চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে প্রতিবছরের মতো ১২ই বৈশাখে এবারও বসবে জব্বারের বলি খেলার ১১৬ তম আসর। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এই দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ বলি খেলা প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী-দামি বলিরা এ খেলায় অংশ নিতেন।
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন করা । এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলিখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলিখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। পটিয়ার আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, আনোয়ারা চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, বড়লিয়ার পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদন্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, বোয়ালখালীর খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল। মুলত এই মল্লরাই এই বলিখেলায় বিরাট সময় জুড়ে প্রভুত্ব করেছিলো। তাদের দাপটে অন্য এলাকার বলিদের খেলায় জয়ী হওয়া দুরূহ ছিলো।
‘জব্বারের বলি খেলা’ বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ-ছয় দিনের মেলা বসে লালদীঘির ময়দানের চারপাশের এলাকা ঘিরে। জব্বারের বলি খেলার পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থানে যেমন কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলি খেলা, সাতকানিয়ায় মক্কার বলি খেলা, আনোয়ারায় সরকারের বলি খেলা, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলি খেলা, হাটহাজারীতে চুরখাঁর বলি খেলা, চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলি খেলা এখনও কোনরকমে বিদ্যমান।
আগামী ২৫ এপ্রিল ১২ই ১৪৩২ বৈশাখ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলি খেলার ১১৬ তম আসরটি অনুষ্ঠিত হবে। ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানে ঐদিন শুক্রবার বিকাল ৪ টায় অনুষ্ঠিত হবে দেশের জনপ্রিয় এই বলি খেলার প্রধান আর্কষণ বলি বা কুস্তি প্রতিযোগিতা । ঐতিহ্যবাহী এ বলি খেলা উপলক্ষে প্রতিবছরের মত এবারও ২৪, ২৫ ও ২৬ এপ্রিল, ১১, ১২ এবং ১৩ বৈশাখ লালদীঘি এলাকায় বসবে দেশের সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলা। এই বলিখেলাকে কেন্দ্র করে লালদীঘি ময়দানের আশে পাশে হতে কোতোয়ালী মোড়, আন্দরকিল্লা মোড়, সিনেমাপ্লেস মোড় পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন হয়। চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষ সহ আশেপাশের জেলা থেকে আগত মানুষজন আবহমান কাল থেকে এই মেলা থেকে ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও তৈজসপত্র কিনে আসছে। যেমন বেতের পাটি, শীতল পাটি, মাদুরা, চাটাই, দা-বটি, রুটি তৈরির তাবা- বেলুনি, ফুলের ঝাড়ু, নারিকেল গাছের ঝাড়ু, হাতপাখা, মরিচ বাটার পাটা-উতা, তালগাছের পাখা, খাট-পালং, ইজিচেয়ার, বাঁশ, বেত ও মাটির তৈরি নানান জিনিসপত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। খাবারের মধ্যে চালের জিলাপি, রুটি, গজা, তিলের টকি, মুড়ির টকি, চিড়ার মলা, মুড়ির মলা, খৈ, রুটি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও লাঙ্গল, ফলা, বরশি, গরম ও বর্ষাকালে মানুষের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র ছাড়াও গৃহস্থালি কাজের সবকিছুই পাওয়া যায় এই মেলায়। তাছাড়া ঘর সাজানোর নানা জিনিসপত্রের সমাহার। মেলা উপলক্ষে নার্সারিতে বেশি বিক্রি হয় নারিকেলের চারাগাছ, আম-কাঁঠালের চারাগাছ হতে নানা জাতের ফুল ও ফলের গাছ। যা এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সেই সাথে মাছ ধরার জাল সহ নানা সরঞ্জাম। দেশ-বিদেশে আলোচিত এই মেলা চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হলেও গ্রামীণ ঐতিহ্যের সবকিছু এখনো টিকে আছে এই মেলায়। এই অঞ্চলের মানুষ সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে এই বলি খেলা ও বৈশাখী মেলার জন্য। যেন গ্রামীণ ও প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এই মেলা। করোনার দুই বছর বন্ধ থাকার পর আবারও স্বরুপে ফিরেছে সারা চট্টগ্রামের গর্ব এই খেলা ও মেলা। আউলিয়ার পূর্ণ্যভূমি চট্টলার মাটিতে হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকুক এই মেলা। এই খেলা। সেই প্রত্যাশায় করি।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও ক্রীড়া সংগঠক
পূর্বকোণ/আরআর/পারভেজ