চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কোরআনি চরিত্রমালার জীবন্ত প্রতীক মুহাম্মদ (সা.)

৬ অক্টোবর, ২০২২ | ৭:৩১ অপরাহ্ণ

উত্তম চরিত্র ও সদাচরণের কারণে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে সবাই বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী বলে সম্বোধন করতেন। তিনি তাঁর জীবনে কখনো কোন মিথ্যা বলেননি। মক্কার কাফেররা পর্যন্ত তাই তাঁকে আল-আমিন ডাকত। শত্রুরাও কোনদিন তাঁকে মিথ্যাবাদী বলার সুযোগ পায়নি। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ধৈর্য্যের কোন কমতি ছিলো না। তাঁর মত সাহসী মানুষ পৃথিবীতে নেই। আল্লাহপাক তাঁকে সুন্দর চরিত্র দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সব কাজই হয়েছে কোরআনমতে। তিনি কোরআনের বাইরে কোন কথা বলতেন না।

রাসূল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবহ শব্দে বলেন, ‘তাঁর চরিত্র ছিল আল-কোরআন।’ অর্থাৎ কুরআন মাজিদে যে সকল উত্তম চরিত্র ও মহান নৈতিকতার উল্লেখ রয়েছে সে সবই তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। কুরআনের বর্ণিত চরিত্র অপেক্ষা উত্তম চরিত্র আর কী হতে পারে? তিনি ছিলেন পবিত্র কোরআনি চরিত্রমালার জীবন্ত প্রতীক।

 

মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি এক মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সূরা ক্বালাম : ৪)
‘হে মুহাম্মদ! আমি তোমাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (আম্বিয়া : ১০৭)।
‘আমি তো তোমাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সর্তককারীরূপে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা উপলব্ধি করে না।’ (সূরা সাবা : ২৮)
‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সূরা আল-আহজাব : ২১)

ফিজারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স ছিল ১৫ বছর। এই যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তাঁর কিছুই করার ছিলনা। সে সময় থেকেই তিনি নির্মমতা কমানোর চিন্তাভাবনা শুরু করেন। ওই বয়সেই তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিশ্বস্ততার কারণে শত্রুরা পর্যন্ত নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে তাদের দামী জিনিসপত্র আমানত রাখতো। কারণ তারা জানতো নবী মুহাম্মদ (সা.) কখনও আমানতের খেয়ানত করেন না। মহৎ বৈশিষ্ট্যের কোন কমতি ছিল না তাঁর মাঝে।

 

তৎকালীন সময়ে খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন ধনবতী, ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী মহিলা। তিনি তার পুঁজি দিয়ে লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্বভিত্তিক যৌথ ব্যবসা করতেন। খাদিজা (রা.) মহানবীর (সা.)-এর সততা ও উত্তম চরিত্রের কথা জানতে পেরে তাঁকে পুঁজি নিয়ে সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। মহানবী (সা.) এই প্রস্তাব গ্রহণ করে দ্বিগুণ পুঁজি ও বিনিময় নিয়ে খাদিজার ক্রীতদাস ‘মায়সারাহ’র সঙ্গে সিরিয়ার পথে বাণিজ্যিক সফরে বের হন। বিগত সফরগুলোর তুলনায় ওই সফরে দ্বিগুণ লাভ হয়। নিজভূমিতে ফিরে ‘মায়সারাহ’ খাদিজার কাছে রাসূল (সা.)-এর বিশ্বস্ততা ও মহান চরিত্রের বর্ণনা দিলেন। খাদিজা (রা.), বিশেষত রাসূল (সা.)-এর সংস্পর্শে আসার পর তার সম্পদে যে সমৃদ্ধির চিহ্ন ফুটে উঠেছে, তা দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। তিনি তার বান্ধবী ‘নাফিসাহ’র মাধ্যমে রাসূল (সা.)-এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। রাসূল (সা.) এ ব্যাপারে তাঁর চাচাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলে তারা বিয়ে সম্পন্ন করেন। পরে খাদিজা (রা.) প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। কারণ তিনি জানতেন মুহাম্মদ (সা.) কখনও মিথ্যা বলেন না, তিনি মহৎ চরিত্রের অধিকারী।

রাসূল (সা.) ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে কুরাইশদের কাছ থেকে অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে ধৈর্যধারণ করেছেন। তার এই ধৈর্য অব্যাহত রেখেছিলেন দুঃখের বছর, যুদ্ধক্ষেত্র, ইহুদীদের ষড়যন্ত্র, ক্ষুধা ও অন্যান্য পরিস্থিতিতেও। কোন ষড়যন্ত্রই তাকে দুর্বল করতে পারেনি এবং কোনপক্ষই তাকে টলাতে পারেনি। তায়েফবাসীরা যখন মুহাম্মদ (সা.)-কে নির্মমভাবে রক্তাক্ত করে, তখনও তিনি তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য বদদোয়া দেননি। অথচ তায়েফবাসীর আচরণে ফেরেশতারা পর্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। ওই সময় পাহাড়ের ফেরেশতা তায়েফবাসীকে ধ্বংস করে দেওয়ার আবেদন জানান। কিন্তু মহানবী (সা.) নিষেধ করলেন।

 

ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নেয়ার নামই ক্ষমা। মহানবী (সা.) ক্ষমা করার এক চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিনে রাসূল (সা.) মক্কার লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছিলেন। তিনি বললেন, হে কুরাইশগণ! তোমরা আমার কাছ থেকে আজ কেমন ব্যবহার আশা করো? তারা বলল, সম্মানিত ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মত, তিনি বললেন তোমরা চলে যাও। আজ তোমরা মুক্ত। তারা তাকে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন, তিরস্কার, সামাজিকভাবে বয়কট করা এমনকি হত্যার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তিনি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন।

রাসূল (সা.) যুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থায় ছিলেন সকল মানুষের চেয়ে বেশি সাহসী। হযরত আলী (রা.) বলেন, যখন প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হতো, তখন আমরা রাসূল (সা.)-কে আড়াল নিয়ে আত্মরক্ষা করতাম। তিনি থাকতেন আমাদের মধ্য থেকে শত্রুদের সবচেয়ে নিকটতম ব্যক্তি। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে উহুদ ও হুনায়ন যুদ্ধে।

মুহাম্মাদ (সা.)-এর দানশীলতা ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। তিনি নিজের কাছে কিছু থাকলে কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। তিনি একসময় ইয়েমেনি একসেট পোশাক পরেছিলেন। একজন এসে পোশাকটা চাইলে তিনি বাড়িতে গিয়ে সেটা খুলে ওই লোকের জন্য পাঠিয়ে দেন। তার কাছে কেউ কিছু চাইলেই তিনি তা দিয়ে দিতেন। একবার একজন লোক তার কাছে এসে ছাগল চাইলে তিনি তাকে প্রচুর পরিমাণ ছাগল দিয়েছিলেন। যা দুই পাহাড়ের মধ্যকার স্থান পূর্ণ করে ফেলবে। এরপর লোকটা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, হে আমার সম্প্রদায় তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (সা.) এত বেশি পরিমাণে দান করেন, যে কখনও দারিদ্রতার ভয় করেন না।

মহানবী (সা.) সবসময় ন্যায়বিচার করেছেন। তিনি সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। একবার কুরাইশ বংশীয় মাখজুম গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়লে রাসূলুল্লাহ (সা.) তার হাত কর্তনের নির্দেশ দেন। আভিজাত্য ও বংশমর্যাদার উল্লেখ করে সে মহিলার শাস্তি লাঘবের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে তাঁর একান্ত স্নেহভাজন উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) সুপারিশ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বলেন, ‘তুমি কি আল্লাহর দণ্ডবিধির ব্যাপারে সুপারিশ করছ?’ অতঃপর লোকজনকে আহ্বান করে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জনগণ পথভ্রষ্ট হয়েছে। এজন্য যে তাদের কোন সম্মানিত লোক চুরি করলে তখন তারা তাকে রেহাই দিত। আর যখন কোন দুর্বল লোক চুরি করত, তখন তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই তার হস্ত কর্তন করে দিতাম।

 

বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন মহৎ চরিত্রের অধিকারী। তার ব্যবহার সকলকে মুগ্ধ করতো। দাস-দাসীদের সঙ্গে তিনি সবসময় ভালো ব্যবহার করতেন। কখনও কাউকে কটু কথা বলা তো দূরের কথা, কেউ তার বিরুদ্ধে কখনো কোন অভিযোগ করতে পারেননি। চরম শত্রুদের কাছেও তার এরকম গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে মুহাম্মদ (সা.)-এর আর্দশমতো জীবন-যাপনের তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

 

পূর্বকোণ/এএস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট