চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

গণহত্যা থামিয়ে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়ার নির্দেশ

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায়

নিজস্ব প্রতিবেদক হ ঢাকা অফিস

২৪ জানুয়ারি, ২০২০ | ৮:৫৮ পূর্বাহ্ণ

নেদারল্যান্ডসে হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যায় গাম্বিয়ার করা মামলায় চারটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত সর্বসম্মতভাবে এ আদেশ জারি করে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা হত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দ্য হেগে বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায় আইসিজের প্রধান বিচারপতি আবদুল কাভি আহমেদ ইউসুফ এ আদেশ ঘোষণা করেন। আদেশ ঘোষণার শুরুতে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার দায়েরকৃত মামলার পক্ষে রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও গণহত্যার যেসব আলামত আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল, সেসব বিরোধের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি ইউসুফ। আদালত বলেছে, গণহত্যা সনদের ২নং ধারা অনুযায়ী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে একটি বিশেষ সুরক্ষার অধিকারী গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

আদালত চার অন্তর্বর্তী আদেশে বলে- মিয়ানমার হত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করতে পারবে না, মিয়ানমারকে জোনোসাইড কনভেনশন মেনে চলতে হবে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা তৎপরতা চালানো যাবে না এবং ৪ মাসের মধ্যে আদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানাতে হবে।

জানা গেছে, আইসিজের রায়ে আদালত জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনে পাওয়া তথ্যগুলোর কথা উল্লেখ করেন। গাম্বিয়া সেসবের ওপর ভিত্তি করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে বলে জানান আদালত। তবে, আদালতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও একজন এডহক বিচারপতি বর্তমান আদেশের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে গত বছরের নভেম্বরে মামলা করে আফ্রিকার ক্ষুদ্র দেশ গাম্বিয়া। গত ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গাম্বিয়ার পক্ষে মামলার শুনানিতে নেতৃত্ব দেন দেশটির বিচার বিষয়ক মন্ত্রী আবুবকর তামবাদু। অন্যদিকে মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন দেশটির নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চি। এই শুনানিতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যাতে আর কোনও ধরনের সহিংসতার ঘটনা না ঘটে সে লক্ষ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ৫টি আদেশ চেয়েছিল মামলাকারী গাম্বিয়া।

গতকাল মামলার আদেশ ঘোষণায় জাতিসংঘের সর্বোচ্চ এই আদালত বলেছেন, গণহত্যা সনদের ৪১ ধারার আওতায় তিনটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশের শর্তসমূহ বিরাজ করছে। গাম্বিয়া সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী যেসব ব্যবস্থার আদেশ চেয়েছে; সেগুলোর প্রথম তিনটির লক্ষ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
উল্লেখ্য, দু’দিন আগে মিয়ানমার সরকারের গঠিত একটি কমিশন ২০১৭ সালে রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্লিয়ারেন্সের সময় কিছু সৈন্য সেখানে যুদ্ধাপরাধ করলেও গণহত্যার মতো ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না বলে এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানায়। জাতিসংঘের সর্বোচ্চ এই আদালত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ ঘোষণার আগে মিয়ানমারের ওই প্রতিবেদনকে অনেকেই প্রতারণামূলক হিসেবে দেখছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবারও এই মামলার আদেশ ঘোষণার আগে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে তিনি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের মাত্রাকে অতিরঞ্জিত হিসেবে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে রাখাইনে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দেশীয় আইনে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।
মিয়ানমার এবং গাম্বিয়া উভয় দেশই ১৯৪৯ সালে গৃহীত গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী। এছাড়া আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত মানা বাধ্যতামূলক এবং সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ নেই। যদিও সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার মতো ক্ষমতা নেই আদালতের। তবে, অতীতে খুব কম দেশই এই আদালতের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা কিংবা পুরোপুরি মেনে চলেছে।
জাতিসংঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গত নভেম্বরে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করে গাম্বিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক এ আদালতে গণহত্যার দায়ে তৃতীয় মামলা এটি। গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দেশেই ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হিসেবে শুধু গণহত্যা থেকে বিরত থাকা নয় বরং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ এবং অপরাধের জন্য দেশগুলো বিচারের মুখোমুখি হতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে প্রথম জেনোসাইড কনভেনশন মামলা হয়েছিল সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে।
কানাডা, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, তুরস্ক এবং ফ্রান্স জোর দিয়ে বলেছে যে, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়েছে। ইসলামী দেশসমূহের সংগঠন ওআইসি তার ৫৭টি সদস্য দেশকে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার কাজে সহায়তা করে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মিয়ানমারের বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আছে বলে সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ৪ জুলাই রোহিঙ্গাদের ওপর যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত শুরু করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসির অনুমতি চান প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা। জুলাই মাসে তার তদন্ত দল বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছ থেকে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণ তদন্তের জন্য আবেদন করেন ফাতো বেনসুদা, যাতে সায় দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকরা। ফলে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিপীড়নের ঘটনায় কোনো আন্তর্জাতিক আদালতে তদন্ত শুরু হয়। তবে শুরুর দিকে অনেকে এ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ মিয়ানমার আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র নয়। একইভাবে আইসিসির প্রতিনিধি দলকেও রাখাইনে পরিদর্শনে যাওয়ার অনুমতিও দেয়নি।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সামরিক অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও, খুন, ধর্ষণের মুখে ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট