চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

তীব্র তাপদাহে সুস্থ থাকার উপায়

ডা. জয়ব্রত দাশ

২৭ এপ্রিল, ২০২৩ | ৮:৫৮ অপরাহ্ণ

দেশের বিভিন্ন জায়গার তাপমাত্রা এখন পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর কাছাকাছি। কোথাও কোথাও আরো বেশি। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি নেই। এই তাপমাত্রায় দিনের বেলা বাইরে থাকলে বা কাজ করলে হিট স্ট্রোক হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি। হিট স্ট্রোক খুবই মারাত্মক। অতি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা না করালে মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।

এই গরমে বেশিক্ষণ ঘরের বাইরে থাকলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে শরীর প্রচুর ঘাম তৈরী করে। ঘাম শুকাতে থাকলে শরীরের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। কিন্তু ঘামের সাথে বিভিন্ন ইলেকট্রোলাইট সোডিয়াম পটাশিয়াম বেরিয়ে যায় শরীর থেকে। ফলে লবনের ঘাটতি দেখা দেয় শরীরে। অত্যধিক ঘামের ফলে পানিশূন্যতা ও লবনের ঘাটতি একসাথে হলে শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রতিক্রিয়াগুলো ধাপে ধাপে হতে থাকে। প্রথম ধাপে যা হয় তার নাম হচ্ছে হিটে ক্রাম্প বা গরমে শরীর কামড়ানো। অতিরিক্ত ঘামের কারণে লবন ও পানির অভাব হয় এবং এর প্রভাবে মাংসপেশিতে বিশেষ করে পায়ের মাংসপেশিতে কামড়ানো শুরো করে।

তৃষ্ণা পায় খুব বেশি। প্রস্রাবের পরিমাণ কমতে থাকে। এরপর হচ্ছে হিট এক্সারশান অথবা গরমে প্রচন্ড ক্লান্তি। এটা হুট করে একদিনে হয় না। আপনি পর পর তিন চারদিন, তিন চার ঘণ্টা করে বাইরে গরমে থাকলেন অথবা কাজ করলে আপনার হিট এক্সারশান এর লক্ষন শুরো হতে থাকবে। যারা বয়স্ক, যারা অতিরিক্ত শুকনা বা মোটা, শিশু, গর্ভবতী, যাদের উচ্চরক্তচাপ ও অন্য রোগে আক্রান্ত তারাই বেশি ঝুঁকিতে থাকে। হিট এক্সারশান এর লক্ষণ হচ্ছে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, দুর্বলতা, মাথা ধরা, মাথাব্যাথা, বমিবমি ভাব, মাথা ঘুরতে থাকা ও পড়ে যাওয়া। শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখতে পারেন হিট এক্সারশান কনফার্ম করার জন্য। হিট এক্সারশনে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে এবং এক পর্যায়ে শ্বাস প্রশ্বাস ও হার্ট রেট দ্রুতহতে শুরো করবে বুক ধড়ফড় করবে এবং রোগী ক্লান্ত হয়ে পরবে।

হিট স্ট্রোক: সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে হিট স্ট্রোক। প্রচন্ড গরমে বাইরে অধিকক্ষণ কাজ করলে প্রচুর ঘাম হয়ে চরম পানিশূন্যতা দেখা দিবে। এতে করে রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাবে, রক্ত চলাচল ব্যাহত হবে ও শরীরের বিভিন্ন বিভাগের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হবে ও নিস্তেজ হয়ে পড়বে। জরোরি চিকিৎসা না পেলে ব্রেইন কিডনী লিভার সহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্রুতবিকল হয়ে পরবে।

প্রাথমিকভাবে যা করবেন: প্রথম কাজ হলো দ্রুতরোগীকে ঠান্ডা জায়গা অথবা ছায়ার নিছে নিয়ে আসুন। এসি থাকলে এসি রুমে নিয়ে যান। পানিশূন্যতা দূর করতে নরমাল পানি খেতে দিন। খাবার স্যালাইন খাওয়ালে সবচেয়ে ভালো। শুধু ঠান্ডা পানি হলেও চলবে প্রথমে। আসে পাশে পুকুর থাকলে গলা পর্যন্ত পুকুরের পানিতে নামিয়ে দিন। পুকুর না থাকলে কলের নিছে নিয়ে পানির ধারা দিন। বাথটাব থাকলে ওখানে ঠান্ডা পানিতে শুইয়ে দিন এবং পানির মধ্যে কিছু বরফ ঢেলে দিন। তাও না থাকলে ঠান্ডা পানিতে গোসল করিয়ে দিন তারপর টেবিল ফ্যান ছেড়ে দিন। ফ্যানের বাতাসে শরীর শুকাতে দিন। তাপমাত্রা না নামলে আবার ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে দিন এবং ফুল স্পিডে টেবিল ফ্যান দিয়ে শরীর ঠান্ডা করতে দিন। মনে রাখতে হবে ঠান্ডা পানি খাওয়ানো খুব জরোরি কারন ঠান্ডা পানি পানে শরীরের ভিতরের তাপমাত্রা দ্রুতকমতে থাকে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে শুধু অতিরিক্ত পানি খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। সে জন্য খাবার স্যালাইন খাওয়া বেশি উপকারী। চিনিযুক্ত কোমল পানীয় গুলো না খাওয়ানো ভালো। ঠিকমতো চিকিৎসা করা না হলে এই মানুষ গুলোর হিট স্ট্রোক হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে।।

কখন বুঝবেন হিট স্ট্রোক হচ্ছে? যদি দেখেন মুখ জিহবা শুকিয়ে আছে, চামড়া শুকনা লাল হয়ে গিয়েছে, ঘাম হচ্ছে না, প্রস্রাব হচ্ছে না, নাড়ি অতিরিক্ত চলছে, হার্টবিট বেড়ে গেছে, রোগী উল্টা পাল্টা কথা বলছে অথবা কোন কথা বলছে না নেতিয়ে পড়ে আছে, অথবা রোগী অজ্ঞানের মতো হয়ে যাচ্ছে, অস্বাভাবিক আচরণ করছে, ব্লাড প্রেসার দ্রুত কমে যাচ্ছে, তখন হিট স্ট্রোক হচ্ছে বলে সন্দেহ করুন। হিট স্ট্রোক হলে একের পর এক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট হওয়া শুরো করবে। প্রথমে পানিশূন্যতা রক্তের ঘনত্ব বেড়ে জমাট বেধে যাওয়া তারপরে ব্রেইন কিডনি লিভার অকার্যকর হতে শুরো করবে। রোগী এই অবস্থায় পৌঁছে গেলে উপরের চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি  যত দ্রুতসম্ভব হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিকার কি? ঘরের বাইরে যেতে হলে সাথে বড় ঠান্ডা পানির ফ্লাস্ক বা বোতল রাখুন এবং কিছুক্ষন পরপর পানি খেতে থাকুন। রোজা বা উপবাস থাকলে পারতপক্ষে ঘরের বাইরে যাবেন না। অন্যরা প্রয়োজন না হলে গরমে বাইরে না যাওয়াই ভালো। বাইরে বের হলেই সঙ্গে ছাতা নিন। যতো তাড়াতাড়ি বাইরের কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে  আসুন। শিশুরা যারা বাইরে স্কুলে কোচিং এ যায়, মাঠে দৌড়া দৌড়ি করে তাদেরকে স্কুলে না পাঠানোই ভালো। যত হালকা পাতলা ডিলেডালা পোশাক পরা যায় ততো ভালো। বাইর থেকে আসলেই পানি বা শরবত খেয়ে নিন। ঘাম বেশি হলে খাবার স্যালাইন খেয়ে নিন।

মহিলারা কিন্তু ঘরের ভিতরে রান্না করেন ফলে গরমের দিন রান্না ঘরের তাপমাত্রা অন্যান্য রোমের চেয়ে অনেক বেশি। তাই রান্না ঘরে যতো কম সময় কাটানো যায় সেই ব্যাপারটাও অনুগ্রহ করে মাথায় রাখুন। রান্নার কাজ সংক্ষিপ্ত করুন। প্রস্রাব ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখুন। যারা বিভিন্ন রোগের জন্যে একাধিক ঔষধ খান তারা নিজ নিজ চিকিৎসকের সাথে সর্বদা যোগাযোগ রাখুন। নিদেনপক্ষে দৈনিক দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করার অভ্যাস করোন।

লেখক: অধ্যাপক ডা. জয়ব্রত দাশ, অধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন বিভাগ, সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্বকোণ/সাফা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট