চট্টগ্রাম বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫

সর্বশেষ:

এআই উচ্চতর শিক্ষার পথচলায় এক নতুন নির্ভরযোগ্য সহযাত্রী
এআই

এআই উচ্চতর শিক্ষার পথচলায় এক নতুন নির্ভরযোগ্য সহযাত্রী

শরীফুল ইসলাম জুনাইদ/সুস্মিতা বড়ুয়া

২৭ মে, ২০২৫ | ১০:৩৭ অপরাহ্ণ

একসময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ছিল ক্রিস্টোফার নোলানের সায়েন্স ফিকশন সিনেমা কিংবা আইজ্যাক অসিমভের ফাউন্ডেশন সিরিজের বইগুলোর মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির পাতায়। কিন্তু এখন এটি হয়ে উঠেছে আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্ক যুক্ত, যা কিনা প্রতিনিয়ত আমাদের চিন্তাধারা, কাজের ধরন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হয়ে উঠেছে। এই প্রযুক্তির প্রসার এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যে, আগে যে কাজের সাহায্য নিতে প্রিয় বন্ধু কিংবা শিক্ষকের কাছে দৌঁড়াতে হতো তা এখন অনায়াসে এআই বন্ধুর কাছে সহজেই করা যায়। শিক্ষাখাত এই এআই’র সর্বোচ্চ সুফল ভোগ করছে এবং উচ্চতর শিক্ষা খাতেই এআই প্রযুক্তির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এবং এটি এই খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

 

বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন এআই ব্যবহারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কারণ, এটি শুধু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতাই বদলে দিচ্ছে না, বরং শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, পাঠদানের ধরন, গবেষণা কার্যক্রম এবং প্রশাসনিক দক্ষতা সবকিছুতেই আনছে নতুন মাত্রা। এক সময় যেখানে একটি ক্লাসরুমে সব শিক্ষার্থীর জন্য একই পাঠদানের পদ্ধতি অনুসরণ করা হত, এখন সেখানে এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত চাহিদা, দুর্বলতা, এবং আগ্রহ বুঝে তৈরি হচ্ছে আলাদা শেখার পরিকল্পনা। ফলে একজন শিক্ষার্থী তার নিজস্ব গতিতে এবং নিজস্ব উপায়ে শেখার সুযোগ পাচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত তার অর্জনের মানোন্নত করছে।

 

একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক কর্মী এআই প্রসঙ্গে বলেন- গবেষণা কার্যক্রমেও এআই এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বিশাল ডেটাসেট বিশ্লেষণ, প্রাসঙ্গিক তথ্য খোঁজা, ভাষাগত বিশ্লেষণ, এমনকি গবেষণা প্রতিবেদনের খসড়া তৈরির মতো জটিল কাজগুলো এআই এখন মুহূর্তেই সম্পন্ন করতে পারে। ফলে গবেষকরা এখন কেবল সময় ব্যয় করতে পারছে গবেষণার মৌলিক চিন্তাভাবনায়, আমরা সময়সাপেক্ষ কাজগুলো এখন সহজেই সেরে ফেলছি। আমরা তো ChatGPT, Elicit, বা Scite-এর মতো আধুনিক টুলস এখন গবেষণার সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত করছি নিত্য নৈমিত্তিকভাবে।

 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীকে এআই প্রযুক্তিতে শিক্ষক কি সহায়তা পাচ্ছেন এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রম এআই বেশ সহজ করে তুলছে। বাইরের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন তো ছাত্র ভর্তি থেকে শুরু করে রেজাল্ট বিশ্লেষণ, শিক্ষক মূল্যায়ন, কোর্স পর্যালোচনা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এখন অটোমেশন এবং বুদ্ধিমান সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে, যা খরচ ও সময় সাশ্রয়ের পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করছে। যদিও আমাদের দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো সে কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে অজানা কারণে অনাগ্রহী।

 

তবে, এতো সম্ভাবনার মধ্যেও এআই’র ব্যবহার নিয়ে কিছু উদ্বেগ এবং চ্যালেঞ্জ অবশ্যই রয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য বা একাডেমিক রেকর্ডের মতো সংবেদনশীল তথ্য যদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করা হয়, তবে তা হতে পারে বড় ধরনের ঝুঁকি। পাশাপাশি, এআই’র উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এআই’র সিদ্ধান্ত সবসময় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক নাও হতে পারে। শিক্ষা একটি মানবিক প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষার্থীর আবেগ, মানসিক অবস্থা ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব বিবেচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা কেবল একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকই সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারেন।

 

বাংলাদেশের প্রসঙ্গে এলে দেখা যায়, এখনো এআই প্রযুক্তি ব্যবহারে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। যদিও কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে সীমিত আকারে ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্ম এবং স্বয়ংক্রিয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার পথে হাঁটছে, তবে তা সুগঠিত বা তার কর্মচঞ্চলতা যে ফলপ্রসূ হচ্ছে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এর প্রধান কারণ অবকাঠামোগত দুর্বলতা, উপযুক্ত জনবল ঘাটতি এবং সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব। তবে আশার কথা হলো, জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

 

এখন সময় এসেছে একটি জাতীয় পর্যায়ের সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের, যার মাধ্যমে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রশাসক এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটি সচেতন ও দক্ষ এআই নির্ভর শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। শুধু প্রযুক্তি কেনা বা সফটওয়্যার স্থাপন করলেই উন্নয়ন হবে না, প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ, প্রশিক্ষণ, এবং একটি সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির।

 

এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে বলা যায়, এআই এবং উচ্চশিক্ষার মধ্যে গড়ে ওঠা এই নতুন সম্পর্ক আমাদের উচ্চতর শিক্ষাখাত ও গবেষণামূলক অগ্রগতিকে অদূর ভবিষ্যতে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তবে সেই সম্ভাবনার বাস্তবায়নে চাই সচেতনতা, দায়িত্বশীলতা, এবং সর্বোপরি একটি মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন কখনোই মানবিক বুদ্ধির বিকল্প না হয়ে ওঠে বরং সেটি হয়ে উঠুক আমাদের শিক্ষার পথচলায় একজন উপকারী বন্ধু বা নির্ভরযোগ্য সহযাত্রী।

লেখকদ্বয়: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ

শেয়ার করুন