চট্টগ্রাম বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

ফিরে দেখা বাংলা চলচ্চিত্র

আলমগীর কবিরের রূপালি সৈকতে

তাকি নাজিব

২৩ নভেম্বর, ২০১৯ | ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

খ্যাতিমান চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির ‘রূপালি সৈকতে’ চলচিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন ১৯৭৯ সালে। আলমগীর কবির তার ব্যাক্তি জীবনে ছিলেন বিপ্লবী, মানুষ ও মানবতার জন্য তিনি আজীবন লড়ে গেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। আলজেরিয়া, ফিলিস্তিন মুক্তিসংগ্রামে তিনি প্রত্যক্ষ লড়াই করেছেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন,বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ১৯৭১ এ তিনি অংশ নিয়েছেন সক্রিয় ভাবে। তার রূপালি সৈকতে সিনেমাটি এক বৃহত্তর ক্যানভাসে করা অস্থির অগ্নিগর্ভ এক সংগ্রামী সময়ের জ্বলন্ত সাক্ষী।

বাংলা চলচিত্রে খুব কম পরিচালকই এমন সাবলীল ভাবে সমকালীন বিশ্বের চলমান মুক্তি সংগ্রাম, সংঘাতময় সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে উন্মেষ পূর্বকাল তাদের চলচিত্রে ধারন করতে পেরেছেন। তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধ কালিন সময়ের দুই মেরুতে বিভক্ত পৃথিবীতে একদিকে নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম আর অন্যদিকে আমাদের রাষ্ট্রীয় উন্মেষ কালে শ্রেণীহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে তৎকালীন রোমান্টিক তরুণ সমাজের ব্যাক্তি ও পারিবারিক জীবনের সংঘাত ও সংগ্রামের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে আমাদের সামনে। কাহিনীর প্রয়োজনে এই চলচিত্র পরিচালক অনেকগুলো বিদেশী সঙ্গীত ও সুর এবং কিছু কবিতা সংযোজন করেছেন যা সত্যি অপূর্ব। তার রূপালী সৈকতে সিনেমাটি পৃথিবীজুড়ে মানুষের মুক্তি সংগ্রাম,আমাদের সঠিক ইতিহাসের শেকর সন্ধান এবং বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের সোনালি অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ‘বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্র’ তালিকায় স্থান পেয়েছে ‘রূপালী সৈকতে’ চলচ্চিত্র। এতে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ, জয়শ্রী কবির, শর্মিলী আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, নুতন, অঞ্জনা রহমান, রজি সামাদ ও উজ্জল। এ ছাড়াও এ চলচিত্রে তৎকালিন সময়ের কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা এবং চরিত্রের স্বাভাবিক প্রবেশ ঘটেছে যা ঘটনা প্রবাহকে করেছে আরো প্রাঞ্জল।

দুই বিপ্লবী তরুণের জীবন ও সমকালীন বাস্তব ঘটনা নিয়ে এই ছবির শুরুতেই আমরা দেখি ঢাকা থেকে আসা পত্রিকার সাংবাদিক লেনিনকে সমুদ্রতীরে মুক্ত প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়াতে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে সমুদ্রতীরে সুন্দর একটি কটেজে। একটি মেয়ে সেখানে হেটে বেড়াচ্ছে। লেনিন তাকে তার বান্ধবী শরমিন মনে করে ভূল করে। মিসেস অর্থিজ ও তার মেয়ে আনা বাস করেন সাগর সৈকতের কাছাকাছি এই কটেজে। কক্সবাজারের নির্জন ইনানী বিচের এই কটেজটির একটি রুম তার অতিথিদের কাছে ভাড়াদেন। হঠাৎ করে এখানে আতিথি হয়ে হাজির হন এক চুপচাপ যুবক আনোয়ার। প্রকৃতিতে আনোয়ার একটু কঠিন এবং আত্মভোলা। রাতে তার ঘর থেকে ভেসে আসে আরবী গান ও সংলাপ। পরদিন কৌতুহোলী আানা পরখ করতে যায় ব্যাপারটা, কিন্তু হঠাৎ আনোয়ার উপস্থিত হয়ে কড়া ভাবে আনাকে জানায় তার ব্যক্তিগত জিনিস কেউ নাড়াচাড়া করুক সে তা পছন্দ করে না। পরদিন আনার মায়ের সাথে গল্প করার সময় আনোয়ার জানতে পারে আনার বাাবা ‘মি. মানুয়েল অর্থিজ’ খুন হওয়ার পর থেকে আনা সাধারণত অপরিচিত মানুষদের এড়িয়ে চলে। ঘটনা প্রসঙ্গে জানা যায় মি. অর্থিজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি পড়াতেন এবং তিনি আনোয়ারের শিক্ষক ছিলেন, তার কাপ্তাইয়ে নিহত হওয়ার ঘটনাটাও আনোয়ার মনে করতে পারছে। তারপর আনোয়ার দুর্ব্যবহার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আনার কাছে। সে আনাকে জানায় মি. অর্থিজকে সে ভালোভাবে চিনত এবং এটা অত্যন্ত পরিতাপের- স্ত্রী,কন্যার সতীত্ব রক্ষার জন্য পৃথিবীর সেরা একজন অরর্কিওলজিস্টকে এভাবে সাধারণ গুন্ডাদের হাতে জীবন দিতে হলো। তারপর সে আনাকে শুনায় তার জীবনের আরেক কাহিনী।

১৯৬২ থেকে প্যালেস্টাইন মুক্তি আন্দোলনের সাথে সে জড়িয়ে পরেছিল, লেবাননে তাদের ইউনিটে বৈরুতের রিফিউজি ক্যাম্পে বড় হওয়া লায়লা নামের একটি মেয়ের সাথে আনোয়ারের প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু হঠাৎ একদিন আততায়ীর গুলিতে লায়লা নিহত হলে তার আরব বন্ধুরা তাকে ইসরাইলের গুপ্তচর মনেকরে ভূল বুঝে। তারপর দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় আনোয়ার। এভাবেই ঘটনার ধারাপ্রবাহে আনার সাথে প্রণয় গড়ে উঠে আনোয়ারের। এই রূপালী সৈকতে ঘর বাধার প্রত্যয়ে আনোয়ার চলে যায় বিদেশে তার উপার্জিত টাকাপয়সাগুলো এখানে নিয়ে আসার জন্য। পথ চেয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনতে থাকে আনা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা তখন উত্তাল।পশ্চিমাদের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বিষিয়ে উঠেছে বাঙালিদের মন। বিদেশ ফেরৎ উচ্চশিক্ষিত সাংবাদিক লেনিন আইয়ুব সরকারের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে লিখে চলেছে পত্রিকায়। তার স্বপ্ন স্বাধীন হবে এই দেশ, প্রতিষ্ঠিত হবে এখানে এক শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ। লেনিন বিপ্লবের দীক্ষা নিয়েছে, লন্ডনে থাকতে সেখানে সে বামপন্থী পত্রিকাতে লেখালেখি করত।

আলজেরিয়া,প্যালেস্টাইন কিউবার বিপ্লবের সাথে ছিল তার প্রত্যক্ষ পরিচয়। এভাবে তার পরিচয় ঘটে দেশীয় আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবীদের সাথে। কাজ করে যায় সে সশস্ত্র বিপ্লবের লক্ষ্যে। পূর্বপাকিস্তানের ক্যাপিটালিস্ট সমাজের প্রতিনিধি মি. চৌধুরীর মেয়ে শরমিন ভালবাসে লেনিনকে। অন্যসব বিপ্লবীদের মতই বাধনহীন লেনিনকে বাধতে পারে না শরমিন। বাধ্য হয়েই সে মত পরিবর্তন করে। পার্টির ভেতর কারো বিশ্বাসঘাতকতায় একদিন গ্রেফতার হয় লেনিন। নেমে আসে নির্মম রাষ্ট্রীয় নির্যাতন। জেলের ভেতর নিঃসঙ্গ লেনিন বুঝতে পারে শর্মিনের ভালোবাসা। মুক্তি পেয়ে যখন সে শর্মিনকে মনের কথা জানায় ততদিনে শর্মিন তাদের সহপাঠি কামালকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। রাজনৈতিক চাপে পড়ে ঢাকা ছাড়ে লেনিন। সে চলে যায় ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফির জন্য ইনানি কোরালরিফের উপর একটা ফিচার তৈরি করতে। আবার হাজির হয় সে রূপালী সৈকতের সেই বাংলোয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন এখানে হাজির হয় শর্মিন। জানা যায় শর্মিন মিসেস অর্থিসের প্রথম পক্ষের সন্তান। লেনিনের চোখে শর্মিন দেখে আনার জন্য ভালবাসা, সে সতর্ক করে দেয় আনাকে। শর্মিন বিদায় নেয়ে মায়ের কাছ থেকে, সে কামালকে বিয়ে করে কলম্বো চলে যাবে শিগগির। আনাকে ভালোবেসে লেনিন চেষ্টা করে ঘর বাধার কিন্তু ঠিক এমন সময় রুপালী সৈকতে হাজির হয় আনোয়ার। অসম্ভব সুন্দর একটি ছবি রূপালী সৈকতে। বাংলাদেশে এমন বহুমাত্রিক ছবি যা ‘একইসাথে সমকালীন দেশিয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সমকালীন উত্তাল আন্তর্জাতিক আন্দোলকে এক অসম্ভব সুন্দর একটি ছবি রূপালী সৈকতে।বাংলাদেশে এমন বহুমাত্রিক ছবি যা ‘একইসাথে সমকালীন দেশিয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সমকালীন উত্তাল আন্তর্জাতিক আন্দোলকে একই সাথে ধারন করে আছে’ এমনটি আর নির্মিত হয়নি। আশা করি আপনারা সময় পেলে ছবিটি দেখবেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট