক্ষয় দেখা দিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হলো ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মিলনমেলা, যেখানে জ্ঞান চর্চার আদান-প্রদান ঘটে। ক্যাম্পাসে বসবাসরত শিক্ষকরাই বিভাগের কাজ-কর্মে, গবেষণা ও প্রকাশনায় অধিক সময় দিতে পারেন। শহরে বসবাসকারী শিক্ষকদেরকে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় রাস্তায় ব্যয় করতে হয়।
বৈষম্য : উদাহরণ স্বরূপ, চবি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদেরও চাকরিতে যোগদানের পর ডেপুটি রেজিস্টার পর্যন্ত পদোন্নতি পাওয়ার সুযোগ আছে এবং যাদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬২ বছর। অন্যদিকে অনার্স/মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে যারা চবি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তারা চাকুরীজীবনে কোন উল্লেখযোগ্য পদোন্নতি ছাড়াই চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের মত ৬০ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন। যারা আমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ গড়ার মূল কারিগর, যাদেরকে আমরা স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে ‘স্যার’ হিসেবে সম্বোধন করি, তারা যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা আমাদেরই দায়িত্ব।
সুপারিশ : ১) নাম ফলকসহ প্রবেশ গেট, বাউন্ডারি ওয়াল ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর দ্রুত ব্যবস্থা করা। ২) কলেজের ১৮ টি পদ কলেজকে ফিরিয়ে দিয়ে নিয়ম তান্ত্রিকভাবে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা। নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা। ৩) স্কুলে কর্মরত ৩৪ জন শিক্ষক যারা নির্বাচনী বাছাই পরীক্ষা ছাড়া যোগদান করেছেন, তাদেরকে মাউসি ও অন্যান্য চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ল্যাবরেটরি স্কুল এবং কলেজের মানদণ্ডের ভিত্তিতে নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করে স্থায়ীভাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য যে, পদের অতিরিক্ত শিক্ষক বা যারা নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবেন তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় অন্যত্র আত্তীকরণের ব্যবস্থা করা যেহেতু তারা সকলেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য এবং যারা দীর্ঘদিন যাবত সেবা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
৪) চবির স্কুল শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬০ এর পরিবর্তে চবির অন্যান্য কর্মকর্তাদের মত ৬২ বছরে উন্নীত করা। ৫) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের আদলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ও বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ১ জন প্রিন্সিপাল ও ২ জন ভাইস প্রিন্সিপাল স্থায়ীভাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করা। স্কুল এবং কলেজের অন্যান্য খালি পদগুলোও একই নিয়ম অনুসরণ করে পূরণের ব্যবস্থা করা।
সুপারিশ ২,৩,৪ ও ৫ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মাউশি, শিক্ষা বোর্ড, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, লিডারস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা, যারা উক্ত কাজগুলো বাস্তবায়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবেন এবং প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে পরিচালনার দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন। আমার বিশ্বাস, এই ক্ষুদ্র অবহেলিত প্রতিষ্ঠানটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ, শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

লেখক: মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট