চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্বাধীনতা-পূর্ব প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে চট্টগ্রাম

এ বি এম ফয়েজ উল্যাহ

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:২৫ পূর্বাহ্ণ

একটা কথা আজ ভাবতেই অবাক লাগে যে, যখন পূর্ব পাকিস্তানের কোন জায়গায়-এমন কি ঢাকায়ও প্রগতিশীল সংস্কৃতি-চর্চা ছিল না-সেই সময়ে চট্টগ্রামে প্রথম প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা হয়। এর মূল কারণ দ্বি-জাতিতত্ত্বের তথা ধর্মেরভিত্তিতে বিভাজিত ভারত পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা, মানবিক ও অর্থনৈতিকভাবে বাঙালিদের প্রতি অবজ্ঞা, খাজা নাজিম উদ্দিন সরকারের চরম জিন্না প্রীতি, কিছুটা অসাম্প্রদায়িক সোহরওয়ার্দী-আবুল হাসেম গ্রুপের সমর্থকদের প্রতি বৈরী আচরণ, ধর-পাকড়, নির্যাতন, জেল-জুলুম ও শোষণের ধারাবাহিকতা চলছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। সর্বোপরি রাষ্ট্রভাষা বাংলা, শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ, ধর্ম-জাতিভেদহীন নতুন মানবিক সমাজ গড়ে তোলা। আর এর জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আন্দোলন। শিল্প-সাহিত্য হবে যার মূল রাজনৈতিক হাতিয়ার।
১৯৪৮ সালে প্রগতিশীল পত্রিকা ‘সীমান্ত’ প্রকাশের পর মূলত দু’টি সংস্থাকে কেন্দ্র করে ১৯৫০ সালের দিকে চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। এর একটি ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’। অন্যটি রেলওয়ের ‘ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট’।
“ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউট’ (রেলওয়ের তৎকালীন প্রবাদ-পুরুষ, চট্টগ্রামস্থ মীরসরাই উপজেলার জনাব ওয়াজি উল্লাহ’র স্মৃতি-স্মরণে নির্মিত) বাম-পন্থি রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা প্রাণকেন্দ্র ছিল। রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগে তখন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও সমর্থক ছিল অনেকেই। যাঁদের নিয়ে ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটে একটা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে শুরু করে। এক কথায় বলা যেতে পারে যে, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বীজ এই ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটকে কেন্দ্র করেই রোপিত হয়”। (পঞ্চাশ দশকের শুরু : প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন-আজিজ মিসির)
সে সময় চৌধুরী হারুনুর রশিদ, মোসলেহ উদ্দিন, জলিল উদ্দিন, নট স¤্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস, সাদেক নবী, সাদেক আলী, আবদুল জব্বার, আবদুল হামিদ, ইদ্রিস মীনা, ডি বি চৌধুরী ও এমদাদুল হক, পূর্ণিমাসহ অনেকেই অসাম্প্রদায়িক সভা সমিতি, সাহিত্যালোচনা এবং নাট্য-মঞ্চায়নের মাধ্যমে চট্টগ্রামে একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

চট্টগ্রাম কলেজ কেন্দ্রিক নাট্যশিল্পী ও চট্টগ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কয়েকটা নাট্যদলের শিল্পী, কর্মীদের সমন্বয়ে ১৯৫০ সালে কলিম শরাফী তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর মাহবুব উল আলম চৌধুরী, গোপাল বিশ্বাস এবং আজিজ মিসিরকে নিয়ে ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট কবিয়াল রমেশ শীল। ভাইস প্রেসিডেন্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এই নাট্য সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মহিউল ইসলাম, নির্মল মিত্র, বারিকুল আলম খান,অচিন্ত কুমার চক্রবর্তী, চিরঞ্জীব দাশ সর্মা, রমেশ মজুমদার, মাহবুব হাসান, সুচরিত চৌধুরীসহ প্রগতিশীল বহু সাংস্কৃতিক কর্মী এর সাথে জড়িত ছিল।

১৯৪৮ সালে ‘পাকিস্তানের মূলনীতির রিপোর্ট’ প্রকাশিত হয়। এতে না ছিলো পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার অঙ্গীকার, না ছিলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বীকৃতি। সর্বোপরি পশ্চিমা শাসকচক্র ও তাদের এ’দেশীয় দালাল খাজা নাজিম উদ্দিন, মাওলানা আকরাম খাঁনদের প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী চক্র ইসলামের নাম ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে ধ্বংস করার যে ঘৃণ্য প্রচেষ্টা শুরু করেছিল, তার বিরুদ্ধে প্রচ- প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক মনোভাবাপন্ন তথা প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, শিল্পীদের সমবেত করে ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’র প্রচেষ্টায় ১৯৫১ সালে সর্বপ্রথম সাংস্কৃতিক মহাসন্মেলেনর আয়োজন করেছিল ‘চট্টগ্রাম’।
সরকারী প্রতিবন্ধকতা, মুসলিম লীগের কর্মীদের ভয়-ভীতি মাথায় নিয়ে চট্টগ্রামের মোমিন রোডের ‘হরিখোলা’ মাঠে ১৯৫১ সালে ১৬ মার্চ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত চার দিনব্যাপি, পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম সাংস্কৃতিক সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। “এই সন্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক মনোভাব সম্পন্ন কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, শিল্পীদের সমবেত করানো এবং তার মাধ্যমে সকলের বক্তব্য ও আলোচনার ভিত্তিতে বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশের তথ্যানুসন্ধান। বিশেষ করে বাংলার সাংস্কৃতিগত ঐতিহ্যেও অপনোদনের যে ষড়যন্ত্র চলছিলো, তার বিরুদ্ধে সংঘঠিত প্রতিরোধ সৃষ্টি করা, সেই সঙ্গে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।” (পূর্ব বাংলার সাস্কৃতিক আন্দোলন : প্রেক্ষপট চট্টগ্রাম গোপাল বিশ্বাস)
এই মহাসন্মেলনে অংশ নেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, আবুল ফজল, কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, বেগম সুফিয়া কামাল, সাহিত্যিক মোস্তফা নুর আল ইসলাম, বিপ্লবী কবিয়াল রমেশ শীল, স্থানীয় প্রগতিশীল কবি , সাহিত্যিক, শিল্পীবৃন্দ। চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট থেকে বহু শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক এতে অংশ নিয়েছিরেন। পশ্চিম বাংলা থেকে এসেছিলেন, সাহিত্যিক রাধারাণী দেবী, রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস। প্রসিদ্ধ সুরকার সলীল চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’র শিল্পী গোষ্ঠী। প্রবন্ধ পাঠ, আবৃত্তি, আলোচনা, রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত, আঞ্চলিক গান, গণসঙ্গীত, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ এবং চট্টগ্রামের প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’র মঞ্চস্থ নাটকে ও রমেশ শীল, ফণী বড়–য়ার কবিগানের আনন্দধারায় মুখরিত ছিলো চারদিনের মহাসন্মেলন। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীদের এটিই প্রথম সম্মেলন। চট্টগ্রামের মোমিন রোডের ‘হরিখোলা মাঠ’র সাংস্কৃতিক সম্মেলন দেশের সুষ্ঠু এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চর্চার প্রভাব বিস্তার করেছিল।

কর্ণফুলীর মতোই বহমান চট্টগ্রাম। জোয়ারে দুর্বার। দুকূল ছাপিয়ে যায় তার উচ্ছ্বাসিত আবেগ। পঞ্চাশ দশকের চট্টগ্রাম এমনি এক প্রবল পাল উড়িয়ে দিয়েছিল কালান্তরের উদ্দেশ্যে। দুই দশক পরে এই আবেগের অভিযাত্রা খুঁজে পেয়েছিল তার প্রার্থিত গন্তব্য-যার নাম বাংলাদেশ। (পঞ্চাশের তরঙ্গ-দীন নাথ সেন)।

তবে চট্টগ্রামের প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতির এই ধারাকে সঠিকভাবে জানতে হলে আরো পেছনের ইতিহাস জানা প্রযোজন। ১৯৪৬ সালে বাংলাদেশে এমন কি ভারতবর্ষে, রাজনৈতিক অবস্থা তখন চরমে-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ব্রিটিশ ভেদ নীতির সফল প্রয়োগে জাতি বিভ্রান্ত-এমনি সময়ে অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা তরুণদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম নজরুল জয়ন্তী উদ্যাপিত হয়। নজরুল জয়ন্তী উদ্যাপন করার লক্ষ্যে যে প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়, তাতে অধ্যাপক আবুল ফজল সভাপতি এবং মাহবুব উল আলম চৌধুরী সম্পাদক নির্বাচিত হন।
“নজরুল জয়ন্তী উদ্যাপনকে উপলক্ষ্য করে একটা বড় ধরনের সমাবেশ করা হয়। এই ধরনের কার্যকলাপ তখন তরুণ এবং প্রবীণদের মধ্যে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র উপস্থিতিতে সভাপতির ভাষণে মালিক আবদুর বারি বলেন, ‘পরাধীনতার অক্টোপাশ বন্ধনকে টুকরো টুকরো করতে নজরুল বিদ্রোহের গান রচনা করেছিলেন দেড় শতাধিক বৎসরের ঘুমন্ত জাতিকে জাগাতে, দেশকে স্বাধীনতার বিজয়োল্লাসে মুখরিত করতে। নজরুলের বাণী শুধু পরাধীনতার বিরুদ্ধে নয়,ওই বাণী ছিল সামাজিক কুসংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এবং পবিত্র ইসলামকে মধ্যযুগীয় স্থবির স্বার্থবাদের ভূমিকায় যারা প্রয়োগ করতে প্রয়াসী, সেই সব বুদ্ধিবাধীদের বিরুদ্ধে।”
“আমরা এই উৎসাহ-উদ্দীপনাকে ধরে রাখার এবং চলমান করার প্রচেষ্টায় সিদ্ধান্ত নিলাম যে,একটি মাসিক পত্রিকা বের করবো। একটা নতুন সমাজ তৈরী-যেখানে শ্রেণী ভেদ থাকবে না, কোন বর্ণভেদ থাকবে না, হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়ীক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবেনা-এই ধরনের একটা চিন্তা ভাবনা নিয়ে আমরা ‘সিমান্ত‘ পত্রিকা প্রকাশে আগ্রহী হই।” ( সাংস্কৃতিক আন্দোলনে চট্টগ্রাম-মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী )

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পশ্চিম বাংলা থেকে খ্যাতনামা বেশ কয়েকজন কবি সাহিত্যিক শিল্পী চট্টগ্রামে চলে আসেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শওকত ওসমান, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, ইবনে গোলাম নবী, কলিম শরাফী প্রমুখ। এঁরা এবং তৎকালীন চট্টগ্রামের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্পাদক ননী সেনগুপ্ত, ‘প্রগতি লেখক সংঘ’র সম্পাদক সুধাংশু সরকার ও শুভাশীষ চৌধুরীর উৎসাহ এবং সহযোগিতায় মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী মাসিক ‘সীমান্ত’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। সঙ্গে সুচরিত চৌধুরী।
চট্টগ্রামে প্রগতিশীল সাহিত্য-পত্র ‘সীমান্ত’ এর প্রকাশনা শুরু হলো ১৯৪৮ সালের দিকে। পুরাতন গির্জা রোডের ‘ইম্পেরিয়াল প্রিন্টিং প্রেস’ থেকে ‘সীমান্ত’ প্রকাশিত হতো। মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর মামা আহমদ সগীর চৌধুরী ১৯৩৫ সালে প্রেসটি চালু করেছিলেন। অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম-নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ তথা ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ ও এর গণতান্ত্রিক চেতনার অভিব্যক্তিতে ‘সীমান্ত’ পত্রিকা ছিল একটি উজ্জল দীপ-শিখা। ‘সীমান্ত’ পত্রিকার প্রকাশনা উৎসবে সভাপতিত্ব করেন বাংলা সাহিত্যেও বিশিষ্ট কবি বিভূতি চৌধুরী। (অগ্নিকন্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দারের ছোট বোনের স্বামী ) চট্টগ্রাম ছাড়া ঢাকা বা অন্যত্র এ ধরনের প্রগতিশীল পত্রিকা প্রকাশিত হতে পারেনি।
মুসলিম লীগ সরকারের হামলা ও নির্যাতনে একদার ‘প্রগতি গোষ্ঠী’ ও ‘সাহিত্য সংঘ’ অস্তিত্ব হারিয়ে ফেললে ‘সীমান্ত’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তখন চট্টগ্রামে ‘সাংস্কৃতিক বৈঠক’ নামে একটা প্রগতিশীল সংস্থা গড়ে ওঠে। এই আসরে আহমেদুল কবির, সানাউল হক, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, শওকত ওসমান-এর মত প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকেরাও যোগ দিতেন।
১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রাক্কালে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়। ঐ সময়টাতেই এই চট্টগ্রামেই পাকিস্তানের প্রথম গণহত্যা সংগঠিত হয়-হালদা নদীর কাছে মাদারশার টেকে। এই টেক কাটলে ঐ অঞ্চলের কৃষকের অনেক উপকার হয়, কিন্তু সরকার কোন মতেই সেই টেক কাটতে দেবে না। কৃষকেরা জোর করে ঐ টেক কাটতে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে ৭/৮ জন কৃষক নিহত হয়। আন্দোলনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। আন্দোলনে গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে ‘মাদার বাড়ি ক্লাব’, নন্দনকাননের ‘শক্তি সংঘ’, দেওয়ান বাজারের ‘অগ্রণী সংঘ’ ক্লাবগুলোকে সুষ্ঠু নেতৃত্বের মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়।

জেএমসেন হল প্রাঙ্গণে দাঙ্গাবিরোধী ঐ মহাসমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, রফিক উদ্দীন সিদ্দিকী। সমাবেশ শেষে দাঙ্গা-বিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দেন, রফিক উদ্দীন সিদ্দিকী, আবদুল হক দোভাষ, প্রিন্সিপাল আবু হেনা, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, শওকত ওসমান, যোগেশ চন্দ্র সিংহ প্রমুখ। হাজার হাজার মানুষের স্রোতের সাথে দুই হাজারের অধিক সেচ্ছাসেবক ইউনিফর্মে সজ্জিত হয়ে ড্রাম বাজিয়ে সাম্প্রদায়িক-দাঙ্গা বিরোধী গান গেয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করেছে। গানের কথা ছিল, “ও ভাই দেশ ছাইরা যাইও না/ এক ভাই যখন বাইচা আছে আর ভয় কইর না।” ফলে সংখ্যালগুদের দেশ ত্যাগের গণনায় চট্টগ্রাম সর্বদা ছিল সর্বনি¤েœ। চট্টগ্রাম থেকেই সর্বপ্রথম ‘সীমান্ত’ পত্রিকা ২০০ পৃষ্ঠার একটি দাঙ্গা-বিরোধী সংখ্যা প্রকাশ করে।

এই চট্টগ্রামেই ১৯৫০ সালের দাঙ্গা-বিরোধী ঐ গণ-সমাবেশে পূর্বপাকিস্তানের সর্বপ্রথম ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’-এর শাখা স্থাপিত হয়। আবদুল হক দোভাষ সভাপতি এবং মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই ‘বিশ্ব শান্তি পরিষদ’ আণবিক বোমা নিষিদ্ধ করণের দাবিতে সাত লক্ষাধিক স্বাক্ষর সংগ্রহ করে।
পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক।

১৯৫১ সালের ‘চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক মহাসন্মেলন থেকে প্রগতিশীল, ধর্ম নিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে ধারার জন্ম নিলো, তারই প্রতিফলন ১৯৫২ সালে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন। আর কুমিল্লা সম্মেলনের পেছনে চট্টগ্রাসের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল সর্বাধিক। বস্তুত চট্টগ্রামস্থ বাঁশখালির বামপন্থি নেতা অধ্যাপক আসাহাব উদ্দিন’র অনুপ্রেরণায় কুমিল্লা সন্মেলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য, এই সম্মেলনের মোট ব্যয়িত অর্থের আশি ভাগ চট্টগ্রাম থেকে দেয়া হয়। এবং সম্মেলন সফল করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে কবিয়াল রমেশ শীলের কবিগানের দল, ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’ এবং গণসংগীত শিল্পীদের একটি দলও পাঠানো হয়। অচিন্ত চক্রবর্তী, রমেণ মজুমদার, নির্মল মিত্র, ¯েœহময় রক্ষিত, মাহবুব হাসান, মহিউল এসলাম, নাসির উদ্দিন, হরি প্রসন্ন পাল প্রমুখের সংগ্রামী পল্লী ও আঞ্চলিক গানে মুখরিত হয় সন্মেলন। সঙ্গীতে স্বর্ণপদক লাভ করেন শ্রী হরি প্রসন্ন পাল। রমেশ শীলের কবি গানে সারারাত মুখরিত থাকে সম্মেলন।
১৯৫৩ সালের ১৭ ও ১৮ এপ্রিল জেএম সেন হল প্রাঙ্গণে ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’ এবং ‘কবিয়াল সমিতি’র যৌথ উদ্যোগে ‘চট্টগ্রাম জেলা লোক-সংস্কৃতি সন্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন কমিটির সভাপতি ছিলেন, কবিয়াল রশে শীল এবং অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন, সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম। যুগ্ম সম্পাদক কলিম শরাফী এবং নুরুল ইসলাম। ঐ বছরেই কোলকাতার পার্ক সার্কাাস ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল ভারত শান্তি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্মেলন’। কবিয়াল রমেশ শীল ও তাঁর দল তাতে অংশ গ্রহণ করেন। বোম্বাই থেকে অভিনেতা পৃথ্বিরাজ কাপুর, খাজা আহমদ আব্বাস, ডা. কিচলু, কৃষাণ চন্দ, কোলকাতার মানিক বন্দোপাধ্যায়, পবিত্র বন্দোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়সহ বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। ঐ সম্মেলন থেকে ভারতের শ্রেষ্ঠ কবিয়ালের খেতাবে ভূষিত হয়ে স্বর্ণ পদক লাভ করেন চট্টলা-গৌরব কবিয়াল রমেশ শীল। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাজারো ষড়যন্ত্রের মধ্যেও চট্টগ্রাম, কুমিল্লায় সাংস্কৃতিক সম্মেলন সফলতা এবং অসাম্প্রদায়িক গণ-সংস্কৃতির ধারাকে জনসাধারণের কাছাকাছি নিয়ে যেতে সক্ষম হওয়ায় এর ঢেউ রাজধানী ঢাকায়ও আাছড়ে পড়ে।

১৯৫৪ সালের ২৩, ২৪, ২৫ ও ২৬ এপ্রিলে বিশাল আকারে ‘পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ ঢাকার কার্জন হলে মহা সমারোহে অনুষ্ঠিত হয়। ভারত থেকে এসেছিলেন অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গুণিজন। এঁদের মধ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায, রাধারাণী দেবীর নাম উল্লেখযোগ্য। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে প্রায় ৬০জনের (কারো কারো মতে ১০০ জনের) একটি দল চিরঞ্জীব দাশ শর্মার নেতৃত্বে ঢাকার সন্মেলনে অংশ নেন। চট্টগ্রামের শিল্পীদের গণসঙ্গীত ‘দুনিয়ার মজদুর ভাই সব’, ‘শ্বেত কপোতের পাখায় পাখায় শান্তি আসে’ এবং ‘একুশে ফেব্রুয়ারি লও সালাম’ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রান্তিকের নাটক, রমেশ শীলের কবিগান ঢাকাকে মাতিয়ে তুলে ছিল।
১৯৫৬ সালে দল মত নির্বিশেষে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মিদের নিয়ে ‘কৃষ্টিকেন্দ্র’ নামে চট্টগ্রামে আরও একটি সংস্থা সহ গড়ে উঠে ‘মুক্তধারা’ নাট্যগোষ্ঠী ও দেওয়ান বাজার ‘অগ্রণী সংঘ’।

১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর কাগমারীর ‘সাংস্কৃতিক মহাসন্মেলন’। ভারত ছেড়ে দুনিয়া-জোড়া খ্যাতি। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক দলের দখলে নাটক, গণসঙ্গীত আর কবিগানের আসর। মাওলানার ¯েœহধন্য রমেশ শীল গাইলেন।
‘মাটির মানুষ মাটি নিয়ে সারাদিন কাটাই,/মাটি আমার খাটি সোনা,/মাটির জন্য এবার শেষ লড়াই।’
চট্টগ্রামের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এই ধারা এতোটাই পূর্ব পাকিস্তানে শক্তিশালী ছিল যে, ১৯৬১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শততম জন্মবার্ষিকী যখন সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীল মহলের তীব্র বাধার মুখে ঢাকাসহ পাকিস্তানের কোথাও পালন করা সম্ভব হলো না, তখন চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিট হাইস্কুলের মাঠে সাতদিন ধরে ব্যাপক আকারে ধুমধামে পালিত হয়েছে। সত্যিই যুগ যুগের প্রতিটি আন্দোলনের অকুতোভয় বীর চট্টলা। চট্টগ্রাম।
শেষ করছি প্রগতিশীল সাংস্কৃতি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সাংবাদিক আজিজ মিসিরের বক্তব্য দিয়ে। তাঁর ‘পঞ্চাশ দশকের শুরু : প্রগতিশীল সাংস্কৃকি আন্দোলন’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, “একটা কথা ভাবতেই অবাক লাগে যে, যখন পূর্ব পাকিস্তানের কোন জায়গায়-এমন কি ঢাকায়ও প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চা ছিল না- সেই সময়ে চট্টগ্রামে প্রথম প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা হয়।…কাজে কাজেই আমি অন্ততঃ দ্বিধাহীন চিত্তে, দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারি যে, পূর্ব পাকিস্তান-এমন কি সমগ্র পাকিস্তানে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে চট্টগ্রামই হচ্ছে পথিকৃৎ”।

তথ্য : ১. চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলন (প্রগতিশীল ধারা) -মাহবুব হাসান সম্পাদিত এবং ২. চট্টগ্রামের মানস সম্পদ- শামসুর আলম সাঈদ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট