চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ কেন, কী হবে পরিণতি

১৫ মার্চ, ২০২২ | ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

রাশিয়া কেন ইউক্রেন আক্রমণ করলো, এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে শুরু থেকেই। বিশ্লেষকদের মতে, পাঁচটি কারণে এই আক্রমণের সূত্রপাত।
১। আমেরিকা তার সর্বব্যাপী আধিপত্যের ধারণা থেকে সরে আসেনি।
২। আমেরিকা ক্রমাগত রাশিয়ার সীমান্তের কাছে চলে আসছিলো। এই ব্যাপারে রাশিয়ার প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে আসছিলো।
৩। ন্যাটোর সদস্য না করেও ইউক্রেনকে অস্ত্র সজ্জিত করছিলো।
৪। মিনস্ক চুক্তির মতো শান্তি চুক্তি ইউক্রেন অগ্রাহ্য করছিলো এবং এই ব্যাপারে আমেরিকার ও ইউক্রেনের ভিতরে শক্তিশালী নব্য-নাৎসিদের চাপ ছিল।
৫। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য না করা এবং অস্ত্র সরিয়ে নেয়ার রাশিয়ার প্রস্তাবিত নিরাপত্তা চুক্তি/দাবি আমেরিকা অগ্রাহ্য করছিলো।

এই সময়ে কেন আক্রমণ?
১। আমেরিকা রাশিয়ার সাথে করা স্বল্প ও মধ্যম রেঞ্জের ক্ষেপনাস্ত্র চুক্তি থেকে সরে আসে। এর ফলে রাশিয়ার চারপাশে অস্ত্র বসানো যাবে, কিন্তু আমেরিকা অনেক দূরে তুলনামূলক ভাবে নিরাপদে থাকবে। গত বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে আমেরিকা ও ইউকের সাথে ইউক্রেনের সামরিক চুক্তি হয় অস্ত্র সরবরাহ ও সামরিক প্রশিক্ষনের চুক্তি।
২। ইউক্রেন রাশিয়া সমর্থিত পূর্বাঞ্চল আক্রমনের পরিকল্পনা করে এই বছরের মার্চের ২২ তারিখ।
৩। আমেরিকার অর্থ সহায়তায় ইউক্রেনে অন্তত ১১ টি (কোন কোন হিসাবে আরো বেশি) জীবাণু-ল্যাব স্থাপন করা হয়। রাশিয়ার অভিযোগ এইসব ল্যাবে জীবাণুযুদ্ধের জন্য অস্ত্র তৈরি হচ্ছিলো।
৪। খুব সম্ভবতঃ উপরের তিন কারণে রাশিয়ার মনে হয়েছিল- তারা আমেরিকা, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইউক্রেনকে শেষবারের মতো সাবধান করে দেবে। এই উদ্দেশ্যে তারা ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করলো এবং আমেরিকার কাছে তাদের শান্তি/নিরাপত্তা প্রস্তাবের ব্যাপারে লিখিত প্রতিশ্রুতি চাইলো ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। অনেক মিটিং হল, সময়ক্ষেপণ হল, কিন্তু রাশিয়াকে অগ্রাহ্য করা হল। রাশিয়ার মনে হল, শক্তির ভাষায় কথা বলতে হবে, আর কোন উপায় নেই।
এই ব্যাপারে আরেকটা থিওরি আছে, পুতিন রাশিয়ার হারানো গৌরব ফিরে পেতে চায়- সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে হারানো অঞ্চলগুলো আবার দখল করতে চায়। এটা সত্যি বলে মনে হয়না মূলত দুটো কারণে। এক, শুধু আক্রমণের আগে নয়, রাশিয়া অন্তত আট বছর ধরে চেষ্টা করে আসছিলো একটা চুক্তিতে উপনীত হতে যাতে যুদ্ধ এড়ানো যায় এবং দুই, এই থিওরি পুরোপুরি কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত, বাস্তব কোন প্রমাণ নেই। তবে এটা হতে পারে যে, রাশিয়া নিজেকে বড় শক্তি মনে করে, কিন্তু আমেরিকার কথায় ও কাজে রাশিয়াকে তাচ্ছিল্য করাটা রাশিয়া অপমান হিসাবে দেখেছে।

নিরাপত্তা ছাড়া রাশিয়া আর কি চায়?
আমেরিকা ও ইউরোপকে জানিয়ে দিতে চায় যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোন সামরিক বৈরিতা তারা সহ্য করবে না, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে।

চীন কি খুশি?
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, চীন এই দশকের শেষ নাগাদ অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে এতোটা শক্তিশালী হবে যে তারা আমেরিকাকে সবদিক থেকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। এই ধারণা যদি সত্যি হয় তবে চীন নিজেকে এখনো প্রস্তুত মনে করে না। যদিও চীন ভাবছে আমেরিকার সাথে একটা সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। সেই হিসাবে ধরে নেয়া যায়, চীন অবশ্যই ভাবছে এমন একটা সংঘাত সঠিক সময়ের আগেই ঘটেছে। চীন এমনও ভাবতে পারে যে, ঝড়টা রাশিয়ার উপর দিয়ে যাচ্ছে এই অবস্থায় রাশিয়া চীনের উপর আরো নির্ভরশীল হবে। তাছাড়া যুদ্ধে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হবে এবং তারাও চীনের উপর আরো নির্ভরশীল হবে।

ভারত কি ভাবছে?
রাশিয়ার সাথে ভারতের ভালো সম্পর্ক বহু দশকের। ভারতের ৭০% সামরিক সরঞ্জাম রাশিয়া থেকে আসে। চীনের সাথে শত্রুতার কারণে ভারত আমেরিকার দিকে ঝুঁকলেও তারা জানে আমেরিকা সা¤্রাজ্য হারানোর ভয়ে অনেককিছু করছে যা ভারতের স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভারত চায় উন্নতি, কোন বড় শক্তির সাথে বিরোধ চায় না। আমেরিকা ভারতকে চাপ দিবে, কিন্তু এতোটা চাপ দিতে পারবে না যে ভারত হাতছাড়া হয়ে যায়। কোন দেশই ভারতকে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বড় কিছু করাতে পারবে না। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় এমন একটা সংঘাত ভারত চায়নি। এই অবস্থায় ভারত দুই পক্ষের সাথে যতোটা সম্ভব মিলিয়ে চলার চেষ্টা করবে।

আমেরিকা কি রাশিয়ার আক্রমণ চেয়েছে?
আমেরিকা চেয়েছে ইউরোপের কাছে রাশিয়াকে শত্রু হিসাবে প্রমাণ করতে। আমেরিকা পছন্দ করেনি যে ইউরোপ রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর নির্ভরশীল থাকুক বা নির্ভরতা আরো বাড়ুক। এই কারণে আমেরিকা চেয়েছে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করুক। কিন্তু এই সময়ে আমেরিকা আক্রমণ চায়নি অন্তত দুটো কারণে। এক, ইউক্রেনকে পুরোপুরি অস্ত্র সজ্জিত করা হয়নি এবং দুই, কোভিডের কারণে আমেরিকা ও ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনো ভালো নয়। তাছাড়া তারা চীনকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে এই কাজ আগে শেষ করা উচিত।

পশ্চিমা বিশ্ব কি ইউক্রেনের জনগণের বন্ধু?
অবশ্যই না। বন্ধু হলে, পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনে শান্তির চেষ্টা করতো। কয়েক বছর ধরে তাদের অস্ত্র সজ্জিত করতো না। তাদেরকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতো না। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে এমন অবস্থার সৃষ্টি করতো না। এখনো নিজেরা যুদ্ধ না করে কিছু দেশ ইউক্রেনে অস্ত্র ও যোদ্ধা পাঠাচ্ছে। এর ফলে যুদ্ধ প্রলম্বিত হবে, ইউক্রেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে পশ্চিমা বিশ্ব কেয়ার করেনা, তাদের মানুষ তো আর মারা যাচ্ছে না।

কার বেশি ক্ষতি হবে?
– ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের।
– অর্থনৈতিক ভাবে রাশিয়ার।
– বিশ্ব ইমেজে রাশিয়ার।
– অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চিম ইউরোপের।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু যুদ্ধের কারণে নয়, বরং পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধ ও স্যাংশনের কারণে।

শেষ পরিণতি কী?
কেউই জানেনা, যদিও অনেকেই অনেক কথা বলছে। তবে কিছু ব্যাপার প্রায় নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
– রাশিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।
– রাশিয়া হাল ছেড়ে দিবে না। অনেক ক্ষতি স্বীকার করে হলেও রাশিয়া ইউক্রেনের উপর প্রভাব রাখবে বহু বছর।
– রাশিয়াকে একঘরে করার চেষ্টা করা হবে আপ্রাণভাবে।
– ইউরোপের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে।
– যদি পশ্চিমা বিশ্ব স্যাংশন পরিহার না করে তবে ভুগবে সারা বিশ্ব।

লেখক : নিউজিল্যান্ড প্রবাসী চিকিৎসক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট