চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রমজান আলী মামুন

শিশুসাহিত্য আন্দোলনে এক অনিবার্য নাম

আবসার মাহফুজ

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:০৮ পূর্বাহ্ণ

এখন চলছে বাংলা শিশুসাহিত্যের আধুনিক যুগ। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে বাংলা শিশুসাহিত্য। সংগতকারণে এখন শিশুসাহিত্যের কালচাহিদাও ভিন্নতর, বিজ্ঞানভিত্তিক, কল্পনার রঙে পুরোপুরি বাস্তবতানির্ভর। এ যুগে শিশুকিশোরদের চিন্তা-চেতনা, জানার পিপাসাও অন্য যুগের চেয়ে আলাদা, উচ্চতর। এখনকার শিশুরা অনেক বেশি জ্ঞান-উন্মুখ। পুরো পৃথিবীটাই এখন তাদের হাতের মুঠোয়। তারা খুব সহজেই পৃথিবীর প্রান্তবদল করতে পারে। বিশ্বজগৎ ছেড়ে সৌরজগতেও ঘোরাঘুরি করে অবিরাম। তারা এখন সব খবর রাখে। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির মতো মোটা মোটা জ্ঞানের খবরও এখন তাদের জানা। বিজ্ঞানের রথে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে মিটাতে চায় জ্ঞানপিপাসা, খুঁজতে চায় সন্ধিৎসু মনের নানা প্রশ্নের উত্তর। তাদের জীবন-জিজ্ঞাসা এখন আর আগের মতো ক্ষুদ্র গ-ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কল্পনার জগৎও বিশাল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজ্ঞজনদেরও হার মানায়। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই শিশু-সাহিত্যিকদের সাহিত্যচর্চা, সাহিত্যসৃজনকর্ম সম্পাদন করতে হয়। অন্যথায় শিশু-কিশোরদের মননে নাড়া দেয়া সম্ভব হয় না। শুধু শিশুকিশোর নয়, কোনো শ্রেণির মানুষের হৃদয় জয় সম্ভব হয় না।

নিবিষ্ট সাধক ছাড়া কেউই এ যুগে শিশুসাহিত্যজগতে দাপটের সাথে বিচরণ করতে পারেন না। নামের শিশুসাহিত্যিক হাজারো থাকেন, কিন্তু রাজার হালে জনহৃদয়ে আসন পান গুটিকয়জন মাত্র। বাকিরা সোস্যাল মিডিয়ার এ যুগে নিজ নিজ পেজে আত্মপ্রচারেই মশগুল থাকেন শুধু। এক সময় অমোঘ নিয়মে কালের গহ্বরে হারিয়ে যান, হারিয়ে যাবেন। সময়চাহিদাকে ধারণ করে মেধা-মননকে যারা সৃজনকর্মে উৎসর্গ করতে পারঙ্গম শুধু তারাই কালজয়ী হতে পারেন। সাহিত্যসাধনার তীর্থস্থান খ্যাত চট্টগ্রামে এ ধরনের শিশুসাহিত্যিকের সংখ্যা বর্তমানে হাতেগোনা কয়জন মাত্র। আর চট্টগ্রামের যে কয়জন শিশুসাহিত্যিক দীর্ঘদিন ধরে শিশুসাহিত্য জগতে দোর্দ-প্রতাপে রাজত্ব করে চলেছেন নিশ্চয়ই তাঁদের অন্যতম রমজান আলী মামুন।

যদিও ছড়া দিয়েই তাঁর লেখালেখিজগতে যাত্রা শুরু, তবে ইদানিং তিনি একজন সব্যসাচী শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরেছেন। ছড়ার পাশাপাশি কিশোর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, সমালোচনা, শিশুতোষ উপন্যাসসহ শিশুসাহিত্যের রাজপথ থেকে শুরু করে অলিতেগলিতেও তাঁর সদর্প পদচারণা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁর সৃজিত ছড়াগুলো যেমন পাঠসুখানন্দের পাশাপাশি পাঠকমনকে আন্দোলিত করে, তেমনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাসও পাঠকমনে বিচিত্রচিন্তা ও নানা জিজ্ঞাসার ঝড় তুলে। সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ম-অনিয়ম, শোষণ-বঞ্চনা, বৈষম্য-নিপীড়ন, হাসি-কান্না, অধিকার-কর্তব্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতিসহ যাপিত জীবনের নানা দিক তাঁর সাহিত্যকর্মে নিপুণ শিল্পীর দরদী ছোঁয়ায় উঠে এসেছে। ফলে তাঁর সাহিত্যকর্ম শিশুকিশোরের পরিধি ছাড়িয়ে সর্বজন ও সর্বশ্রেণির পাঠকের কাছে বিপুলভাবে সমাদৃত।

সহজ-সরল ভাষায় নির্মিত তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রান্তিক মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তজনদের জীবনাচরণ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, প্রত্যাশা এবং উপরশ্রেণি কর্র্তৃক শোষণের চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এঁদের অতুলনীয় ভূমিকা ও অবদানের বিষয়গুলোও নানাভাবে উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বিত্ত-বৈভবের অধিকারী অভিজাতদের যাপিত জীবনের নানা দিকও। এখন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শিশুকিশোরদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিশুসাহিত্য বিরাট ভূমিকা রাখছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের মন ও মননে ছড়িয়ে দিতে রমজান আলী মামুনের সাহিত্যকর্মও অনন্য ভূমিকা পালন করছে, সন্দেহ নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আরাধ্য স্বপ্ন ছিল সৌহার্দ্যময় সমৃদ্ধ মানবসাম্যপূর্ণ সোনার বাংলাদেশ গড়া। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের জন্যে নতুন প্রজন্মকে মানবসাম্যের চেতনায় গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রেও মামুনের শিশুসাহিত্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, প্রতিভাবান না হলে ছোটদের জন্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং শিক্ষামূলক সাহিত্য রচনা সম্ভব নয়। একমাত্র প্রতিভাবানরাই সরল, সহজ ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিশুসাহিত্য রচনা করার ক্ষমতা রাখেন। রমজান আলী মামুন নিশ্চিতভাবেই এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। শিশুসাহিত্য রচনায় বিশেষ করে ছড়ার গাড়ি থামবে বাড়ি, নীল ডানা এক পাখি, সবুজাভ কোনো গ্রামে, হারিয়ে যাওয়া দুপুরে, আকাশপরি ও পাপিয়া, এক যে ছিল রাজকন্যে, দিবা ও রহস্যময় বুড়ো, কিশোর নেমেছে যুদ্ধে, রুশনি ও একটি পতাকার গল্প, রেল ছোটে মন ছোটে, মিঠু তুমি স্বাধীনতা শিরোনামের ছড়া-কবিতা-গল্প এবং উপন্যাস গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি তাঁর শক্তি-সামর্থ্য ও ঔজ্জ্বল্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর শিশুতোষ লেখাগুলো শিশুকিশোরদের তো বটেই, বয়স্কজনদেরও নতুন স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। তাঁর ছড়া-কবিতা-গল্প-উপন্যাস প্রগতি ও আধুনিকতার পাশাপাশি শিশুদের জন্য তৈরি করে এক স্বপ্নরাজ্য। আছে শিক্ষণীয় নানা বিষয়-আশয়। এভাবে শিশুসাহিত্যের সব শাখায় তাঁর সদর্প বিচরণ এবং ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা তাঁকে একজন সব্যসাচী শিশুসাহিত্যেক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
একজন শক্তিমান শিশুসাহিত্যিক হিসেবে রমজান আলী মামুনের দ্যুতি এবং খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। বলা যায়, বাংলাশিশুসাহিত্যের এক অনিবার্য নাম হয়ে উঠেছেন রমজান আলী মামুন। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর পরিচিত সর্বব্যাপী হলেও তিনি একজন সমাজসেবক এবং ভালো সংগঠকও। টেরিবাজার এবং বদরপাতি এলাকায় নানা সমাজকর্মে তিনি বহুদিন থেকেই সম্পৃক্ত। কয়েকটি সামাজিক সংগঠনেও তিনি দীর্ঘদিন ধরে পরিচালকের ভূমিকায় আছেন। এসব সংগঠন দুঃস্থজনদের সেবা, শিক্ষার বিস্তার, সমাজশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সমাজউন্নয়নসহ নানা তৎপরতায় সম্পৃক্ত আছে। এক সময় এসব সংগঠনের কর্মকা-ে, বিশেষ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাকেও সম্পৃক্ত করতেন তিনি। ফলে একদিকে একজন মেধাবী সাধক শিশুসাহিত্যিক হিসেবে মামুনের পরিচিতি বাড়বাড়ন্ত, অন্যদিকে বিশেষত স্থানীয় পর্যায়ে একজন সমাজসংগঠক ও একজন সমাজদরদী হিসেবে তিনি সমাদৃত হচ্ছেন। পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যারা সাহিত্য বুঝেন না, তাঁদের ভালোবাসা, সম্মান ও মর্যাদা। এটি খুব কম সাহিত্যিকের ভাগ্যে জুটে। রমজান আলী মামুন এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম।

সুবিধাবাদীদের আধিপত্যের এ সময়ে অনেক সাহিত্যিককে খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা সময়স্রােতে গা ভাসিয়ে নিজের আদর্শ ও বিশ্বাসকে বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতে তৎপর। এ ক্ষেত্রেও রমজান আলী মামুন ব্যতিক্রম। তাঁর সাম্প্রতিক সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তিনি সত্যকে সত্য বলার, মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সাহস দৃঢ়তার সাথেই ধরে রেখেছেন; যা অন্য অনেকেই পারেননি। আবার নিজের বিশ্বাসকে অন্যের ওপর আগ্রাসী ভূমিকায় চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতাও তাঁর মধ্যে লক্ষ করা যায়নি কখনো। একজন শিশুসাহিত্যিকের নৈতিক অবস্থানকে বিসর্জন দিলে তিনি হয়তো বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়তে পারতেন। কিন্তু কখনো তা করেননি। ফলে আজ ভিন্ন চিন্তার মানুষজনও তাঁকে সম্মান করেন, শ্রদ্ধা করেন। আশা করি, সারাজীবনই তিনি নৈতিক অবস্থান ধরে রাখবেন। সবসময় সত্য-সুন্দরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আরো আরো সাহিত্যসাধনা ও সমাজ বিনির্মাণে নিবিষ্ট থাকবেন। আলোকিত মানুষ গড়ার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন অনেক দূর। বন্ধুবৎসল এই মানুষটির জন্যে অনেক অনেক শুভ কামনা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট