চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫

সর্বশেষ:

হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিস পরীক্ষা ও থ‍্যালাসেমিয়া

হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিস পরীক্ষা ও থ‍্যালাসেমিয়া

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী

৮ মে, ২০২৫ | ৫:৪২ অপরাহ্ণ

৮ মে ২০২৫ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক থ‍্যালাসেমিয়া দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘থ্যালাসেমিয়ার জন্য সামাজিক ঐক্য গড়ি, রোগীদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করি’ থ‍্যালাসেমিয়া একটি অসংক্রামক রক্ত রোগ। অসংক্রামক হলেও সচেতনতার অভাবে এটি বংশ পরম্পরায় দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলে ও ধারণা করা হয় আমাদের দেশে এর বাহক সংখ্যা প্রায় ৬-৭ শতাংশ। দেশের ৩ পার্বত্য অঞ্চল রাঙামাটি-বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পরিবার সমূহে এর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

 

থ‍্যালাসেমিয়া ও সংশ্লিষ্ট রোগ সমূহের নামে ভিন্নতা থাকলেও এদের উপসর্গ ও চিকিৎসা প্রায় অভিন্ন। আমাদের দেশে বিটা-থ‍্যালাসেমিয়া ও ‘ই’ হিমোগ্লোবিনোপ‍্যাথিই বেশি পাওয়া যায়। রক্তের লোহিত কণিকা তথা RBC-এর স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরির প্রয়োজনীয় প্রোটিন ‘গ্লোবিন’ তৈরির বংশগত জিন-ত্রুটির কারণে অস্বাভাবিক হিমোগ্লোবিন তৈরির ফলে RBC-এর স্বাভাবিক আয়ুস্কাল কমে যাওয়ায় রক্ত স্বল্পতার সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে দেহের বিভিন্ন অঙ্গের অপরিমিত রক্ত পরিবহনে কার্যকারিতা ব‍্যহত হবার ফলে বিভিন্ন উপসর্গসমূহ দৃশ্যমান হয়। দুর্ভাগ‍্যজনক হলেও সত‍্যি যে আমাদের দেশের আক্রান্ত রোগীরা রোগ নির্ণয়ের দ্রুততম সময়ে এর ব‍্যয়বহুল সঠিক চিকিৎসা অর্থাৎ Allo-BMT চিকিৎসা পেতে অক্ষম। সুস্থ থাকার জন্য নূন‍্যতম নিয়মিত নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ও ব‍্যয়বহুল আয়রন চিলেশন চিকিৎসা ও দরিদ্র রোগীদের জন্য সূদুর পরাহত। ফলে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা ও পরিণাম মৃত্যুর প্রহর তাদের অপেক্ষা। কিন্তু সুখের খবর হলো সামান্য সুলভ সচেতনতাই এই সমাজকে থ‍্যালাসেমিয়া শূন্য রাখতে পারে। একটি পরীক্ষা তথা রক্তের হিমোগ্লোবিনে র ‘ইলেকট্রোফরেসিস’ পরীক্ষা। যেটি অজানা ১০ কোটি মানুষের থ‍্যালাসেমিয়ার বাহক শনাক্ত করণে সহায়ক। যার মাধ্যমে আজ থ‍্যালাাসেমিয়া প্রবণ সূদুর সাইপ্রাস থ‍্যালাসেমিয়া মুক্ত । থ‍্যালাসেমিয়ার বাহকে-বাহকে বিয়ে এবং তৎপরবর্তী সন্তানদের থ‍্যালাসেমিয়ার বাহক: আক্রান্ত: স্বাভাবিক হবার সম্ভাবনা যথাক্রমে ৫০:২৫:২৫ ভাগ। তাছাড়া ও বিয়ে পরবর্তী দুই বাহকের গর্ভস্থ সন্তানের ভ্রুণ থ‍্যালাসেমিয়া আক্রান্ত কিনা তা নির্দিষ্ট সময়ে মলিকুলার পরীক্ষার মাধ্যমে জানা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। ফলে দেশ ও সমাজকে থ‍্যালাসেমিয়া মুক্ত করত: সুস্থ জনবল পেতে বাহক স্ক্রিনিংয়ের বিকল্প নেই।

 

বাংলাদেশের অর্থনীতি জনশক্তি রপ্তানিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। সেই জন্য চাই সুস্থ জনবল। অর্থনীতিতে গতি আনতে চাই সুস্থ জনবল, সুস্থ জাতি। সারা বিশ্বের ১০ কোটি মানুষের অনেকেরই অজানা যে, সে বংশানুক্রমে প্রাপ্ত থ‍্যালাসেমিয়ার জিনের বাহক।

 

সমাধান: সচেতনতা, স্ক্রিনিং এবং শিক্ষা প্রতিরোধ ব‍্যবস্থার মূল চাবিকাঠি ।

* থ্যালাসেমিয়া জিন বহনকারী ব‍্যক্তিরা প্রতি ৪ জনের মধ্যে ৩ জন তাদের অবস্থার কারণে উদ্বিগ্ন, দুশ্চিন্তা, বিষন্নতা বা অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। সমাধান:সঠিক নির্দেশনা ও ও সুস্থ থাকার নিশ্চয়তা।

* বড় হবার সাথে সাথে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ৬৬ শতাংশ ব্যক্তিই তাদের গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতা নিয়ে চিন্তিত। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।সমাধান: সঠিক নির্দেশনা ও সুস্থ থাকার নিশ্চয়তা।

* আক্রান্ত থ‍্যালাসেমিয়া রোগীদের ৭০ শতাংশ তাদের মৌলিক চিকিৎসা চাহিদা তথা নিয়মিত নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন এবং আয়রন চেলেশন বা নিস্কাশন চিকিৎসা পেতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে। সমাধান: সচেতনতা সৃষ্টি, রোগীদের দোরগোড়ায় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা ও স্বল্পমূল্যে চিলেশশন ওষুধ সহজলভ্য করা।

* থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ যে চিকিৎসা, সামাজিক ও মানসিক সহায়তা পান, তাতে তারা সন্তুষ্ট নন। অথচ প্রতিটি রোগীর তাদের জানার,মূল্যায়ন এবং যত্ন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সমাধান: সহজলভ্য সঠিক চিকিৎসা, সামাজিক দায়বদ্ধতা বিত্তবানদের সহায়তা। সর্বোপরি থ‍্যালাসেমিয়া প্রবণ দরিদ্র দেশের ব‍্যয়বহুল প্রতিকার তথা চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম পন্থা। তাই আমাদের দেশে থ‍্যালাসেমিয়া প্রতিরোধকল্পে নিন্মেক্ত প্রস্তাবনা ও সুপারিশ গ্রহণ করা যেতে পারে।

প্রস্তাবনাগুলো হলো- ঝুঁকিপূর্ণ জনগণের বাহক স্ক্রিনিং, বিনামূল্যে দেশের প্রত‍্যন্ত অঞ্চল তথা উপজেলা পর্যায়ে হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিস পরীক্ষা সহজলভ্য করণ, বিয়ের পূর্বে সম্ভাব্য যুগলের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিস পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান, জেলা অথবা বিভাগীয় পর্যায়ে বাহক যুগলের গর্ভবতী মায়েদের নির্দিষ্ট সময়ে গর্ভস্থ ভ্রূণের প্রি-নেটাল রোগ নির্ণয়পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সু-ব‍্যব্যবস্থা নিশ্চিত করণ। 

 

লেখক: অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী

প্রাক্তন প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
হেমাটোলজি বিভাগ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

 

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট