চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বোকা বানানোর শুরুটা কীভাবে হয়েছিল জানেন?

অনলাইন ডেস্ক

৩১ মার্চ, ২০২৩ | ১০:৪৯ অপরাহ্ণ

April Fool’s Day History: পয়লা এপ্রিল হল ‘এপ্রিল ফুল ডে’, বোকা বানানোর শুরুটা কীভাবে হয়েছিল জানেন? পহেলা এপ্রিল অনেকেই ফলাও করে প্রচার করেন— “এইদিন স্পেনে মুসলিমরা পরাজিত হয়, ইসাবেলা এবং ফার্দিনান্দ মুসলিমদেরকে বোকা বানিয়ে একটি মসজিদে ঢুকিয়ে হত্যা করেন। সেই থেকে খ্রিস্টানরা এই দিনে মুসলিমদের বোকা বানিয়েছে বলে তারা ‘April Fool’ বা ‘এপ্রিলের বোকা’ দিবস পালন করে।”

আমি মেনে নিতে কোনো সঙ্কোচ করছি না, এরকম ভিত্তিহীন তথ্য একসময় আমিও শেয়ার করেছি। এখন সত্যটা জানার পরও যদি মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরি, তাহলে তো ঐ যে মুসলিমদেরকে যারা ‘বোকা’ বলে, তারা বলবে, আমরা তো ঠিকই বলি।

 

মুহাম্মদ তারিক গাজী নামের কানাডার একজন সাংবাদিক এবং ইতিহাসবিদ ‘এপ্রিল ফুল’ নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন। তার লেখার শিরোনাম- Truth About April Fool’s day and Muslim Representative Method of Scientific Inquiry.

 

এতে প্রথমাংশে তিনি মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা নিয়ে আক্ষেপ করেন। কোনো প্রকার গবেষণা ও প্রমাণ ছাড়া মুসলিমরা একটা ভিত্তিহীন তথ্য দিনের পর দিন প্রচার করে যাচ্ছে দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন তার কাছে মেইল করে এটা নিয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করেছেন। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তোবা সাধারণ মানুষজন এটা নিয়ে মাতামাতি করছে। কিন্তু যখন জানলেন বিশ্বের নামকরা মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রফেসররাও এই তথ্য প্রচার করছে, তখন তার খারাপ লাগে। তিনি ভাবেন, আমাদের গৌরবময় গ্রানাডার পতন কবে হলো— সেই তারিখটিও কি তারা জানেন না?

 

স্পেনে মূরদের শাসনের পতন হয় ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি (পহেলা এপ্রিল নয়)। বিখ্যাত গবেষক ফিরাস আল-খাতিব তার ‘Lost Islamic History: Reclaiming Muslim Civilization from the Past’ বইয়ে গ্রানাডার পতনের তারিখ উল্লেখ করেন অবশ্য ১ জানুয়ারি ১৪৯২ (পৃষ্ঠা ১০২)।

 

Joseph F. O’Callaghan এর ‘A History of Medieval Europe’ বই থেকে উদ্ধৃত করলে আমরা দেখতে পাই: “১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি ইসাবেলা আর ফারদিনান্দ গ্রানাডায় প্রবেশ করলেন। সেদিন তারা গ্রানাডার শাসক দ্বাদশ মুহাম্মাদের কাছ থেকে গ্রানাডার চাবি নেন।”

 

B.B Synge তার ‘Brave Men and Brave Deeds’ আর্টিকেলে লিখেন- “আবু আব্দুল্লাহ (মুহাম্মাদ দ্বাদশ) জানুয়ারির দুই তারিখ (১৪৯২) আত্মসমর্পণ করেন।”

 

সালমা খাদ্রা জায়ূসি সম্পাদিত ‘The Legacy of Muslim Spain’ বইয়ে Vincent Barletta তার আর্টিকেল ‘About the Moriscos’ এ লিখেন, “ক্যাথলিক যাজকরা দীর্ঘ আটশো বছর পর ১৪৯২ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রানাডা পুনরুদ্ধার করে।”

 

বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ, গবেষকরা একমত যে, গ্রানাডায় মুসলিমদের (মূর) পতন হয় ১৪৯২ সালের জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ (অথবা এর আগেরদিন)। গ্রানাডায় মুসলিমদের পতন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিগুলোর একটি। আমাদের বিজয়ের দিনগুলোর পাশাপাশি পতনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুসলিমকে জাগ্রত করা উচিত। তাই বলে, ভুল ইতিহাস বলার দরকার কী? যেটা সত্য সেটা বলুন।

 

ওই ভুল ইতিহাসের রেফারেন্স দিয়ে সবাই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান— সারা বিশ্বে ‘এপ্রিল ফুল’ পালন করা হয় মুসলিমদের বোকা বানানো হয়েছে এজন্য। এটা হলো ইতিহাসের আরেকটা হাস্যকর উক্তি।

 

কেন পালন করা হয় এপ্রিল ফুল
এপ্রিল ফুল কেন পালন করা হয়— এটা নিয়ে বেশ কয়েকটি ‘থিওরি’ আছে। তারমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় থিওরি হলো- ক্যালেন্ডার পরিবর্তন।
১৫৬৪ সালে ফ্রান্স তাদের ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে মার্চের শেষে বছর শুরু হতো। কিন্তু, এটা পরিবর্তন করে বছর শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১ জানুয়ারি থেকে। এই সিদ্ধান্ত অনেকেই মানতে পারলো না। তারা আন্দোলন শুরু করে বললো- ২৫ শে মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত তারা আগের মতো নিউ ইয়ার পালন করবে। যারা পরিবর্তন মেনে নিয়েছিলো, অর্থাৎ সরকারপক্ষ বিরোধী পক্ষের সাথে মজা নিতে চেয়েছিলো। যারাই নববর্ষ পালন করে বিরোধিতা করতে চেয়েছে, সরকারপক্ষ তাদের পিঠে কাগজের মাছ (Paper Fish) লাগিয়ে দিয়েছিলো। সেই থেকে ভিক্টিমদের বলা হতো- Poission d’Avril বা এপ্রিলের ফিশ [April Fool’s Day, Encyclopedia Britannica, Retrieved april 4, 2013]।

 

বোকা বানানোর থিওরি
ক্যালেন্ডার থিওরি ছাড়াও এই দিনে মানুষকে বোকা বানানোর আরো কিছু থিওরি আছে। যেমন: রোমান মিথ, ব্রিটিশ গথাম থিওরি, জার্মান থিওরি, ডাচ থিওরি। ইউরোপ-অ্যামেরিকার বেশিরভাগ দেশে এই দিনে মানুষের সাথে Prank করে বোকা বানানোর প্রচলন আছে। ইউক্রেনের Odessa শহরে তো এপ্রিল ফুলের জন্য সরকারি ছুটি দেওয়া হয়!

কিন্তু, পারতপক্ষে একটা দেশেও ‘মুসলিমদের বোকা বানানোর উৎসব’ হিসেবে কেউ এপ্রিল ফুল পালন করে বলে আমার জানা নেই। তাহলে এপ্রিল ফুল নিয়ে আমাদের ‘অবস্থান’ কী হওয়া উচিত? এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এই দিন উপলক্ষে যা যা করা হয়— সেগুলো মুসলমানদের বিশ্বাস ও কর্মের সঙ্গে যায় না। এই দিন মিথ্যা বলে মানুষকে বোকা বানানো হয়। আবার একজন আরেকজনকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে এবং তাকে সবার সামনে ‘অপদস্থ’ করে।

 

মিথ্যা বলা মুমিনের সঙ্গে যায় না
শুধু এপ্রিল ফুল কেনো, প্রতিদিনের জন্য আমাদের এই হাদিসটি মনে রাখা দরকার। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সেই লোক ধ্বংস হোক! যে মানুষকে হাসানোর উদ্দেশ্যে কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা বলে। সেই লোক নিপাত যাক, সেই লোক নিপাত যাক!’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৫)

 

রাসুল (সা.) মিথ্যা বলতে শুধু নিষেধই করেননি, বরং যে লোক হাসানোর জন্য মিথ্যা কথা বলে— তাকে তিনি অভিশাপ দিয়েছেন। এমন ‘গুরতর’ পাপ খুব কম আছে, যেগুলোর ব্যাপারে রাসুল (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। মিথ্যা কথা তারমধ্যে একটি। মিথ্যার পরিণতি সম্পর্কে আরেকটি হাদিসে তিনি বলেন— 

মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়, আর পাপ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। মানুষ মিথ্যা বলতে বলতে আল্লাহর কাছে ‘মহামিথ্যুক’ বলে গণ্য হয়

 

(বুখারি, হাদিস : ৬০৯৪)

তাই আসুন, আমরা এই দিন সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মিথ্যা-খেলায় অংশ নেবো না। পাশাপাশি তথ্য-প্রমাণ ছাড়াও কোনো কিছু প্রচারে জড়াবো না। এই বিষয়েও হাদিসে নির্দেশনা আছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতোটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে (যাচাই না করে) তা বলে বেড়ায়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৯২)

 

পূর্বকোণ/রাজীব/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট