চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আঠারো শতকের কবি আলী রজার পুঁথিসাহিত্য

শামসুল আরেফীন

১৭ জানুয়ারি, ২০২০ | ৩:০১ পূর্বাহ্ণ

ছোটবেলায় তাঁর নাম শুনেছি কানুফকির। বড় হয়ে শুনেছি এই কানুফকিরই আঠারো শতকের শক্তিমান কবি আলী রজা। চট্টগ্রামের আনোয়ারার অন্তর্গত গন্দ্রব্য জোয়ার, যা আজকের ওসখাইন, গ্রামে আলী রজার জন্ম।

তাঁর জন্মসন ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দ (১১২১ মঘীর ১৭ শ্রাবণ, ১৯ শাওয়াল, সোমবার দ্বোপ্রহর তিন ঘরি বাদ) এবং মৃত্যুসন ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ (১১৯৯ মঘীর ৫ মাঘ, ১৯ শাওয়াল, বুধবার)। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, তিনি ইংরেজ আমলের কবি। তিনি জীবদ্দশায় অনেক পুথি রচনা করেন। তবে ‘জ্ঞানসাগর’ পুথিটিই প্রসিদ্ধ।
আমরা তাঁর ‘জ্ঞানসাগর’-সহ এ পর্যন্ত ৩০টি গ্রন্থের নাম পেয়েছি।

১. জ্ঞানসাগর ২. আগম ৩. ষটচক্রভেদ ৪. ধ্যানমালা ৫. সিরাজ কুলুপ ৬. যোগকালন্দর ৭. শাহনামা (প্রথম ও দ্বিতীয় খ-) ৮. রাগতাল নামা ৯. ইসলাম নামা ১০. খাবনামা ১১. সৃষ্টিপত্তন ১২. হাতেম তাঈ ১৩. তাওফায়ে হেদায়তুল এজাম ১৪. আওরাদে আছানি ১৫. ছালাতুল মোক্তাদি ১৬. রফিকুচ্ছালেকীন ১৭. কিতাবে জরুরে মুকাল্লেদ ১৮. কিতাবে তাজহিজে তাকদ্বীন ১৯. আহকামুচ্ছালাত ২০. তাওফায়ে মকবুল ও ফজায়েলে রাসুল ২১. কিতাবে চেহেল হাদিছ ও মছায়েল ২২. খোতবায়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা ২৩. বয়ানে শবে বরাত ও শবে ক্বদর ২৪. রাহাতুর রুহ্ ২৫. তারিফে রাসুল ২৬. যোগ সাধন ২৭. তনের বিচার ২৮. জ্যোতিষ নামা ২৯. রাগনামা ৩০. অমরসিং।
বাংলা একাডেমিতে আলী রজার ‘জ্ঞানসাগর’-এর দুটি, ‘সৃষ্টিপত্তন’-এর একটি, ‘রাগতালনামা’-র একটি অনুলিপিসহ আরও দু’টি অনুলিপি, মোট ছয়টি অনুলিপি বা পা-ুলিপি, সংরক্ষিত। সেগুলোর পরিচিতি বৈশাখ ১৪০২, এপ্রিল ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে সুকুমার বিশ্বাসের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত পুঁথি পরিচয় (বাংলা একাডেমী পুঁথি পরিচয়-১) গ্রন্থে রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের পা-ুলিপি ও দু®প্রাপ্য শাখায় ‘জ্ঞানসাগর’-এর দু’টি এবং ‘রাগনামা’-র একটি অনুলিপি বা পা-ুলিপি সংরক্ষিত। পুথি সংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরী সংকলিত ও গ্রন্থাকারে এখনও অপ্রকাশিত ‘বাংলা পা-ুলিপির বিবরণ’-এ সেগুলোর পরিচিতি রয়েছে।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আলী রজার কতিপয় পুথির অনুলিপি বা পা-ুলিপি সংগ্রহ করেন। তিনি ‘জ্ঞানসাগর’ (১৯১৭) পুথি বা গ্রন্থের ‘ভূমিকা’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন : ‘জ্ঞানসাগর ব্যতীত আলী রাজার রচিত সিরাজ কুলুপ ও ধ্যানমালা নামক আরও দুই খানি গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে। কেহ কেহ যোগকালন্দর নামক যোগ শাস্ত্রীয় গ্রন্থকেও তাঁহার লেখনীপ্রসূত বলিয়া মনে করেন। এই গ্রন্থত্রয়ের পরিচয় আমার প্রাচীন বাঙ্গালা পুথির বিবরণে ১০৭, ১০৯ ও ৩০৭ সংখ্যক পুথির বিবরণে প্রদত্ত হইয়াছে। এই সকল ভিন্ন তাঁহার রচিত ষটচক্রভেদ গ্রন্থের কথাও শুনা যায়; কিন্তু আজ পর্যন্ত উহা আমার নয়ন পথে পতিত হই নাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সংগৃহীত, আলী রজার ‘জ্ঞানসাগর’-এর চারটি, ‘আগম’-এর একটি ও ‘সিরাজ কুলুপ’-এর একটি অনুলিপি সংরক্ষিত। তাঁর সংকলিত ‘পুথি পরিচিতি’ গ্রন্থে [সম্পাদক: আহমদ শরীফ; বাঙলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রথম মুদ্রণ: ভাদ্র ১৩৬৫, সেপ্টেম্বর ১৯৫৮] সেগুলোর পরিচিতি লিপিবদ্ধ আছে।
আলী রজার বর্তমান বংশধর ইলিয়াছ রজার কাছে শাহনামা (প্রথম ও দ্বিতীয় খ-)-র একটি ও সিরাজ কুলুপ-এর একটি অনুলিপি বা পা-ুলিপি সংরক্ষিত।

দুই.
পুথি ব্যতীত আলী রজা অজস্র বৈষ্ণব ও শাক্ত পদ রচনা করেন। সাহিত্যবিশারদ প্রাগুক্ত ‘ভূমিকা’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন : ‘প্রাগুক্ত গ্রন্থগুলি (জ্ঞানসাগর, সিরাজকুলুপ, ধ্যানমালা, যোগকালন্দর, ষটচক্রভেদ) ছাড়া তাঁহার রচিত অনেক বৈষ্ণব পদ পাওয়া গিয়াছে। সেই পদগুলি রাজশাহীর সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক বন্ধুবর শ্রীযুক্ত ব্রজসুন্দর সান্যাল মহাশয় তাঁহার মুসলমান বৈষ্ণব কবি নামক গ্রন্থে প্রকাশিত করিয়া দিয়াছেন। … তাঁহার সে সমস্ত গীতে রাধাকৃষ্ণের লীলার বর্ণনা আছে।’ মুসলমান বৈষ্ণব কবি গ্রন্থে আলী রজাসহ মোট ৪৩ জন মুসলমান কবির পদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সম্পাদিত বাঙ্গালার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি গ্রন্থেও আলী রজার পদ রয়েছে। এখানে আলী রজাসহ মোট ১০২ জন পদকর্তার প্রায় সাড়ে চারশ পদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আলী রজার পদসমূহ অত্যন্ত মূল্যবান। ড. অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের ‘আঠার শতকের কবি আলী রজা’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে : ‘কবি আলী রজার প্রধান খ্যাতি নির্ভর করিতেছে তাঁহার পদাবলীর উপর। তিনি যে একজন প্রতিভাধর পদকর্তা তাহাতে দ্বিমতের অবকাশ নাই, সঙ্গীতকলা সম্বন্ধেও তিনি বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন। তাঁহার ধ্যানমালা রাগতালের গ্রন্থ। কিন্তু তাঁহার ভণিতায় যে সমস্ত বৈষ্ণব ও শাক্ত পদ পাওয়া গিয়াছে তাহার কাব্যমূল্য ও ভক্তিরস বিশেষ প্রশংসনীয়।’
আলী রজার কয়েকটি বৈষ্ণব পদ, আমাদের সংগৃহীত, তুলে ধরা যাকÑ
১.
রাধাকৃষ্ণ লিলায় পিরিত
প্রেম বশে গায় যর্ন্ত গীত।
রাধিকার দেহমনে
টাকুরের বিন্দাবন
ষড় ঋতু রাঘ [রাগ] তথা বৈসে।
২.
মুই রাধা কি খেনে আসিলাম ঘাটে
নন্দের নন্দন ভুবন মোহন
দেখিয়া মরম ফাটে।
শুনি মুরলীর ধ্বনি ভ্রম যায় দেব মুনি
ত্রিভুবন হয় জর জর
৩.
বনমালী, তোমার বংশী জগ প্রাণ ॥ ধুয়াÑ
করুণ বংশীর সুরে দেব মুনি জ্ঞান হরে
জার হৃদে জাগে পঞ্চবাণ।
আলী রজার একটি শাক্ত পদের অংশবিশেষÑ
অষ্ট অলংকার চ-ি করি পরিধান।
মহানন্দে লৈল গৌরি সমর সাজান ॥
সিংহে আরোহন কালী হস্তেত কৃপাণ।
সুরবর্ণ ত্রিনয়নী সমরে পয়ান ॥

তিন.
আলী রজা অনেকগুলো পুথি রচনা করলেও তাঁর পাঁচটি মাত্র পুথি প্রকাশিত হয়। যেমনÑ জ্ঞানসাগর, আগম, ধ্যানমালা, ষটচক্রভেদ ও সিরাজকুলুপ। ড. আহমদ শরীফের একাধিক গ্রন্থে মুদ্রিত হয়ে সেগুলো প্রকাশিত হয়। তাঁর বাঙলার সূফী সাহিত্য গ্রন্থে ‘জ্ঞানসাগর’ মূলত পুনর্মুদ্রিত হয়। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে এটি সর্বপ্রথম আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে দু®প্রাপ্য হয়ে পড়ায় ড. আহমদ শরীফ তা অধ্যাপক ডক্টর মমতাজুর রহমান তরফদার থেকে সংগ্রহ করে বাঙলার সূফী সাহিত্য গ্রন্থে পুনর্মুদ্রণ করেন। জ্ঞানসাগর, আগম, ধ্যানমালা, সিরাজকুলুব বা সিরাজ কুলুপ, যষ্টচক্রভেদ বা ষটচক্রভেদ ইত্যাদি প্রকাশিত পুথি বাংলাসাহিত্যের ভা-ারে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, প্রকাশিত এই পাঁচটি পুথির একটি অর্থাৎ ‘জ্ঞানসাগর’ অসম্পূর্ণ। বাকি চারটি পুথি সম্পূর্ণ বা অসম্পূর্ণ উভয়ই হতে পারে। নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ‘জ্ঞানসাগর’ (১৯১৭) যে অসম্পূর্ণÑসাহিত্যবিশারদ তা নিজেই স্বীকার করেছেন। এর ‘ভূমিকা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন : “দুইখানি প্রতিলিপির সাহায্যে এই গ্রন্থ সম্পাদিত হইয়াছে। তন্মধ্যে একখানি ভানুশত পঞ্চদশ নেত্র আশ্বিনেতে বা ১২১৫ মঘী সন, ৩রা আশ্বিনের লেখা। সুতরাং উহার বয়স আজ ১২৭৮-১২১৫মঘী =৬৩ বৎসর মাত্র। এই প্রতিলিপিখানি অনেক বৎসর পূর্বে আমার আনোয়ারা অবস্থানকালে পটীয়ার উকিল বন্ধুবর শ্রীযুক্ত বিপিন বিহারী নন্দী মহাশয় আমাকে সংগ্রহ করিয়া দিয়াছেন। অপর পুথিখানি নিতান্ত আধুনিক, ৪/৫ বৎসর পূর্বের লেখা মাত্র। ইহা আমার মাতুল-ভ্রাতা পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান সিদ্দিক আহমদ চৌধুরীর সাহায্যে একবার দেখিবার সুযোগ পাইয়াছিলাম। …এখন দেখা যাইতেছে সেগুলিও সর্বাংশে সম্পূর্ণ ছিল না। সম্প্রতি আরবী অক্ষরে লেখা জ্ঞান-সাগরের একখানি প্রাচীন প্রতিলিপি আমার হস্তগত হইয়াছে। পুথিখানি আদ্যন্ত খ-িত হইয়া গিয়াছে বলিয়া উহার লিপিকাল জানা যায় না। তাই উহার প্রাচীনত্ব ঠিক নিরূপণ করার উপায় নাই। উহা প্রাচীন বাঙ্গালা কাগজের বহির আকারে উভয় পৃষ্ঠে লেখা। মোট পত্রসংখ্যা ১১০। উহা হইতে দেখা যায়, যেখানে আমরা গ্রন্থারম্ভ বলিয়া মনে করিয়াছি, সেখানে প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থারম্ভ নহে; তাহার পূর্বে গ্রন্থের আরও অনেক দূর আছে। বস্তুত আমাদের পূর্বপ্রাপ্ত অংশটি গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগ মাত্র। কিন্তু সে সময় আমাদের উপায়ান্তর ছিল না; অনেক চেষ্টা করিয়াও আমরা উহার তৃতীয় প্রতিলিপি সংগ্রহ করিতে পারি নাই। এখানকার এয়াকুব আলী সওদাগরের নিকটেও সম্প্রতি একখানি পুথি পাওয়া গিয়াছে। তাহাতেও দেখিতেছি, আরবী লেখা পুথির মত গ্রন্থের প্রারম্ভ ভাগে অনেকটা বেশী আছে। আমাদের পুথি পূর্বেই ছাপা হইয়া গিয়াছে। সুতরাং গ্রন্থের অন্তর্নিবিষ্ট করিতে পারিলাম না।”

চার.
‘জ্ঞানসাগর’ মূলগ্রন্থের একভাগ। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সংকলিত প্রাগুক্ত পুথি পরিচিতি গ্রন্থে আলী রজার ‘আগম’ নামক পুথির পরিচিতি রয়েছে। এটিই মূলগ্রন্থ। দু’ভাগে গ্রন্থটি বিভক্ত। ‘জ্ঞানসাগর’ হলো দ্বিতীয় ভাগ। বলেছি, ‘জ্ঞানসাগর’ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে অসম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্যবিশারদের ভাষায় এই অসম্পূর্ণতার বিবরণও দিয়েছি। বিবরণটি পড়ে মনে হতে পারে, দ্বিতীয় ভাগ হিসেবে ‘জ্ঞানসাগর’ সম্পূর্ণ, কিন্তু প্রথম ভাগের অনুপস্থিতির কারণে তা অসম্পূর্ণ। বস্তুত শুধু প্রথম ভাগের অনুপস্থিতির কারণে নয়, দ্বিতীয় ভাগ হিসেবেও তা অসম্পূর্ণ। শরীফ বিবরণটিকে কেন্দ্র করে তাঁর বাঙলার সূফী সাহিত্য গ্রন্থে বলেছেন : ‘সাহিত্যবিশারদ এখানে পুরো আগম (আগম পুথির প্রথম ভাগের নাম ‘আগম’) ও জ্ঞানসাগর-এর আদ্যাংশের কথাই বলেছেন ।’
উল্লেখ করেছি, ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যবিশারদের সম্পাদনায় প্রকাশিত অসম্পূর্ণ ‘জ্ঞানসাগর’ ড. আহমদ শরীফের বাঙলার সূফী সাহিত্য গ্রন্থে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। এখন উল্লেখ করছি, অসম্পূর্ণ ‘জ্ঞানসাগর’ পুনর্মুদ্রণের পূর্বে উল্লিখিত আদ্যাংশ উপস্থাপন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, অসম্পূর্ণ ‘জ্ঞানসাগর’-কে সম্পূর্ণ করে তোলা।
কিন্তু গ্রন্থটিতে আদ্যাংশটি সম্পূর্ণরূপে উপস্থাপিত হয় নি। যেখানে গিয়ে তা শেষ হয়েছে, এর পরে আরো অনেক দূর রয়েছে। আলী রজার বর্তমান বংশধর ইলিয়াছ রজার কাছে সংরক্ষিত ‘জ্ঞানসাগর’-এর অনুলিপি থেকে আমাদের সংগ্রহে রয়েছে এই বাকি অংশ।
বাঙলার সূফী সাহিত্য গ্রন্থে ২১৯-২৩০ পৃষ্ঠাজুড়ে উপস্থাপিত আদ্যাংশটির অভ্যন্তরেও অনেক অংশ বাদ পড়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, গ্রন্থটিতে আদ্যাংশটি সম্পূর্ণরূপে উপস্থাপিত হলেও জ্ঞানসাগর (১৯১৭) সম্পূর্ণ হতো না। জ্ঞানসাগর (১৯১৭) যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে (এর শেষ দু’ চরণÑ‘যোগীকুলে মায়াজাল পুড়ি ভস্ম করি/ সর্ব তেজি দড় মনে ইচ্ছিল ফকিরী’), তারপরে একটি বিরাট অংশ রয়ে গেছে। সাহিত্যবিশারদ ও ড. শরীফের এ সম্পর্কে কোন রকম ধারণাই ছিল না। আলী রজার বংশধর ইলিয়াছ রজার কাছে সংরক্ষিত ‘জ্ঞানসাগর’-এর অনুলিপি থেকে আমাদের সংগ্রহে রয়েছে উক্ত বিরাট অংশ।
সাহিত্যবিশারদ ও শরীফ মনে করতেন, জ্ঞানসাগর (১৯১৭) যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, তা-ই প্রকৃত শেষ।

পাঁচ.
উল্লেখ করেছি, বাঙলার সূফী সাহিত্য গ্রন্থে আলী রজার ‘আগম’ প্রকাশিত হয়েছে। সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছে কি না, তা শরীফ গ্রন্থটিতে উল্লেখ করেন নি। আলী রজার বংশধর খোরশেদুল্লা রজায়ীর কাছে সংরক্ষিত আগম, যা আমরা দেখেছি, তাঁর (ড. শরীফের) প্রকাশিত ‘আগম’ থেকে অনেক বৃহৎ।
আরবী, ফার্সী বাঙ্গলা ও পুরান।
আগম, জ্যোতিষী আর নাগরী বিদ্যান ॥
খোরশেদুল্লা রজায়ীর কাছে সংরক্ষিত ‘আগম’-এ চরণসমূহ রয়েছে, কিন্তু ড. শরীফের বাঙলার সূফী সাহিত্য গ্রন্থে প্রকাশিত ‘আগম’-এ নেই।

ছয়.
‘জ্ঞানসাগর ও সংক্ষিপ্ত জীবনী’ নামে আলী রজার ‘জ্ঞানসাগর’ দ্বিতীয়বার সম্পাদনা করেন তাঁরই পঞ্চম অধস্তন পুরুষ এস.এম.এ আলীম। গ্রন্থটিতে প্রকাশকাল লেখা ‘দ্বিতীয় সংস্করণ ’৮৫ ইং ডিসেম্বর।’ প্রকাশকাল এরূপে লেখা রয়েছে, কারণ, এস.এম.এ. আলীম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত অসম্পূর্ণ ‘জ্ঞানসাগর’ (১৯১৭)-কে প্রথম সংস্করণ হিসেবে চিন্তা করেছেন। এটা তিনি অবশ্যই ঠিক কাজ করেননি। একই গ্রন্থ কোন কারণে দ্বিতীয়বার কেউ সম্পাদনা করলে, দ্বিতীয়বার সম্পাদিত গ্রন্থ হিসেবে তা প্রথম সংস্করণই হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমবার যিনি গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন, সেটিকে প্রথম সংস্করণ চিন্তা করে, এটিকে দ্বিতীয় সংস্করণ হিসেবে দেখানোর কোন সুযোগ নেই। ‘জ্ঞানসাগর ও সংক্ষিপ্ত জীবনী’ দ্বিতীয় সংস্করণ হিসেবে চিহ্নিত হওয়াতে একটি মারাত্মক বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হয়েছে। পাঠ করতে গিয়ে সহজে বুঝার উপায় নেই যে, দ্বিতীয় সংস্করণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও এটি প্রথম প্রকাশিত। যা হোক, গ্রন্থটির প্রকাশক আলী রজার বংশধর মৌলবি শাহ তোফায়েল আহমদ (এস.এম.এ. আলীমের চাচাতো ভ্রাতা)। তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর মুরিদ এম.এ. গফুর খান বি.কম (মালিকÑমেসার্স আলমগীর এন্ড কোং, ১৪৯ নং পশ্চিম মাদার বাড়ি, চট্টগ্রাম)-এর অর্থানুকূল্যে। মুদ্রিত হয়েছে, ‘বশর প্রিন্টিং প্রেস, ১৪২, ফিরিঙ্গী বাজার, চট্টগ্রাম’ থেকে। গ্রন্থটির মূল্য- ‘২৫ টাকা মাত্র।’ প্রকাশিত হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। সুধী সমাজ বা বাংলা সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠক সমাজের সকাশে পৌঁছুতে পারেনি। ফলে নিউজপ্রিন্টের কাগজে মুদ্রিত ১৬৮ পৃষ্ঠা সম্বলিত গ্রন্থটির যথাযথ মূল্যায়নও হয়নি। এর মুখবন্ধ লিখেছিলেন ড. আহমদ শরীফ।
এ গ্রন্থে এস.এম.এ আলীমের জোরদাবি এই : ‘জ্ঞানসাগর পূর্ণাঙ্গরূপে রূপায়িত করা হল।’ আমাদের মতে, পূর্ণাঙ্গরূপ দেয়া যায়নি। কেননা এ গ্রন্থে সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত ‘জ্ঞানসাগরের’ (১৯১৭) প্রথম ১১০ চরণ অনুপস্থিত।

সাত.
সাহিত্যবিশারদের সম্পাদনায় ‘জ্ঞানসাগর’ (১৯১৭; ১৩২৪) প্রকাশিত হওয়ার ফলেই আলী রজা আঠারো শতকের কবি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন। একদিকে তিনি এই স্বীকৃতি অর্জন করেন, অন্যদিকে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ ‘জ্ঞানসাগর’ হাতের নাগালে পেয়ে পরিতৃপ্ত হন। সাহিত্যবিশারদ প্রাগুক্ত ‘ভূমিকা’-য় বলেছেন : ‘…এই জ্ঞানসাগর পুথির জন্য চট্টগ্রামের বহুলোক এতদিন সাগ্রহচিত্তে প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, কিন্তু তাঁহাদের সেই আকাক্সক্ষা পূর্ণ করিবার জন্য এদেশে আজ পর্যন্ত কেহ অগ্রসর হন নাই। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কৃপা না করিলে তাঁহাদের সেই বাসনা পূর্ণ হইতে আরও কত যুগ অতিবাহিত হইত, কে বলিবে?’ প্রসঙ্গত, সাহিত্যবিশারদের সম্পাদনায় ‘জ্ঞানসাগর’-এর প্রকাশকাল ১৯১৭ (১৩২৪) হলেও, তা মূলত সম্পাদিত হয় ১৯১৬ (১৩২৩)-এ। ড. শরীফ তাঁর গ্রন্থে (২০০৩) উল্লেখ করেছেন : ‘জ্ঞানসাগর মরহুম আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সম্পাদনা করেছিলেন ১৩২৩ সনে এবং তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থটি ১৩২৪ সনে প্রকাশিত হয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে।’
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে ‘জ্ঞানসাগর’ প্রকাশিত হওয়ার নেপথ্যে সম্ভবত রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অবদান ছিল। ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত নির্বাচিত রচনা / আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ গ্রন্থের (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪, মাঘ ১৪০০, বাংলা একাডেমি) ২৬৭-২৬৮ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ সাহিত্যবিশারদকে লেখা রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর একটি চিঠি থেকেই এ অনুমান। চিঠিটির এক জায়গায় লেখা : ‘জ্ঞানসাগরের কপি আপনার নিকট ফেরৎ গিয়াছে, শীঘ্র সংশোধন করিয়া পাঠাইলে উহা প্রেসে দেওয়া যাইবে।’ অন্য এক জায়গায় লেখা : ‘জ্ঞানসাগর সংশোধন করিয়া শীঘ্র পাঠাইবেন।’
যা হোক, ১৩২৪ (বা ১৯১৭)-এ ‘জ্ঞানসাগর’ প্রকাশিত হওয়ার ফলে আলী রজা আঠারো শতকের কবি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন এবং চট্টগ্রামের সে সময়কার সাধারণ মানুষ পরিতৃপ্ত হন- কেবল এসবই নয়, এও প্রমাণিত হয় যে, তিনি আঠারো শতকের অন্যতম কবি। বলা অনাবশ্যক, একজন বিদেশি গবেষক, সম্ভবত আমেরিকান, ঙপবধহ ড়ভ খড়াব নামে ‘জ্ঞানসাগর’ (১৯১৭) অনুবাদ করেছেন।

আট.
আলী রজা পুথি, পদ প্রভৃতি ছাড়া অজস্র সঙ্গীতও রচনা করেন। তাঁর বর্তমান বংধরদের কয়েকজন আমাদের জানান, আলী রজা প্রায় সাড়ে সাতশত সঙ্গীত রচনা করেন। এ তথ্য জানানোর পাশাপাশি তাঁরা একথাও জানান যে, তাঁদের কাছে এ সকল সঙ্গীতের একটিও সংরক্ষণে নেই। খোরশেদুলা রজায়ী জানানÑ আলী রজার ছয়শত সঙ্গীত তাঁর কাছে সংরক্ষিত। এ তথ্য জানার পরে তাঁর কাছে বারংবার ছুটে গিয়েছি সঙ্গীতসমূহ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরবর্তীতে যে কোন কারণে হস্তগত করতে পারি নি। সম্প্রতি আলী রজার কিছু সঙ্গীত বা গানের কোনটির প্রথম চরণ, কোনটির প্রথম ও দ্বিতীয় চরণ চন্দনাইশ থানার বৈলতলি গ্রামের এক বৃদ্ধের স্মৃতি থেকে সংগ্রহ করেছি।
আলী রজা বারমাসিও রচনা করেন। চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার গাছবাড়িয়া নিবাসী ছায়ের আহমদ নামক জনৈক বৃদ্ধের কাছ থেকে বিগত ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি উল্লেখযোগ্য ও দু®প্রাপ্য বারমাসি সংগ্রহ বা উদ্ধার করতে সক্ষম হই। তিনি বলেন, ‘উদবের বারমাস শিরোনামের এই বারমাসি সম্পূর্ণ এবং এর রচক আঠারো শতকের কবি আলী রজা’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের পা-ুলিপি ও দু®প্রাপ্য শাখায় সংরক্ষিত ১১০ নং পা-ুলিপিতে (মূলত এটি বারমাসির সংকলন) ১৬ নং বারমাসি হিসেবে ‘উদবের বারমাস’ লিপিবদ্ধ। তবে সেখানে তা অসম্পূর্ণ, শিরোনামহীন এবং অজ্ঞাত কবির রচিত।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট