চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

রোজার সওয়াব আল্লাহ নিজেই দেন, ফেরেশতাদের মাধ্যমে নয়

১৩ এপ্রিল, ২০২১ | ৬:৪৮ অপরাহ্ণ

আরবির নবম মাস হচ্ছে পবিত্র রমজান। রোজা হচ্ছে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। রোজা শব্দটি ফারসি। এর আরবি পরিভাষা হচ্ছে সওম, বহুবচনে বলা হয় সিয়াম। সওম অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা। পরিভাষায় সওম হলো আল্লাহর সন্তুটি কামনায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার থেকে বিরত থাকা।

কোরআনের মর্যাদা সমস্ত নবী-রাসূলদের উপরে। কারণ কোরআন সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত নয়। নবী-রাসূল সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর সিফাতের মর্যাদা কোরআন। এই কোরআন রমজান মাসে কদর রজনীতে আলাহপাক আমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছেন। কোরআনের কারণে ওই রজনীকে লাইলাতুল কদর বলি। এটি প্রাধান্যমতে রমজানের ২৭ তারিখ। যদিও সেটা অকাট্য নয়। অকাট্য হল রমজানের শেষ দশকে অবশ্যই লাইলাতুল কদর রয়েছে।
কোরআনের কারণে কদরের মর্যাদা। কোরআনের কারণে রমজানের মর্যাদা। এই রমজান আল্লাহপাক মানুষের গুণাহ মাফের জন্য পাঠিয়েছেন। রাসূল (সা) বলেছেন, দৈনিক কাফ্ফারার জন্য আল্লাহ নামাজ দিয়েছেন, এক ওয়াক্ত নামাজ পড়লে অপর ওয়াক্ত পর্যন্ত সকল পাপের মার্জনা হয়। আপনি জোহরের নামাজ পড়লে ফজর থেকে জোহর পর্যন্ত সকল পাপের কাফ্ফারা হয়ে যায়। দৈনিক পাপের কাফ্ফারার জন্য আল্লাহ নামাজ ফরজ করলেন। সাপ্তাহিক কাফ্ফারার জন্য আল্লাহ আমাদের জুমার নামাজ দিয়েছেন। বাৎসরিক কাফ্ফারার জন্য আল্লাহ দিয়েছেন রমজান। এক রমজান থেকে অপর রমজান পর্যন্ত রোজা রাখলে আগের গুণাহ মাফ হয়ে যায়।

আবার সারাজীবনের কাফ্ফারারা জন্য হজ প্রদান করেছেন। সারাজীবনে সামর্থ্যবানদের জন্য একবার হজ্ব ফরজ। মুহাম্মদ (সা) জীবনে একবার হজ করেছেন এবং তিনবার ওমরাহ করেছিলেন। সেই কারণে রাসূল (সা) রমজানের ওমরাহ-কে অনেক মর্যাদা দিয়েছেন। তাই রাসুল (সা) বলেছেন, রমজানে ওমরাহ করা আমার সাথে হজ করার সমান। রাসূলের সাথে হজ করলে যে সওয়াব পাওয়া যায় রমজানের ওমরায় সেই সওয়াব পাওয়া যায়। সেই কারণে সবচেয়ে বেশি মুসলিম রমজান মাসে ওমরাহ পালন করেন। এর কারণ হলো- রাসূলের সেই মর্যাদা অর্জন করার জন্য ।

রমজানে আল্লাহ পাক বহুগুণ বাড়িয়ে দেন সওয়াব। মানুষ নিজের পাপের ক্ষমা চায়। শবে কদরের রজনী মক্কা শরীফ কিংবা মদিনা শরীফে তালাশ করতে যায়। মক্কা শরীফ কিংবা মদিনা শরীফে শেষ দশ দিন এতেকাফে থাকে। কারণ নিশ্চিত তিনি শবে কদর পেলেন। শব কদরের মর্যাদাতো হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। মদীনা শরীফ হলে সেটা ৫০ হাজার গুণ বেশি হয়ে যায়। আর মক্কা শরীফে এক লাখ গুণ বেড়ে যায়। কারণ মক্কা শরীফে নামাজ আদায় করলে এক রাকায়াতে এক লাখ রাকায়াতের সওয়াব আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদান করেন।

তাই আল্লাহর প্রিয় হাবিব বলেন- একটি রমজানের রোজা রাখার পর পরবর্তী রমজান যখন আসলো আগের সব পাপের কাফফারা হয়ে যায়। ‌‘আল্লাহতায়ালা রমজান মাসে কোরআন নাযিল করলেন, রয়েছে সেখানে হেদায়েত মানুষের জন্য স্টষ্ট দলিল।’ আল্লাহপাক বলেছেন, সুতরাং যারা রমজান মাস পাবে সে বাধ্যতমূলকভাবে রোজা রাখবে। উযর থাকলে রোজা ছেড়ে দিয়ে পরবর্তীতে কাযা করা জায়েজ। কিন্তু উযরবিহীন রমজানের রোজা ছাড়া যাবে না। কোন মানুষ অসুস্থ হলে কিংবা সফরের মধ্যে থাকলে, রোজা রাখা সম্ভব না হলে তবে রোজা ছেড়ে দেবে এবং পরবর্তীতে কাযা করে নেবেন। ঠিক মহিলারা গর্ভ ধারনের কারণে কিংবা সন্তানকে দুগ্ধপানে সমস্যা তৈরি হলে রোজা ছাড়তে পারবেন। ফলে বছরের যে কোন সময় কাযা আদায় করে নেবেন।

আদম (আ)ও রোজা রেখেছেন। আদম (আ) যখন দুনিয়াতে আসলেন তখন জান্নাত থেকে দুনিয়াতে আসা এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে পুরো শরীরে কালো দাগ দেখা দেয়। তখন তাঁকে আল্লাহ পরামর্শ দিলেন, তুমি নফল রোজা রাখ তিনটি। তখন চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ তিনি তিনটি রোজা রাখলেন। প্রথম দিনে শরীরের এক তৃতীয়াংশ, দ্বিতীয দিনে আরো বেশি এবং তৃতীয় দিনে তখন দাগগুলো ধীরে ধীরে চলে গেল। পুরো শরীর আলাকিত হয়ে আবার আগের অবস্থা ফিরে পেলেন আদম (আ)। সুবহানাল্লাহ।
আদম (আ.)এর মতো অন্যান্য নবী-রাসূলগণও রোজা রেখেছেন। হযরত দাউদ (আ) ও রোজা রেখেছেন। রাসূল (সা) বলেছেন , তোমার রোজা রাখলে স্বাস্থ্যবান হবে, রোগব্যাধী দূর হবে। মাসিক ভিত্তিতে তিনটি, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে সোম ও বৃহস্পতিবার দুটি নফল রোজা রাখতেন মুহাম্মদ (স)। একদিন তাঁর কাছে সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন কেন রোজা রাখেন তিনি? রাসূল (সা) জবাবে বলেন, ‘রবিউল আউয়াল মাসের যে কোন একটি সোমবারে জন্ম গ্রহণ করার কারনে শোকর আদায়ের জন্য। আর বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক আমলানাম আল্লার দরবারে পেশ করার কারণে। যাতে রোজা অবস্থায় আমার আমলনামা আল্লার দরবারে পৌঁছে যায়।’

সবচেয়ে উত্তম হলো- হযরত দাউদ (আ) এর রোজা । তিনি এক বছরের মধ্যে অর্ধেক সময় অর্থাৎ অর্ধ বছর রোজা রাখতেন। তিনি একদিন রোজা রাখতেন পরদিন ছাড়তেন। প্রতি মাসে ১৫টি। তাঁর রোজা রাসূল (সা) পছন্দ করেছেন। আল্লাহপাক পছন্দ করলেন দাউদ (আ) এর রোজা, তেমনি তাঁর ইবাদত। তিনি রাতকে তিনভাগে ভাগ করতেন। দুইভাগ শুয়ে এবং একভাগ ইবাদত করে সময় কাটাতেন। তার পরিবারে পুরোরাত ইবাদত চলতো পালাক্রমে। তার সুমধূর জিকির শ্রবণ করতো পাখি, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্রের মাছ থেকে সবাই তন্ময় হয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন দাউদ (আ) । তাঁর যবুর পাঠ সবার হৃদয়ে শিহরণ জাগাতো।

দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে রোজা ফরজ করা হয়। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘রোজা আমার জন্য, এর প্রতিদান আমিই দিবো।’ সুবহানাল্লাহ। বান্দাহর সমস্ত আমলের সওয়াব আল্লাহ প্রদান করেন ফেরেশতাদের মাধ্যমে। রেজার সওয়াব আল্লাহ নিজেই দেন। কারণ ফেরেশেতাদের খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস নেই। কারণ খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করলে মানুষের কি কষ্ট তা ফেরেশতারা মূল্যায়ন করতে পারেন না। তাই আল্লাহ রোজার সওয়াব নিজের জিম্মায় নিয়েছেন।

রোজা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো, পরহেজগার হতে পারো।’ এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, রোজার বিধান দেওয়া হয়েছে তাকওয়া অর্জনের জন্য, গুনাহ বর্জন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাতের উপযোগী হওয়া, নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য।

হযরত সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন, জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। এ দরজা দিয়ে শুধু রোজাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্যরাও এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে চাইবে। কিন্তু রোজাদার ব্যতীত অন্য কাউকে এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
আল্লাহ আমাদের সকলকে রোজা রাখা এবং নেক আমল করার তৌফিক দিন। আমিন।

লেখক:  ব্যুরো চিফ, চট্টগ্রাম, বাংলাভিশন।

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট