চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

উন্নয়নশীল দেশের প্রধান বিমানবন্দর কেমন হওয়া উচিত?

৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ | ৯:০০ অপরাহ্ণ

এম এ মতিন
একটি দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের সঙ্গে সে দেশের প্রধান গেটওয়ে বা প্রবেশ তোরণ হিসেবে কাজ করে। প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি যাত্রী এই বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ ও দেশ ত্যাগ করেন। এই বিমানবন্দরের সার্বিক কার্যক্রম ও সেবার মান একদিকে যেমন সে দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি তথা ব্যবস্থাপনার মান ও পরিধি ফুটিয়ে তোলে; অন্যদিকে বিমানবন্দরের সার্বিক কার্যক্রম সেই দেশের ভাবমূর্তি সম্পর্কে সবার কাছে, বিশেষ করে বিদেশি পরিভ্রাজকদের কাছে প্রাথমিক পর্যায়ে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে।

তদনুযায়ী আমাদের দেশের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (শাআবিব) যখন কোনো বিদেশি পা রাখেন, তখন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিমানবন্দরে প্রাপ্ত সেবার মান, প্রাপ্ত লজিস্টিকস এবং যে কজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে তার বা তাদের দেখা হয়েছে তাদের ভাবানুভূতি ও ব্যবহার দেখে।

কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাআবিবরে বর্তমান সেবা ও অব্যবস্থাপনা যাত্রীদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির পরিবর্তে দিনে দিনে নেতিবাচক মনোভাবের প্রবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এসব নিয়ে হরহামেশাই পত্রপত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বেশির ভাগ ফ্লাইট বিলম্বে ছাড়ছে। ফিরতি ফ্লাইটের যাত্রীরা লাগেজের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেল্টের সামনে অপেক্ষায় থাকছেন। এর পরও অনেকে পাচ্ছেন না লাগেজ। এক বেল্টের লাগেজ চলে যাচ্ছে অন্য বেল্টে। এক এয়ারলাইনসের লাগেজ চলে যাচ্ছে অন্য এয়ারলাইনসের বেল্টে। পর্যাপ্ত ট্রলি থাকলেও প্রয়োজনের সময় পাওয়া যাচ্ছে না। যাত্রীদের বোর্ডিং কার্ড ইস্যু নিয়ে চলছে অব্যবস্থাপনা।

উন্নত দেশের যে কোনো বিমানবন্দরের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, সেখানে যাত্রীসেবার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বেশির ভাগ বিমানবন্দরে একের অধিক আধুনিক টার্মিনাল আছে। প্রতিটি টার্মিনালে আছে যাত্রীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দেওয়ার জন্য একাধিক তথ্যকেন্দ্র, রেস্তোরাঁ, সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক রেস্টরুমের ব্যবস্থা, কেনাকাটার জন্য দৃষ্টিনন্দন দোকানপাট, মেডিক্যাল সেন্টার, ব্যাংক, পোস্ট অফিস, বিজনেস ক্লাস লাউঞ্জ, মাতৃসদন, ব্যাগেজ স্টোরেজ ব্যবস্থাসহ আরো অনেক কিছু। এয়ারপোর্টে যাত্রীদের দ্রুত সার্ভিস দেওয়ার জন্য আছে অল্প দূরত্বে পরপর সমান্তরালভাবে সার্বক্ষণিক বহমান চলন্ত সিঁড়ি। এসব সিঁড়ি ব্যবহার করে যাত্রীরা বিমান থেকে অবতরণের পরে অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে ইমিগ্রেশনের কাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ দ্রুত শেষ করতে পারেন। প্রতিটি টার্মিনাল চার-পাঁচতলাবিশিষ্ট, যার প্রতিটি তলায় যাত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন সেবার ব্যবস্থা থাকে। যেমন—কোনো তলায় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করে, কোনোটা যাত্রীদের লাগেজ পৌঁছানো বা সেগুলোর ক্লেইম করার স্থান, কোনোটা যাত্রীদের চেক-ইন, অর্থাৎ আগমনের কাজে ব্যবহৃত হয়, কোনো তলা থেকে যাত্রীদের সরাসরি মেট্রো রেল বা বাস সার্ভিস বা অন্যান্য পরিবহনসেবা, কোনোটা আবার শুধু আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীদের বহিরাগমনের জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি টার্মিনালে শ খানেক বা কোথাও আরও বেশি চেক-ইন এবং ছেড়ে যাওয়ার কাউন্টার, অর্থাৎ বোর্ডিং গেট আছে। এ ছাড়া যাত্রীদের দ্রুত টার্মিনালের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বা এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আছে ছোট ছোট গাড়ির ব্যবস্থা। এই গাড়িগুলো সার্বক্ষণিক রাউন্ড দিতে থাকে।

যাত্রীরা এসব সেবা বিনা পয়সায় এবং অধিকতর সম্মানের সঙ্গে পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া উন্নত বিমানবন্দরগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বোর্ডিং শেষ করেই সরাসরি বিমানে ওঠার ব্যবস্থা থাকে। যাত্রী তল্লাশির কাজ সাধারণত ইমিগ্রেশনের আগেই শেষ করা হয়। এরপর বোর্ডিং পাশ দেখিয়ে সরাসরি বিমানে ওঠার ব্যবস্থা থাকে। সে জন্য বোর্ডিংয়ে অহেতুক কালক্ষেপণ ও অন্যান্য ঝামেলা কম হয়। সাধারণত বিমান উড্ডয়নের ৩০-৪০ মিনিট আগে বোর্ডিং শুরু হয়। এর আগ পর্যন্ত যাত্রীরা তাদের পুরো সময় বিমানবন্দরে ঘুরে, কেনাকাটা করে, অন্যান্য বিমানের টেক অফ বা টেক অন দেখে বেশ আনন্দের সঙ্গে সময় পার করতে পারেন। শিশুদের সময়কে আনন্দময় করে তোলার জন্য আছে ভিন্ন ভিন্ন রাইডের ব্যবস্থা।

কিন্তু শাআবিবের চিত্র অনেকটাই উলটো। উপরোল্লিখিত সুবিধাদির দিক থেকে শাআবিবের ঘাটতি তো রয়েছেই, তদুপরি অতি সাধারণ সুবিধা থেকেও যাত্রীরা বঞ্চিত। শাআবিবের সঙ্গে সারা দেশের তো নয়ই, এমনকি রাজধানী শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বিমানযাত্রী আনা কিংবা পৌঁছে দেওয়ার মতো কোনো পরিবহন সার্ভিস নেই। যাত্রীরা দেশে ফিরে হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশা, না হলে ট্যাক্সি কিংবা মাইক্রোবাস নিয়ে তাদের গন্তব্যে পাড়ি জমান, যেগুলোর একটিও যাত্রীদের জন্য নিরাপদ নয়। ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ অনুমান করতে পারবেন না। এ ছাড়া আমরা প্রায়ই দেখতে পাই, বিমানবন্দর থেকে এসব পরিবহনে বাড়ি ফেরা বা বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে যাত্রীর সর্বস্ব লুটে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

বিদেশি যাত্রীরা এ ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি ঝামেলায় পড়েন। কিন্তু যদি নির্দিষ্ট কোনো পরিবহনসেবা (বাস বা মাইক্রোবাস সার্ভিস) থাকত, তাহলে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে ঐ পরিবহন নির্ভয়ে বেছে নিতে পারতেন। শুধু বিমানযাত্রীদের জন্য ঐ সার্ভিস চালু করে সমগ্র ঢাকা শহরের বিশেষ কিছু পয়েন্টে যাত্রী ওঠানামার ব্যবস্থা করলে অধিক উপকৃত হতেন। ঢাকা শহরের মধ্যে পরিবহন সার্ভিসের অভাব নেই। তাই বিমানবন্দরের সঙ্গে পরিবহন সার্ভিস যুক্ত করলে জনগণ অধিক সুবিধা পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। তাছাড়া শাআবিবের সঙ্গে প্রতিটি জেলা বা উপজেলা শহরের কার ও মাইক্রোবাস ভাড়ার একটি তালিকা টাঙিয়ে রাখলে কিংবা বহিরাগত যাত্রীদের সরবরাহ করলে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত যাত্রীরা অনেকটাই স্বস্তি পেতেন বলে বিশ্বাস। আমাদের পাশে কলকাতা বিমানবন্দরে এমন তালিকা দেখেছি।

বিমানবন্দরের প্রবেশপথেও আছে নানা রকম অব্যবস্থাপনা। গেটে অযথা ভিড় করা যাবে না—এ ধরনের কড়াকড়ি নির্দেশ থাকে নিরাপত্তা প্রহরীদের। প্রবেশদ্বারের বাইরেই পাসপোর্ট দেখিয়ে স্ক্যানারে লাগেজ, নিজের শরীর স্ক্যান করিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। যারা দীর্ঘদিনের জন্য দেশ ত্যাগ করেন, তাদের কাছে ঐ সময়টুকু খুবই আবেগঘন হয়ে থাকে। এ জন্য শেষ মুহূর্তের সময়টুকু ভালোভাবে পার করতে পরিবার-পরিজন হাজির হয় বিমানবন্দরে। উদ্দেশ্য থাকে বিদায়মুহূর্তটা একটু হাসিমাখা করে তোলা।

গেটে দাঁড়ানো যাবে না, কোনো রকম ভিড় করা যাবে না আবার পাসপোর্ট ছাড়া ভেতরে প্রবেশও করা যাবে না—কর্তৃপক্ষের এমন কড়াকড়ি নিয়মে বাধ্য হয়ে আপনজনদের গেটের বাইরে তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিতে হয়। কিন্তু ভেতরে গিয়ে দেখা যায় অনেকেই কর্তৃপক্ষের নিয়মের তোয়াক্কা না করে প্রহরীদের টাকা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে পাসপোর্ট ছাড়াই ভেতরে প্রবেশ করেছেন। ইমিগ্রেশনের আগ পর্যন্ত সবার যাওয়ার সুযোগ থাকলে অসুবিধা কোথায়? বাইরের দেশের বিমানবন্দরগুলোতে এই সুযোগ আছে। সেখানে ইমিগ্রেশনের আগ পর্যন্ত যাত্রীদের সঙ্গে যতক্ষণ ইচ্ছা পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন সময় কাটাতে পারেন। কিন্তু শাআবিবে তা অজানা কারণে সম্ভব হচ্ছে না। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিদেশগামী আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা দীর্ঘ বা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে আত্মীয়স্বজন থেকে আলাদা হয়ে যান। অনেকে বিমানে বসেও চোখের জল মুছতে থাকেন। আরও আছে যাত্রীদের সঙ্গে বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার, প্রতিটি কাজে অস্বাভাবিক সময়ক্ষেপণ, লাগেজ নিয়ে টালবাহানা, কনভেয়ার বেল্ট থেকে লাগেজ ফেলে দেওয়া, অযাচিত হয়রানি, অর্থ আদায় এবং লাগেজ চুরি ও লাগেজ কেটে মালামাল লুটে নেওয়ার অভিযোগ। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে এসব হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ড বেশি ঘটে। তবে অন্য যাত্রীরা এসব হয়রানি থেকে বাদ যান না। আমরা ভুলে যাই, বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১ কোটির বেশি প্রবাসীর ঘাম ঝরানো আয় দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও এগিয়ে যাওয়ার পথ রচনা করেছে। বিদেশে বছরের পর বছর পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রাখার সৈনিক নামের এসব প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে বিমানবন্দরে অশেষ দুর্ভোগের শিকার হন। প্রবাসীরা ঘাম ঝরানো পয়সা থেকে তিল তিল করে জমিয়ে স্বপ্ন বুনে লাগেজে ভরেন। হয়তো ছেলেমেয়ের জন্য কিছু খেলনা, কিছু চকলেট, নয়তো মা-বাবা অথবা স্ত্রীর জন্য সামান্য কিছু উপহার। কিন্তু সেখানেও ভাগ বসান বিমানবন্দরে ওত পেতে থাকা অসৎ ও অকৃতজ্ঞ কিছু কর্মচারী।

বিশ্বের সবকিছু দ্রুতগতিতে আধুনিক হচ্ছে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে একদিকে যেমন সবকিছু প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে, ঠিক তেমনি মানুষের অহেতুক হয়রানি কমে জীবন হয়ে উঠেছে স্বচ্ছন্দময়। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন উঠতি অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। একই সঙ্গে বৃহৎ ও মজবুত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এমতাবস্থায় বিদেশিদের কাছেও দেশের মর্যাদা উজ্জ্বল হচ্ছে। এই মর্যাদা আরও বেশি টেকসই করতে বিমানবন্দরের সার্বিক মানের উন্নতির দিকে নজর দিতে হবে। দেশের আন্তর্জাতিক প্রধান বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক মানের সেবা, ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীদের আনীত সব ধরনের অভিযোগ খুঁটিয়ে দেখতে হবে এবং বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে ওত পেতে থাকা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিমানবন্দরের সব কার্যক্রমকে পূর্ণ ডিজিটালাইজেশনের আওতায় এনে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিমানবন্দরে যাত্রীদের অহেতুক সময়ক্ষেপণ, লাগেজ ও শুল্ক নিয়ে হয়রানি এবং সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষকে সোচ্চার হতে হবে। বিমানবন্দরে যাত্রীদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য দ্রুত বিমানবন্দর পরিবহনসেবা চালু করতে হবে।

মূলত তৃতীয় টার্মিনাল হবে সত্যিকার অর্থে উন্নয়নশীল দেশের উপযোগী বিমানবন্দর, যা হবে প্রায় শতভাগ স্বয়ংক্রিয়। আমাদের প্রত্যাশা, এখানে যারা কাজ করবেন, তাদের ব্যক্তিত্ব, আচার-আচরণ হবে পরিশীলিত, যাত্রীবান্ধব—সর্বোপরি উন্নয়নশীল বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দরের জন্য সর্বোপযোগী।

লেখক : অধ্যাপক ও উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), সাভার, ঢাকা

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট