চট্টগ্রাম সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

বায়ুদূষণে সাড়ে ৬ বছর আয়ু কমছে বাংলাদেশিদের

অনলাইন ডেস্ক

২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ৬:০৬ অপরাহ্ণ

এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু ২ বছর ৪ মাস কমছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস। মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান সংগঠনটির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণ বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’-এ এসব তথ্য উঠেছে বলে জানায় বাপা। লিখিত বক্তব্যে আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দা চেস্ট অ্যান্ড হসপিটালে ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৭ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার।তিনি জানান, রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। এবারের (২০২৩) জুলাইয়ে সে সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে।

আয়ুষ্কালের দিক থেকে বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, দূষণ বাংলাদেশে মানবস্বাস্থ্যের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে জানিয়েছে কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সিসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ১ লাখ ৩৮ হাজারও বেশি মানুষ। একই কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে এবং ফলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

বায়ুদূষণের কারণ উল্লেখ করে তিনি জানান, বায়ুদূষণের কারণগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব অন্যতম।

ক্যাপসের গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প-কারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তদেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৬.৫ শতাংশ, গৃহস্থালি ও রান্নার চুলার কাজ থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে।

দেশের মধ্যে বিভিন্ন জেলার বায়ুর মানের পার্থক্য তুলে ধরে কামরুজ্জামান বলেন, গাজীপুর জেলার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা, যার ব্যাস সাধারণত ২.৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোট (পিএম ২.৫), এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৯.৮ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়। এই মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রার (অর্থাৎ ৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ বেশি এবং নির্ধারিত (বার্ষিক) মানমাত্রার চেয়ে ৬ গুণ বেশি। ২০২২ সাল পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫-এর জন্য নির্ধারিত (বার্ষিক) প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম দূষিত জেলা হিসেবে পাওয়া গেছে সিলেট শহর। যার প্রতি ঘনমিটাবে ৪৮.৫ মাইক্রোগ্রাম এবং এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে ৯.৭ গুণ বেশি এবং বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় আদর্শ (বার্ষিক) মানমাত্রার চেয়ে ৩.২৩ গুণ বেশি।

তিনি জানান, গাজীপুর ছাড়াও নোয়াখালীতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮.৭ মাইক্রোগ্রাম, কুমিল্লায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৮.২ মাইক্রোগ্রাম, চাঁদপুরে প্রতি ঘনমিটারে ৮৭.৮ মাইক্রোগ্রাম, ঢাকায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৭.২ মাইক্রোগ্রাম, নারায়ণগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮৬.৯ মাইক্রোগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৩.১ মাইক্রোগ্রাম, কিশোরগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮২ মাইক্রোগ্রাম এবং টাঙ্গাইলে প্রতি ঘনমিটারে ৮১ মাইক্রোগ্রাম অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি পাওয়া যায়।

সংবাদ সম্মেলনে স্থপতি ইকবাল হাবিব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ নাগরিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এটা সারা দেশে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করছে। সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে, বিকলাঙ্গ প্রজন্ম, প্রতিবন্ধী শিশু তৈরি করবে, নাকি শিল্পপতিদের কাছে মাথানত করবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ব্যাপারে সরকারকে অঙ্গীকার করতে হবে।

বায়ুমান উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ, মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। পদক্ষেপগুলো হলো—

স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ:

১. নির্মাণকাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে।

২. শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদফতরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতি ২-৩ ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা যেতে পারে।

৪. অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে।

৫. ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে নম্বরপ্লেট অনুযায়ী জোড়-বেজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।

মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ:

৬. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদবাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে। দূষিত শহরগুলোর আশপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।

৭. আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৮. আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে সেন্ড ব্রিকের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।

৯. সিটি গভর্ন্যান্স প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ:

১০. নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যত দ্রুত সম্ভব প্রণয়ন করতে হবে।

১১. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়াও বায়ুদূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে।

১২. পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।

১৩. সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ুদূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশে বায়ুদূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাপার সভাপতি নুর মোহাম্মদ তালুকদার, সহ-সভাপতি অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর প্রমুখ।

 

পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট