চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে

অনলাইন ডেস্ক

২৭ নভেম্বর, ২০২২ | ৯:৩৩ অপরাহ্ণ

‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম’ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর অসতর্ক ব্যবহারের কারণে অনেককেই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ঝুট-ঝামেলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

এই যেমন আমাদের দেশের ও বিদেশের ছেলেমেয়েরা ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়, চ্যাটিং ও বন্ধুত্বের সূত্র ধরে পরস্পরের প্রেমে পড়ছে। আর এ প্রেম-ভালোবাসার মোহে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো থেকেও ছুটে আসছেন অনেক মেয়ে। বিয়ে করে মিডিয়ায় সুখী দাম্পত্য জীবনের সাক্ষাৎকারও দিচ্ছেন। কিন্তু দু-চার, দশদিন অবস্থান করে নববিবাহিত স্ত্রী স্বামীকে তার দেশে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে এই যে চলে যান, আর কোনো খোঁজখবর রাখেন না। শেষ হয়ে যায় প্রেম, পরিণয়। এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে।

 

কিছুদিন আগে প্রেমের টানে ব্রাজিলের এক তরুণী রাজবাড়ী জেলার এক যুবকের কাছে ছুটে এসেছিলেন। বিয়ের পর তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল চারদিনের। নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পর সেই তরুণী যুবকটির সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখেননি। কথা হলো, এ চারদিনেই কি সব প্রেম-ভালোবাসা উবে গেল? কারণ কী? বিদগ্ধজনেরা বলেন-ওরা এখানে স্বচক্ষে সবকিছু দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে নিজ দেশে ফিরে সম্পর্কের ইতি টানার চেষ্টা করে।

প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে পরিচিত হওয়ার যত ধরনের মাধ্যম আছে, তার সর্বশেষ সংযোজন হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আগে প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে পছন্দের মানুষটিকে ভালোভাবে যাচাই করা হতো। আর এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক-আধটু পরিচয়ের সূত্র ধরেই ভাব বিনিময় শুরু হয়ে যায়। তাই অনেকেই বলেন, এখন প্রেম-ভালোবাসার উৎপত্তি হয় ফেসবুকে, হৃদয়ে নয়।

 

কাউকে একটু একটু করে জানতে জানতে তার প্রতি কারও একটু ভালোলাগা জন্ম হতেই পারে, ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা, তারপর বিয়ে। একজনের কাছে আরেকজনের কোন বিষয়টি যে মনে ধরে যায়, তা আগে থেকে বলা যায় না। এই তো নাটোরের এক কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ২২ বছরের যুবকের সঙ্গে একই জেলার চল্লিশোর্ধ্ব জনৈক কলেজ শিক্ষিকার ২০২১ সালের জুনে প্রথম পরিচয় এবং একই বছরের ডিসেম্বরে বিয়ে হয়। তারপর একত্রে বসবাস ও দিনযাপন এবং এর কয়েকদিনের মাথায় সেই শিক্ষিকার অস্বাভাবিক মৃত্যু। বিষয়টি এখন বিচারাধীন। তাই ভাবছি, কী বিচিত্র ভালোবাসার কী দুঃখজনক যবনিকাপাত!

কয়েক বছর আগের কথা। রাজধানীর কমদতলী এলাকার এক ছেলের সঙ্গে এক মেয়ের ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে নিয়মিত কথা বলা ও চ্যাটিং চলতে থাকে; এরপর একদিন তারা বাইরে দেখা করে। সামনাসামনি দেখা-সাক্ষাতে মেয়েটি বুঝতে পারে-ছেলেটি লেখাপড়া তো করেই না, এমনকি স্কুলের গণ্ডিও পার হয়নি। মেয়েটি ভাবে, তার সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া ও বিয়ে করা সম্ভব নয়। তার প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা বাবা এবং মা এ সম্পর্ক মেনে নেবেন না। মেয়েটি সবকিছু বোঝায়, কিন্তু তারপরও ছেলেটি ছিল নাছোড়বান্দা। শেষমেশ ভিডিও কলের মাধ্যমে লাইভে এসে ছেলেটি আত্মহত্যা করে।

 

‘মিসম্যাচ’জনিত কারণে নিয়মিত ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা আমাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কেবল বাড়িয়েই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুধু ছবি বা প্রোফাইল দেখে কারও সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায় না। তাই কারও সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির আগে ভালোভাবে খোঁজ নেওয়া দরকার, ভার্চুয়াল মাধ্যম ছাড়া ঠিকানা ধরে সরাসরি খোঁজখবর নিয়ে অগ্রসর হওয়া ভালো। কারও মিষ্টি কথায় মজে সবকিছু উজাড় করে দিলে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার লাগাম টানা যাবে না। অনলাইন প্রেমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেমিক-প্রেমিকাদের তাদের নিজেদের ও দুই পরিবারের সামাজিক মর্যাদাগত বিষয়ে অতিরঞ্জিত তথ্যের বাগাড়ম্বরতা বেশি থাকে। তাই কথার ফুলঝুরির সঙ্গে বাস্তবতাকে মিলিয়ে নেওয়া দরকার। প্রেমে বেহুঁশ হয়ে পরে আফসোস করে লাভ নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার ব্যবসাও এখন জমজমাট হয়ে উঠছে। কিছুদিন আগে ফেসবুকে এক তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এক যুবকের। এরপর তাদের সম্পর্ক প্রেমে রূপ নেয়, এক পর্যায়ে তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে নানা কারণ দেখিয়ে ছেলেটির কাছ থেকে মেয়েটি ৮০ লাখ টাকা নেয়। তারপর মেয়েটি হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। প্রেমিক পরে বুঝতে পারেন, তিনি ইতোমধ্যে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

 

কয়েকদিন আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্র ঢাকার একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এক তরুণীর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার পরিচয় হয়। তারপর তাদের মধ্যে কথাবার্তা হতো এবং এর ধারাবাহিকতায় গত বছরের ডিসেম্বরে একটি রেস্টুরেন্টে তারা দেখা করেন। এরপর রিকশায় ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে ওই তরুণী জানায় তার বাসা এখন ফাঁকা, কেউ নেই এবং তাকে (তরুণ) সে (তরুণী) তার বাসায় নিয়ে যেতে চায়। তরুণ রাজি হলে তারা এক বাসায় যায়। ওই বাসায় পৌঁছামাত্র অপেক্ষমাণ দুষ্কৃতকারীরা তার হাত-পা বেঁধে ফেলে। চাঁদার দাবিতে তার বাবার কাছে তার ছবি পাঠায় এবং বিকাশের মাধ্যমে দ্রুত টাকা পাঠাতে বলে। এমনকি চাঁদা না পেলে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। এই হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়ের পরিণতির একটি উদাহরণ।

ফেসবুকে প্রেম ও বিয়ের পর পাচারকারীর হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। হবিগঞ্জ জেলার জনৈক সোহেল মিয়ার সঙ্গে টিকটক ভিডিও তৈরির সুবাদে পাবনার এক তরুণীর পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ছেলেটি মেয়েটিকে সাতক্ষীরা সীমান্ত পথে ভারতে নিয়ে কলকাতায় পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে।

 

অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রোফাইল পিকচারে দেশি-বিদেশি নায়িকা, মডেলের ছবি ব্যবহার করে ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ পাঠানো হয়। অনেকেই কোনো ধরনের হিসাব-নিকাশ না করে সেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেন। আজকাল ছেলেরা মেয়ের নাম দিয়ে, আর মেয়েরা ছেলের নাম দিয়ে ফেসবুক আইডি তৈরি করছে এবং প্রয়োজনমতো সেসব ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে।

ফেসবুকের কিছু আইডি দেখলেই বোঝা যায় সেগুলো ফেক (নকল), বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। ওই ধরনের আইডির প্রোফাইল পিকচার ও কভার ফটো হিসাবে ব্যবহৃত ছবিগুলো যথাযথ বলে মনে হয় না। ওসব আইডিতে যেসব বিষয় পোস্ট করা হয় তাও আপত্তিকর। তা সত্ত্বেও এ ধরনের আইডি থেকে আসা ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ অনেক সচেতন ব্যক্তিও গ্রহণ করেন। শুদ্ধাচারী ব্যক্তিদের বন্ধুত্বের তালিকায় ফেক আইডিধারীদের নাম দেখে অন্যরাও ওসব বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করেন। অনেক সচেতন মানুষও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ব্যাপারে বোধহীন হয়ে যান। আর ভুয়া আইডিধারীরা তো তা-ই চায়, অপেক্ষা করতে থাকে মাহেন্দ্রক্ষণের, সুযোগ বুঝে ভাব জমিয়ে আম-ছালা সবই লুটে নেয়।

 

যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছ থেকে অহরহ ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ আসে। ওইসব বিদেশির প্রোফাইল ঘাঁটলে বন্ধু তালিকায় দু-একজন বাংলাদেশি ছাড়া তাদের দেশের বা সমাজের কারও নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে প্রশ্ন জাগা উচিত-শুধু দু-চারজন বাংলাদেশিই কেন সেই বিদেশির বন্ধুত্বের তালিকায়? তাদের কি নিজস্ব কোনো সার্কেল নেই? হাজার হাজার মাইল দূরের দেশের কারও কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর কারণ কী? এ ধরনের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করার আগে আমাদের মাথায় কি এ বিষয়গুলো উঁকি দেয় না? এগুলো চিন্তায় না আনলে পদে পদে প্রতারিত হতে হবে।

চ্যাটিং, ফোনালাপ ও ভিডিও কলে খুব সংযত থাকা উচিত। এখন ফোনালাপ ও অবচেতন মুহূর্তে ভিডিও রেকর্ডকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের হাতিয়ারে পরিণত করা হচ্ছে। প্রেমিক-প্রেমিকা হিসাবে ভান করা মানুষটি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে একান্ত মুহূর্তের খোলামেলা ছবি ও ভিডিও চাইছে, যা পরে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। উঠতি বয়সের অনেক মেয়ে তো এমন আশঙ্কায় আত্মহত্যাও করেছে। এমন উদাহরণ অনেক আছে। প্রত্যেকেরই প্রাইভেসি ও নিজস্বতা থাকা দরকার, যা কখনোই কারও সঙ্গে, বিশেষত অনলাইনে, শেয়ার করা সমীচীন নয়।

 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপকারিতা ও উপযোগিতা বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিনিয়ত এসব মাধ্যমের নতুন নতুন ফিচার মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও সাবলীল করছে। কিন্তু কারও অপরিণামদর্শী আচরণ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণে বিপদ ঘটলে যত দোষ নন্দঘোষের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আসলে যা করা উচিত তা হলো, এ মাধ্যমে বিচরণের সময় সতর্কতার বিষয়টি মাথায় রাখা। ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যতক্ষণ থাকা হবে, ততক্ষণ যেন এর মাধ্যমে ভালো কিছু করতে পারা যায়, সেই চিন্তা থাকতে হবে। এ মাধ্যমকে জ্ঞান আহরণ, পরিচ্ছন্ন বিনোদন, নির্ভেজাল ভালোবাসার মঞ্চ এবং মানুষের শুভ ইচ্ছা, সৎ চিন্তা ও মহৎ কাজগুলোকে আরও রাঙিয়ে তোলার ক্যানভাসে পরিণত করতে হবে। তথ্যসূত্র: যুগান্তর

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট