চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

শিশু সাহিত্যে নজরুল

ড. মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৮ পূর্বাহ্ণ

শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত শিশুপত্রিকা ‘মুকুল’-এর প্রথম বর্ষের ২য় সংখ্যায়-মুকুল কাহাদের জন্য এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছিলেন এভাবে,

‘অনেকের ধারণা আছে, মুকুল ছোট ছোট শিশুদের জন্য অর্থাৎ যাহাদের বয়স ৮/৯ বছরের মধ্যে প্রধানত. তাহাদের জন্য। মুকুলে এমন অনেক কথা থাকে, যাহা এত অল্পবয়স্ক শিশুগণ বুঝিতে পারে না এবং বুঝিবার কথাও নয়। অতত্রব মুকুল সম্পূর্ণরূপে ছোট শিশুদের জন্য নহে। যাদের বয়স ৮/৯ হইতে ১৬/১৭ এর মধ্যে ইহা প্রধানত তাহাদের জন্য। আমরা লিখিবার সময় এই বয়স এই বয়সের বালক-বালিকাদের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া লিখি।’

এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে শিশু সাহিত্য কাকে বলে, শিশুসাহিত্যের ব্যাপক অর্থ রয়েছে। ব্যাপক অর্থে শিশুসাহিত্য হচ্ছে ৫ বৎসরের অধিক ও ১১ বৎসরের অনধিক বয়স্ক বালক-বালিকাদের জন্যে রচিত যে কোন সাহিত্য পদবাচ্য রচনাকেই বুঝায়। বয়সের এই মাপকাঠি সাধারণ শিশুদের গড়পড়তা মানসিক উৎকর্ষ বিচারের উপর নির্ভরশীল। আবার অপরদিকে ১১-১৫ বছরের শিশুদের নিয়ে রচিত সাহিত্যও শিশুসাহিত্যের মধ্যে পড়ে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘ঈযরষফ রং হড়ঃ ধ সরহরধঃঁৎব ড়ভ সধহ’ অর্থাৎ শিশু বয়স্ক মানুষের ক্ষুদ্র সংস্করণ নয়। আমরা অনেকেই শিশুকে বয়স্ক মানুষের ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসাবে মনে করি। আবার কেউ কেউ ভুল করে শিশুকে মিনি পেস্ট, মিনি ক্যামেরা ও মিনি সাইনিজের মত শিশুকে মিনি মানুষ মনেকরি। এই বিষয়টি শুধু শিক্ষক নন সমাজের সবাই মনেকরি। আর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেতো আছেই।
আমাদের এই কথাটি ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, শিশু আকারে ছোট হতে পারে তবে তার আবেগ, রাগ, অনুভুতি, ভালবাসা, বোঝার ক্ষমতা, ঈর্ষা ইত্যাদি বয়স্ক মানুষের মত। তাহলে আমার প্রশ্ন আমরা একজন বয়স্ক মানুষের আবেগ, অনুভুতি, দুঃখবোধ ইত্যাদিকে যদি গুরুত্ব দিই, সম্মান করি তাহলে কেন আমরা একজন শিশুর এই বিষয়গুলোকে সম্মান দেখাবো না? আর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেতো তাদের চিন্তার খোরাককে প্রাধান্য দিতেই হবে।

একজন শিশুর চাহিদা বুঝার জন্য একজন বয়স্ক শিশু মনের মানুষ খুবই জরুরী। শিশুদের নিয়ে আমাদের কাজ করতে গেলে কেন আমরা নিজেরা শিশু হব না? আর এই রকম শিশু-সুলভ আচরণ না হওয়ার সঙ্গত কারণ হচ্ছে সনাতনী ধ্যান-ধারণা পোষণ। আমরা যদি শিশুদের নিয়ে কাজ করতে যাই তবে কেন শিশুর চাহিদা, তার মানসিকতা, তার চিন্তা চেতনাকে বুঝব না? শিশুকে তার চিন্তা চেতনার মধ্যে এমন ভাবে একজন সাহিত্যিক শিশুর মায়ের মত তাদের অনুভূতির মূল্য দিবেন সাহিত্যের মধ্যে। কারণ, সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে শিশুর আগামী দিনের সমস্ত কর্মকা- সহজ সাবলীল ভাবে স্বপ্ন দেখে জাগিয়ে তোলার। তার আবেগ অনুভূতি দিয়ে জীবনকে-পরিবেশকে বুঝতে শেখে। সে তার চারদিকে শুধু মনে করে সব কিছুই সহজ ও সাবলীল।
বাংলাসাহিত্যে শিশুদের নিয়ে নজরুলের আগে যাঁদের বিশেষ অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালন্কার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সুকুমার রায়, সত্যন্দ্রনাথ দত্ত, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার প্রমুখের নাম স্মরনীয়। রবীন্দ্রনাথ শিশুর মধ্যে অনুভব করেছেন ভগবান ও বিশ্বপ্রকৃতির লীলারহস্য। অনেক সময় তিনি ভেবেছেন যে শিশু মহাকালেরই এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। কোন কোন ক্ষেত্রে শিশুর আত্মবিস্মৃত, নির্লোভ, খেয়ালী ও নিরাসক্ত জীবনের মধ্যে তিনি নিজের বস্তুগ্রাসমুক্ত সত্তাকে খুঁজে পেয়েছেন। যাত্রা গ্রন্থের একজায়গায় লিখেছেন এভাবে,
‘ঐ শিশু ভোলানাথ’-এর কবিতাগুলো খামাখা কেন লিখতে বসেছিলুম? সেও লোকরঞ্জনের জন্যে নয়, নিতান্ত নিজের গরজে।….আমেরিকার বস্তুগ্রাস থেকে বেরিয়ে এসেই ‘শিশু ভোলানাথ’ লিখতে বসেছিলুম। বন্দী যেমন ফাঁক পেলেই ছুটে আসে সমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে, তেমনি করে।… প্রবীণের কেলার মধ্যে আটকা পড়ে সেদিন আমি তেমনি করেই আবিষ্কার করেছিলুম অন্তরের মধ্যে যে শিশু আছে তারই খেলার ক্ষেত্র লোকে লোকান্তরে বিস্তৃত। এই জন্যে কল্পনায় সেই শিশুলীলার মধ্যে ডুব দিলুম, সেই শিশুলীলার তরঙ্গে সাঁতার কাটলুম, মনটাকে স্নিগ্ধ করবার জন্যে, নির্মল করবার জন্যে, মুক্ত করবার জন্যে।’

নজরুলের সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে শিশুদের নিয়ে স্বল্প-পরিসরে কাজ রয়েছে। কিন্তু স্বল্প কাজ যে মহাসগরকে অতিক্রম করেছে। ঝিঙেফুল, ঘুমজাগানো পাখি কাব্যগ্রন্থ, পুতুলের বিয়ে নামক নাটক ও কবিতা সংকলন, শেষ সওগাত, সঞ্চয়ন, ঝড়ে’র অন্তর্গত কতকগুলি রচনা এবং কয়েকটি সাময়িক পত্রপত্রিকায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত রচনাবলী নিয়ে নজরুলের শিশু সাহিত্য। পুতুলের বিয়ে গ্রন্থে সাতভাই চাম্পা নামে একটি দীর্ঘ কবিতা আছে। তবে সেখানে মাত্র চার ভাইয়ের কথা দেখতে পাওয়া যায়। কবিতাটির বিষয়ে শামসুন্নাহার মাহমুদ লিখেছেন এভাবে,

‘…..নজরুল সাতভাই চম্পা’র কবিতা তাঁর ত্রিশ বছর আগেকার চট্টগ্রাম সফরের সময় আমাদের বাড়িতে বসে লেখেন।…সেখানে এত হৈ-হুলোড়ের মধ্যে তাঁর দিনগুলো কেটেছিল যে, চম্পা ভাইদের সকলের কথা বলে শেষ করা হয়ে ওঠেনি তাঁর।’
১৯৬৩ সালে নজরুল’র পিলে-পটকা তুতুলের ‘বিয়ে’ নামক নাটিকা ও কবিতার বই প্রকাশ করেন। ১৯৬৫ সালে নজরুলের ঘুমপাড়ানী মাসি-পিসি’ নামে ২য়-৪র্থ শ্রেণীর পাঠ্য কবিতা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। শিশুদের জন্য শ্রেণীর রচানার ক্ষেত্রে নজরুল ছিলেন আন্তরিক। নজরুল শিশুকালে যে খামখেয়ালীপনার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন ঠিক তাঁর সাহিত্য বিচার করলেও সেটি সহজে ধরা পড়ে। তিনি শুধু শিশু সাহিত্য নয় বরং বড়দের জন্য রচিত অনেক কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধে তাঁর উদাস, খামখেয়ালী ভাবকে ফুটিয়ে তুলেছেন। অবশ্য এটি একদিকে দারুণ কাজ দিয়েছে যে, ভাবলেশ, উদ্যমহীন, আবেগ শিশু সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে। শিশুদের নিয়ে নজরুল অতবেশি কাজ না করলেও তিনি যেটুকু কাজ করেছেন তার বাংলা সাহিত্যে দারুণ কাজে লেগেছে, যা অসাধারণও বটে। শিশু সাহিত্যের অনেকগুলো জায়গায় নজরুল অনেকটা অপ্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। নজরুল শিশুদের ভালবাসতেন গভীরভাবে এই প্রসঙ্গে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় লিখেন এভাবে,
‘একটা পয়সা যখন হাতে নেই, মুজাফফর আহমেদ’র সঙ্গে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত হওয়ার দিন চলে যাচ্ছে, সেই সময়ও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ২০/২৫ টাকার দায়ে পড়েছিলেন।…….আমার প্রথমা কন্যার বয়স ৩ বছর তাকে আদর করে বলেছিলেন মোটরে ছড়িয়ে তোকে সারা কলকাতা দেখিয়ে আনব। ২মাস পর একদিন সকালে নজরুল আসলে মেয়ে বলে বসে-কাজীকাকু আমায় মোটরে চড়ালে না, কালই দেশে চলে যাচ্ছি। একমুহূর্ত বিলম্ব না করে নজরুল তাকে নিয়ে মোটরে সারা কলকাতা ঘুরে আসলেন। অবশেষে মোটর ভাড়াটাও তার নাই-অবশেষে কুতুবউদ্দিন থেকে ধার করে রাতে ট্যাক্সিভাড়া পরিশোধ করলেন।’

নজরুলের শিশু সাহিত্যে শিশুদের ৩টি বিষয়ে সজাগ হতে পরামর্শ খুঁজে পাওয়া যায়-
ক. কখনও কর্তব্যকর্ম স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।
খ. আত্নচেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে তাগিদ দেয়া হয়েছে।
গ. মহৎকর্ম ও জ্ঞানের পথে আহ্বান করেছেন।
শিশু ভোলানাথ-ও অন্যান্য শিশুগ্রন্থের অনেক স্থলেই জীবনরহস্য, দার্শনিক জিজ্ঞাসা ও স্বগীয় অনুভূতির দুরূহ ফুটে উঠেছে ঠিক তেমনি নজরুলের ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থে ঝিঙেফুল নামক কবিতা ছাড়া ‘খুকী ও কাঠড়িালী’, খোকার খুশী, খাঁদু-দাদু, দিদির বে, তে খোকা, মা, খোকার বুদ্ধি, কৈাকার গল্প বলা, চিঠি, প্রভাতী, লিচু-চোর, প্রভাতী, লিচুচোর, হোদল-কুঁৎকুঁতের বিজ্ঞাপন, ঠ্যাং-ফুলী ও পিলে-পটকা, এই তেরটি কবিতা আছে। এবার আমি কবির প্রভাতী কবিতার বর্ণনাটি তুলে ধরছি-
‘ভোর হোলো/ দোর খোলো/খুকুমণি ওঠ রে।
ঐ ডাকে/জুঁই-শাখে/ফুল-খুকী ছোট রে!
রবি মামা/দেয় হামা/গায়ে রাঙা জামা ঐ,
দারোয়ান/ গায় গান/ শোনো ঐ, রামা হৈ!’

এই ছড়াটি ছোটবেলায় শুনে আমরা ঘুম থেকে জেগেছি, আবার অনেক সময় কেউ এই ছড়াটি না শোনালে আমরা নিজেরা ছড়াটি মুখস্থ আবৃত্তি করেছি। ছড়াটিতে নজরুল যে শুধু সকাল হয়েছে শিশুদের তা বলছে নয়, তিনি সূর্যের আভা, সকালে ওঠার পর শিশুর কাজ কি ইত্যাদি বিষয়ে শিশুকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। অপরদিকে নজরুলই একমাত্র কবি যিঁনি শিশুদের সৃষ্টির নানা প্রজাতির রূপ, রস বর্ণনা করে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। এই রকম একটি রচনা হল-
‘প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই!
এমন রঙিন পাখা!
টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা
পেলে এমন রঙিন পাখা!’
আবার ঝিঙেফুল কবিতাটিতে তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন,
‘ঝিঙেফুল! ঝিঙেফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া পিঙে-কুল-
ঝিঙেফুল!

গুল্মে পর্ণে/লতিকার কর্ণে/ঢল ঢল স্বর্ণে/ঝলমল দোলে দুল-ঝিঙেফুল।’
শিশু সওগাত কবিতায় কবি শিশুদের নানাভাবে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন, তিনি শিশুদের মধ্যে লুকায়িত প্রতিভা এবং তা সমাজের কল্যাণে জাগিয়ে তোলার বিষয়ে দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। শিশু সওগাতে একজন শিশুর নানা শাররীক অঙ্গভঙ্গি ও তা বেড়ে উঠার বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেছেন। তিনি বলেছেন এভাবে,
‘ওরে শিশু, ঘরে তোর এল সওগাত,
আলো পানে তুলে ধর ননী-মাখা হাত!
নিয়ে আয় কচিমুখে আধো আধো বোল,
তুলতুলে গাল ভরা টুলটুলে টোল!
চকচকে চোখে আন আলো ঝিকমিক,
খুলে দেরে তুলে দেরে আঁধারের চিক।’
কবি ছিলেন দারুণ প্রকৃতি প্রেমী, তিনি একাধারে কাব্য চর্চার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রও যোগ করেছিলেন প্রকৃতির নানা খেয়ালি বিষয় গুলোকে উপস্থাপন করে। কবিতা গুলোতে শিশুদের প্রকৃতির সৃষ্টি রহস্য জানিয়ে দেয়ারও একটি বড় তাগিদ লক্ষ্য করতে পারি। এই রকম একটি কবিতা হল-
‘কাঠবেরালি! কাঠবেরালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবিনেবু? লাউ?
বেরাল-বাচ্ছা? কুকুর ছানা? তাও?-
… …
কাঠবেরালি! তুমি আমার ছোড়দি হবে? বৌদি হবে? হুঁ
রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না? উঃ!’
কাঠবিড়ালিকে দিদি, বৌদি, রাঙা দিদি বানানোর প্রস্তাব একজন শিশু কিভাবে দিতে পারে এবং অভিকল সেই ভাবেই কবি কবিতাটিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। লিচুচোর কবিতায় নজরুল ছোটবেলার নানা দুষ্টামির বিষয় গুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন এভাবে,
‘বাবুদের তাল-পুকুরে/হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া/বলি থাক একটু দাঁড়া।’
পরবর্তি লাইনগুলোতে লিচু চুরির পুরো কাহিনী বর্ণনা করেছেন এবং সেখানে কি কি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তারও একটি বর্ণনা দিয়েছেন। অপরদিকে কবির কাছে শিশুদের নানাবাড়ি, তাদের কারো বিয়ে, লাল নীল বাতি জ্বলার আভাস ইত্যাদি যে কতটা প্রিয় তাও কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এমন একটি কবিতা হচ্ছে-
‘কি যে ছাই ধানাই পানাই-
সারাদিন বাজছে শানাই,
এদিকে কারুর গা নাই
আজি না মামার বিয়ে!’

মামার বিয়েতে মজা হবে, সানাই বাজবে, সবাই আনন্দ করবে এবং নানা রকম আনন্দ হবে এইসব কথা অত্যন্ত সুন্দর ও সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন কবি তার লেখনিতে। দাদা-দাদির পরস প্রত্যেকটি নাতি, নাতনীর জন্য রয়েছে। কবিও বাদ যাননি। দাদুরা যখন বার্ধক্যকে যায় তখন তার কাছে প্রকৃতি শিশুর যতগুলো আচরণ তার সব কয়টি নিয়ে আসে। বার্ধক্যকে দাদা-দাদি সংসারের নাতি-নাতনিদের সাথে মিশে শেয়ার করার চেষ্টা করেন। ঠিক সেই রকম একটি চেষ্টা হলো-
‘অ-মা!তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা-নাক ডেঙেেেডং ড্যাং।’
সংসারে বাবা যতই ভুমিকা রাখুক না কেন সন্তানদের সাথে নিকটতম সম্পর্ক কিন্তু মায়ের। আমরা যখন ছোটবেলায় ছিলাম বাবাকে কিছুই বলতে পারিনি, বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোরও সাহস আমাদের ছিল না, আমরা বাবার সাথে কোনদিন কোন বায়না, অভাব অভিযোগ বলতে পারিনি। তৎরূপ আমাদের সন্তানও, তারাও সকল বায়না তাদের মায়ের সাথেই। মা তাদের সকল সমস্যার সমাধানের একমাত্র অবলম্বল। কবির খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন এবং মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মা-কবিতায় সেই বিষয়টি ফুটে উঠেছে-

‘যেখানেতে দেখি যাহা/ মা-এর মতন আহা/একটি কথায় এত সুধা মেশা নেই,
মায়ের মতন এত/ আদর সোহাগ সে তো/আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই।’
শিশুর কাছে কবিদার চিঠি একটি অপূর্ব কবিতা! এই কবিতায় ছন্দ-এই পথটা কাটবো পাথর ফেলে মারবো। কবিতাটি ১৩২৮ সালের মাঘ সংখ্যা ‘বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য পত্রিকা’য় আত্নপ্রকাশ করে।
‘মা মাসীমা’য় পেন্নাম/এখান হতেই করলাম/স্নেহশিস এক বস্তা/
পাঠাই, তোরা লস তা/সাঙ্গ পদ্য সবিটা/ইতি! তোদের কবিদা।’
শিশুমনের বিচিত্র কল্পনার রূপকথা ‘খোকার গল্প বলা’-। ১৩২৮ সালে কবিতাটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য পত্রিকায়’ প্রকাশিত হয়। গল্পটিতে শ্রীযুত খোকন গম্ভীর চালে স্টান কেদারাতে শুয়ে মাকে যে গল্প বলে চলেছে তা বিশেষ চিত্তাকর্ষক,
‘একদিন না রাজা-
ফড়িং শিকার করতে গেলেন কেয়ে পাঁপড় ভাজা।’
কবি ছোটদের মনের ইচ্ছা, অভিব্যাপ্তি নিয়েও কম লিখেননি। তিনি ‘কি কি হবি বল’ কবিতায় শিল্পকল্পনার সুন্দর স্ফুর্তি দেখা যায়। এই কবিতায় বোন তাদের সাত ভাইকে জীবনের গতি কি হবে এই সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন তখন কেু প-িতমশাই, কাবলীওয়ালা, ফেরিওয়ালা, জজসাহেব, দারোগা ও কনেস্টেবল হওয়ার ইচ্ছা পোষন করেছেন। সাত ভাইয়ের মধ্যে সপ্তম ভাইয়ের ইচ্ছাটা ছিল ভিন্ন রকম, তিনি বলেছেন এভবে,
‘আমি হব বাবার বাবা/ মা সে আমার ভয়ে
ঘোমটা দিয়ে লুকোবে কোণে/চুণি-বিলী হয়ে।
বলব বাবায়, ওরে খোকা/শীগগীর পাঠশা চল।’

অপরদিকে জিজ্ঞাসা কবিতায় কবি এভাবে মনের অভিব্যাপ্তি প্রকাশ করেছেন,
‘রব না চক্ষু বুজি/আমি ভাই দেখব খুঁজি
লুকানো কোথায় কুঁজি/দুনিয়ার আজব-খানায়।’
নবাব নামতা পাঠ’-এর একটি অংশ নামতা পাঠ সেটি সত্যিকার অর্থে এক অপূর্ব আনন্দের লেখা যা শিশুদের উৎসাহিত ও আনন্দিত করে তোলে,
‘একেককে এক-/বাবা কোথায় দেখ্ । দুয়েককে দুই-/নেইক? একটু শুই।
তিনেককে তিন-/উহু হু! গেছি!-আলপিন! চারেককে চার-/ঐ ঘরে আচার!
পাঁচেককে পাঁচ-/হুই দেখ কুলের গাছ!/ছয়েককে ছয়-/বাবা গুড় বয়।
সাতেককে সাত/ পন্ডিতমশাই কাত/ আটেককে আট-/আমি বড়লাইট!
নয়েককে নয়-/আর একটু ভয়।/দশেককে দশ-/বাবা আপিস! ব্যস!’
শিশুরা সাধারণত কালো কিছু সহজে পছন্দ করে না কিন্তু কালো জাম শিশুর জন্য একটি বিশেষ নির্দেশিকা। শিশু কালো জামকে নানা উদাহরণের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। শিশু মনে করেন কালো জাম মানে ভাল জাম। তাই ‘কালো জাম রে ভাই’ কবিতায় শিশু অন্য অনেক পলের সঙ্গে কালো জামের অনেক গুলো সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। শিশু কিভাবে কালো জামকে কল্পনায় এঁকেছেন তার একটি বাস্তবতা হল এমন,
‘কালো জাম রে ভাই!/ আম কি তোমার ভায়রা ভাই?
লাউ বুঝি তোর দিদিমা/ আর কুমড়ো তোর দাদামশাই!’

শিশুদের জাগিয়ে তোলার জন্য নজরুল তার সাহিত্য চর্চায় নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন। শিশুদের তিনি জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার নানা কৌশল সম্পর্তেও সচেতন করেছেন। তিনি ‘জাগো প্রাণ অফুরান’ কবিতায় এভাবে বিষয়টিকে বুঝাতে চেয়েছেন,
‘দুরন্ত দুর্মদ প্রাণ অফুরান/ গাহে আজি উদ্ধত গান।
লঙ্ঘি গিরি দরী/ঝঞ্ঝা-নূপুর পরি/ ফেরে মন্থন করি অসীম বিমান।’
ছোটদের মধ্যে যা কবি রচনা করেছেন তন্মধ্যে ‘সাত ভাই চম্পা’-উল্লেখযেগ্য। সাত ভাই চম্পা কবিতায় শিশুর নানা কৌতূহল, নানা উচ্চাভিলাস, কল্পনা, কবিতাটির স্তবকে স্তবকে ফুটে উঠেছে। শিশুর অবাধ কল্পনা শক্তিকে তিনি বহুদূর প্রসারিত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। যদিও কবিতাটি পড়লে মনে হবে যে, কবিতাটি অসম্পূর্ণ কিন্তু চার ভাইয়ের যে ইচ্ছাকে এখানে ফুটে তোলা হয়েছে তাতে শিশুদের মনের সব কথা এখানে সন্নিবেশিত হয়ে আছে। যেমন,
‘ফুলের বনে ফুল ফোটাব, অন্ধকারে আলো
সূয্যি মামা বলবে ওঠে, খোকন ছিলে ভালো?
বলব মামা, কথা কওয়ার নাইক সময় আর,
তোমার আলোর রথ চালিয়ে ভাঙ ঘুমের দ্বার!
রবির আগে চলব আমি ঘুম ভাঙা গান গেয়ে,
জাগরে সাগর, পাহাড়, নদী, ঘুমের ছেলেমেয়ে।’

জীবনকে সাজাতে হবে, চারদিকে বাজাতে হবে, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য মিছিল করতে হবে। চারদিকে ঝড় তুলতে হবে একাকী না থেকে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে তাহলে জীবনের মর্ম বুঝা সহজ হবে। তিনি তাই ‘জয় জীবনের জয়’-কবিতায় লিখেছেন এভাবে,
‘বজ্র আলোকে মৃত্যুর সাথে হবে নব পরিচয়
জয় জীবনের জয়।
শক্তিহীনের বক্ষে জাগাব শক্তির বিস্ময়
জয় জীবনের জয়।’
ছোট মেয়েদের জন্য কবি ছোট নাটিকা লিখেছেন নাম দিয়েছেন ‘পুতুলের বিয়ে’। পুতুলের বিয়ে নাটিকাটিতে কবি শিশুদের আনন্দ দানের বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সমগ্রভাবে বিচার করলে এটি কোন উচ্চ মানের দাবি রাখে না বলে মনে হবে কিন্তু মনে রাখতে হবে শিশু সাহিত্যের যে সংজ্ঞা তার বিচারে এটি দারুণ সাহিত্য রসের দাবিদার। কমলি, টুলি, পঞ্চি, খেঁদি ও বেগম, এই পাঁচটি মেয়ের মধ্যে পঞ্চি, খেঁদি ও বেগমইে পাঁচটি মেয়ের মধ্যে পঞ্চি ময়মনসিংহের ও খেঁদি বাঁকুড়া জেলার অধিবাসি। কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সঞ্চয়ন’। উলেখিত কাব্যগ্রন্থে ২৬টি কবিতা ও একটি নাটক আছে। ২৬টি কবিতার মধ্যে ‘খোকার গল্প বলা, সুপার বন্দনা, নব-ভারতের হলদিঘাট-ঝিঙেফুল, ভাঙারগান ও প্রলয় শিখা’-কাব্যগ্রন্থগুলি থেকে সংকলিত। ‘কোথায় ছিলাম আমি?’ কবিতায় খোকা মাকে তার জন্মের যে কথা জিজ্ঞাসা করেছে তার মধ্যে শিশুর রঙিন স্বপ্ন ফুটে উঠেছে-তিনি বলেছেন এভাবে,

‘মাগো! আমায় বলতে পারিস কোথায় ছিলাম আমি
কোন না জানা দেশ থেকে তোর কোলে এলাম নামি?
আমি যখন আসিনি, মা তুই কি আঁখি মেলে
চাঁদকে বুঝি বলতিস-ঐ ঘর ছাড়া মোর ছেলে?’
কিশোরের স্বপ্ন কবিতায় কবি ছোট মনের ভীষণ ভাবনাগুলো তুলে এনেছেন এভাবে,
‘মা! আমারে সাজিয়ে দে গো বাইর যাওয়ার বেশে,
রইব না আর আঁচল-ঢাকা গড়ি-আঁকা দেশে।
মা! আমারে সাজিয়ে দে গো বাইরে যাওয়ার বেশে।’
অপরদিকে ‘কোথায় ছিলাম আমি?’ কবিতায় খোকা মাকে যে অসীম ভালোবাসেন তার চিত্র প্রত্যক্ষ করা যায়। পিলে-পটকা পতুলের বিয়ে গ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৩৭০। এই গ্রন্থের খোকার খুশী, খোকার বুদ্ধি, খোকার গল্প বলা, ঠ্যাং ফুলী, পিলে-পটকা, হোঁদল কুৎকুতের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি ঝিঙেফুল থেকে গৃহীত হয়েছে। জাগো সুন্দর চির কিশোর নাটকের মধ্যে কল্পনার সঙ্গে কঙ্কন, কামাল, ওস্কার, চাকমা ফুসফুস ও বেণু ৫টি শিশুর কথোপকথনকে ধারণ করেছে। কিশোর স্বপ্ন কবিতায় কবি কিশোরদের মনের নানা স্বপ্নের কথা ফুটে তুলেছেন,
‘ম্যালেরিয়ায় ভুগব না মা,
মরব না তোর কোলে,
ডাকতে তোরে দেব না মা
চাকরের মা বলে।’

ছোট হিটলার কবিতায় শিশু মনের আগ্রহ, ভীরুতাকে অপছন্দ করা ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেছেন। পল্লী-জননী কবিতায় বংলার পলী গ্রামের রূপ, সৌন্দর্য ইত্যাদি বিষয় ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে এক বিরল ও ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন নজরুল। বাংলাসাহিত্যের নানা দিকে ছিল তার পদচারণা। বীর রস, করুন রস, হাস্যরসের নানা রচনা তাঁর লেখনিকে অনেক খানি সমৃদ্ধ করেছিল। সাহিত্যের নানা দিকে নানাভাবে অবদানের পাশাপাশি শিশু সাহিত্যেও নজরুল ব্যাপক অবদান রেখেছেন। শিশু সাহিত্যে নজরুল’র অবদান অপরিমিত, তিনি একমাত্র কবি যিনি শিশুদের নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে অদ্বিতীয় ও কালজয়ী। নজরুল ছিলেন সবার, তাঁর লেখনি ছিল সকল সময়ের, সকল যুগের সেরা। তিনি ছিলেন কালজয়ী-তাই,
‘যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ।’
বাংলাদেশ কবিতার দেশ, সাহিত্যের তো বটেই। তাই নজরুল সকল শ্রেণীর জন্য সেরা লেখাগুলি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। নজরুল একমাত্র সার্থক কবি যিনি সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণ করেছেন। নজরুলের শিশু সাহিত্য আমাদের সকল শিশুকে ছুঁয়ে যাক, পৃথিবীর সব মানুষের মন শিশুদের মত হয়ে যাক নজরুল ও তাঁর সাহিত্যের একজন ভক্ত হিসাবে অনেকের মত আমার কামনাও তাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট