চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আনন্দজয়ী

৩০ মার্চ, ২০২১ | ৬:০৬ অপরাহ্ণ

মুদি দোকানে ডিম কিনতে গিয়েছি। পাশে এক লোক বাচ্চা নিয়ে দোকানে এসেছে। লোকটা সম্ভবত শ্রমিক বা রিকশাচালক। শুকনা। গলার হাড্ডি বের হয়ে গেছে। অভাব-অনটন তাকে কেমন জীর্ণশীর্ণ করে দিয়েছে।

তার বাচ্চাটারও একই অবস্থা। লোকটা ২৫০ গ্রাম তেল আর লবণ কিনতে এসেছে। বাচ্চাটা জলজল চোখে চকলেটের বয়ামের (বোতল) দিকে তাকিয়ে আছে। বেচারা চাইতে সাহস পাচ্ছে না। ওর বাবা সেটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু দারিদ্র্য মাঝেমাঝে চোখে নির্লজ্জ টিনের চশমা পরিয়ে দেয়। সেই কথিত ‘চশমার’ আড়ালে ছেলের মায়াভরা মুখটা দেখে ভালোবাসায় ভেজা গলায় বাবাটা বললো, ‘কিছু লইবি?’

ছেলেটা লাজুকভাবে কথা না বলে আঙ্গুল তুলে দেখাল। বাবা হেসে চকলেটের বয়ামের কৌটা খুলে দুটি চকলেট বের করে ছেলেকে খুব আদর করে বলে, ‘তিনের ঘরের নামতাটা কও তো বাপ।’

বলেই লোকটা আড়চোখে সবার দিকে হালকা থাকাল। তার সেই দৃষ্টিতে কেমন একটা চাপা উত্তেজনা। যদি না পারে? সবাই তো তাকিয়ে আছে!

ডিমের পুটলি হাতে নিয়ে আমিও তাকিয়ে আছি ছেলেটার দিকে।

দোকানদারও সরু চোখে তাকিয়ে আছে। এই পিচ্চি পোলা! নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে, সে বলবে তিনের ঘরের নামতা! এই কঙ্কালসার ছেলে তিনে তিনে কত হয় সেটাই তো জানে না!

ছেলের হাতে চকলেট। সে চকলেট দুইটা এহাত-ওহাত করছে। বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পোর্টস কারের গতিতে সে বলতে শুরু করলো,

‘তিন অক্কে তিন, তিন দুগুনি ছয়, তিন তিরিক্কা নয়, তিন চাইরে বারো….’

কেমন টেনেটেনে গানের তালে মাথা নেড়েনেড়ে সে বলে যাচ্ছে। বাবার চোখে যেন নামতার পাতাটা সেঁটে আছে, ও শুধু দেখে দেখে পড়ে যাচ্ছে।

নামতা শেষ হয় ত্রিশ কি চল্লিশ সেকেন্ডে। শেষ করে সে একটা লজেন্স মুখে পুরলো। মুখ ঝলমল করে বাবাকে বললো, ‘আব্বা, চাইরের নামতাও পারি। কমু?’

সেই জীর্ণ লোকটা, হয়তো প্রতিদিন ঠিক মতো পয়সা পায় না। পাঁচ টাকা বেশি রিকশা ভাড়া চাইলে দুইচারটা গালি খায়, মহাজনের গুঁতা খায়।

সেই গাল ভাঙা কুঁজো হয়ে যাওয়া লোকটা প্রতিদিনই হেরে যায়। সমাজের কাছে, সংসারের কাছে, পিতৃত্বের কাছে।

আজ সে হারেনি। আজ তার অনেক বেশি আনন্দ। সবার সামনে ছেলে তার মুখ উজ্জ্বল করেছে। এবার সে আড়চোখে না, পূর্ণ দৃষ্টিতে আমাদের সবার দিকে তাকাল। তার চোখে গর্বের অশ্রু, আনন্দাশ্রু।

যে লোক শুধু পরাজিতই হয়, আমাদের চোখে, আসলে সে পরাজিত না। সে আসলে অনেক বড় যোদ্ধা। আমাদের চেয়ে অনেক সাহসী। আমরা তো যুদ্ধের আগে নানান পরিকল্পনা করি, কত ফন্দিফিকির, কাকে নিচে নামিয়ে কাকে মাড়িয়ে আমরা উপরে উঠবো।

কিন্তু এই লোকগুলো কাউকে মাড়িয়ে উপরে উঠতে চায় না, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও প্রাণপণ যুদ্ধ করে যায়।

যে সিঁড়ি বেয়ে আমরা তড়তড়িয়ে উপরে উঠে যাই, আমরা কি জানি তাদের কাঁধের উপরই সেই সিঁড়ি চাপানো!

লোকটা আজ সাহস পেয়েছে। তিনের ঘরের নামতাটা শুধু নামতা নয়, একটা সাহস, একজন বাবার শক্ত একটা কাঁধ, একটা অবলম্বন। তিনের ঘরের নামতাটা এই দরিদ্র লোকটার স্বপ্ন পূরণের উপাখ্যান।

লোকটা তার ছেলেকে কোলে তুলে ফেললো। সে কেঁদেই ফেলেছে। এই সময় হুট করে দোকানি ডিপফ্রিজ খুলে একটা ললি আইসক্রিম পিচ্চির হাতে দিলো,

‘সাবাস! জজ ব্যারিস্টার হইয়া দেখায়া দিস সবাইরে! ল, আইসক্রিম খা। বেশি খাইস না, গলা ফুইলা গেলে কথা কইবার পারবি না।’

ছেলেটা খুশি মনে আইসক্রিমটা নিলো। বাবা-ছেলে চলে গেলো। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি।

দোকানদার আমাকে বললো, ‘আমি তো ভাববারও পারি নাই। বান্দরটা কেমনে চ্যালচ্যালাইয়া নামতা কইয়া দিলো! দেখলেন নি কারবার ডা.!’

একি! দোকানির চোখেও পানি! আসলে যারা ক্ষুধার কষ্ট বোঝে, তাদের একজনের মনের সাথে অন্যজনের মন একই সুতোয় গাঁথা থাকে। একজনের কষ্ট আরেকজন বুঝতে পারে, আবার আনন্দগুলোও স্পর্শ করে প্রবলভাবে।

আর আমরা? কোটি টাকার স্বপ্নে বিভোর আর প্রতিযোগিতার উন্নাসিকতায় ভুলে যাই আমরা আসলে কি!

আমি ডিম হাতে একা একাই হাঁটছি আর বলছি, ‘তিন অক্কে তিন, তিন দুকুনে ছয় …’

আমাকেও সংক্রমিত করেছে তাদের জয়ের আনন্দ।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট