চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক

মো. দিদারুল আলম

২৪ জুন, ২০২১ | ৭:৫০ অপরাহ্ণ

করোনা মহামারির কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের ৫৯ লাখ ২০ হাজার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ন্যূনতম শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত। (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, ৫১ শতাংশ প্রাথমিক ও ৬১ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী পড়াশোনার ক্ষতি এড়াতে কোচিং ও গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, মহামারিতে শিক্ষার ব্যয় গ্রামীণ পরিবারে ১১ গুণ ও শহুরে পরিবারে ১৩ গুণ বেড়েছে। করোনা যে সহজে বিদায় নিচ্ছে না, তা মোটামুটি অনুমেয়। জাতিসংঘও বলছে, মৌসুমী রোগ হিসেবে এটি পৃথিবীতে বিরাজ করতে পারে। বিশ্বের অংশ হিসেবে তাই সারাবছর বাংলাদেশে অল্পবিস্তর করোনা রোগী থাকা অনেকটা স্বাভাবিক। আর তাই যদি হয়- তাহলে কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ থাকবে? তা নিশ্চয়ই নয়।

পুরো এক বছরের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষতি নীতিনির্ধারকদের তেমন ভাবিয়ে তুলেছে বলে দাবি করা যাবে না। কেননা শিক্ষার বহুমাত্রিক দিক থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষতি সহজে পরিমাপ করা যায় না। কারণ কিছু কিন্ডারগার্টেন ছাড়া আর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফিসহ অন্যান্য লেনদেন যথারীতি করোনাপূর্ব অবস্থায় আছে। পুরো পৃথিবীর এমন ভয়াবহ মহামারির রূপ এই প্রথম। এত বড় আঘাত পৃথিবীতে আর কখনো ঘটেনি। ১৯০টিরও বেশি দেশের প্রায় ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় আবারো স্কুল-কলেজ খোলার চিন্তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। টানা প্রায় ১৫ মাস বন্ধ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময়ে সরকারের প্রচেষ্টা ছিল না, তা-ও নয়। কিন্তু কোনো প্রচেষ্টাই সঠিকভাবে গ্রহণ করা যায় নি করোনা সংক্রমণ ওঠা-নামার কারণে। করোনার কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। এ সংকট শুধু একা বাংলাদেশের ছিল না। বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিটি দেশকেই এটি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জুন থেকেই স্কুল-কলেজ খুলতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হচ্ছে না। এতে যে সেশন জট হচ্ছে তার কারণে শিক্ষার্থীরা চাকরির বয়স হারাচ্ছে। আবার অনেকে ক্যাম্পাসে থেকে টুকটাক কাজ করে আয় করতেন তা বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও অনলাইন ক্লাস হচ্ছে, এটা খুব একটা কাজের না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় অনেকে অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারছেন না। আবার যোগ দিতে পারলেও অনেক সমস্যা হচ্ছে। যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ তাদের লাইন নিতে পারছে না। তাই স্বাভাবিক কারণেই অনলাইন শিক্ষায় সবার সমান সুযোগ থাকছে না। স্লো নেটের কারণে গ্রামে অবস্থানরত মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। 

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এরা তীব্র হতাশায় ভুগছে, আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক বাচ্চা অস্বাভাবিক আচরণ করছে ও মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে অনেকে। অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তারা শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ছে। বাল্যবিয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেকে মোবাইলে আসক্ত হচ্ছে, মাদকাসক্ত ও কিশোর গ্যাংয়ের মত অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া অনেক কিশোরি টিকটকের মত অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়ছে, নারী ও শিশু পাচারকারীদের বিভিন্ন প্রলোভনে বিদেশে পাচারের শিকার হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, করোনায় ৫-২৫ বয়সীদের মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা খুব কম। এই পর্যন্ত বাংলাদেশে  বিভিন্ন বয়সী সহস্রাধিক মৃত্যুর মধ্যে ৫-২৫ বছর বয়সীদের মৃত্যু মোট মৃত্যুর ২% বা ১০০র কম। পাশাপাশি গত এক বছরের একই সময়কালে এই বয়সীদের মধ্যে এর চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে, আত্মহত্যা বা মাদকাসক্তি থেকে বা অন্যান্য কারণে।

করোনা মহামারীর মধ্যে বিশ্বজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে বেশির ভাগ দেশ রক্ষণাত্মক কৌশলে এগোচ্ছে। এতদিন মূলত সংক্রমণ কমলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। আবার করোনা সংক্রমণের হার বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। জাপানের স্কুলগুলো অনেক আগেই খুলে দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা, খোলা জানালা শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থা, দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মুখে মাস্ক পরা ইত্যাদি নির্দেশনা দেয়া হয়। নরওয়েতে গত বছরের এপ্রিল থেকে কিন্ডারগার্টেন খুলে দেয়ার ঘোষণা আসে। তাদের সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, শ্রেণিকক্ষে ১৫ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে না রাখা, ডেস্কগুলো নিয়মিত ধোয়া ইত্যাদি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফ্রান্সে প্রিস্কুল, এলিমেন্টরি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে  দেয়া হয় গত বছরই। ক্লাসে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসা এবং অন্যান্য সুরক্ষব্যবস্থা মেনে চলা হয়। থাইল্যান্ডে গত বছরের জুলাইয়ে খুলে দেয়া হয়েছে স্কুল। তাপমাত্রা পরীক্ষা বা দুই ডেস্কের মাঝে পার্টিশন ব্যবহার করে ক্লাস করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিশ্বের স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে।

আমাদেরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়বে। আমাদের আশু প্রয়োজনের কথা ভাবতে হবে সর্বাগ্রে। শিক্ষার গতি ফিরিয়ে আনার জন্য পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এ মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়াটাই হবে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। প্রয়োজনে শিফট ভাগ করে ক্লাস নেয়া যেতে পারে। যারা ক্লাসে উপস্থিত হবে না তাদের উপস্থিতির সমস্যা যাতে নায় হয় সেদিকে খেয়াল করতে হবে এবং কোনো ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা রাখা যাবে না। সপ্তাহে ৩ দিন ক্লাস নেয়া যেতে পারে। তবে করোনা যদি আবার ফিরে আসে বা শিক্ষার্থীরা যদি আক্রান্ত হয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের সম্ভাবনা থাকে, তখন আবার স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিতে হবে।

স্কুল খোলার আগে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও গাইডলাইন দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের গাইডলাইন হবে আলাদা। কারণ প্রাথমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবস্থাপনা এক হবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ টিম গঠন করা উচিত। শিক্ষার্থীরা কীভাবে আসবে, স্কুলে প্রবেশের সময় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, তাদের বসার ব্যবস্থা প্রভৃৃতি প্রণীত গাইডলাইন অনুযায়ী চূড়ান্ত করতে হবে। ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যেতে পারে। আবার এমনও না যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে আমরা শিক্ষার্থীদের ঘরে আটকে রাখতে পারছি। তারা কিন্তু আড্ডা, ঘুরাঘুরি সবই করছে, কেনাকাটা করতে পরিবারের সাথে মার্কেটে যাচ্ছে। তার মানে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানেই শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নয়। তাই আমরা মনে করি স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়াই হবে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।

লেখক: প্রাবন্ধিক

পূর্বকোণ/মামুন

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট