চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে করণীয়

৮ জুলাই, ২০২১ | ৭:২৪ অপরাহ্ণ

করোনা বৈশ্বিক মহামারীর কারণে গত ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বর্তমান অবধি প্রায় ১৭ মাস যাবৎ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শিক্ষার প্রসারে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে।

আর করোনাকালীন এই স্থবিরতায় আর্থিক দৈন্যতা, উদাসীনতা কিংবা অন্য কোন কারণে দেশের মোট শিক্ষার্থীর একটি অংশ স্ব স্ব শ্রেণিতে শিক্ষার্জন থেকে দূরে সরে গিয়ে ধারাবাহিক শিক্ষার্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ কারণে শিক্ষায় এসমস্ত শিক্ষার্থীদের ড্রপ আউট কিংবা ঝরেপড়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একটি ফুলগাছ থেকে একেকটি ফুল ঝরে গেলে ঐ গাছের সৌন্দর্য যেমন ক্রমান্বয়ে লোপ পায়, ঠিক তেমনি একইভাবে দেশের মোট শিক্ষার্থীর একটি অংশ যদি স্বাভাবিক শিক্ষার্জন থেকে পিছিয়ে পড়ে, তবে দেশের জাতীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

শিক্ষাব্যবস্থায় কোভিড-১৯ এর প্রভাব পর্যালোচনাকারী শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, হয়তো বা এই মহামারীর পর ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে নাও ফিরতে পারে, যা আমাদের দেশের শিক্ষাবিস্তারে উদ্বেগের কারণ হিসেবে আমি মনে করি। কেননা করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দায় চলমান মহামারীর আগের দরিদ্র অনেক পরিবার অতি দরিদ্রের কাতারে গিয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে ঐ সমস্ত পরিবারের অভিভাবকগণ তাঁদের সন্তানদের হয়তোবা বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে কোনো চাকরীতে পাঠাতে পারে।

এমনকি মহামারীর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক মন্দায় অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে শিক্ষাব্যয় মেটানো সম্ভব না ও হতে পারে। ফলে দেশে মোট শিক্ষার্থীর একটি অংশ ঝরে পড়লে তা অবাস্তব কিছু হবে না। তাই এখন থেকে এই ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারের চিন্তা করা বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে খুবই জরুরি। একজন শিক্ষার্থীও যেন করোনাকালীন সময়ে ঝরে না যায় সেদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে বর্তমানে ভার্চুয়াল ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তথ্যব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করা দরকার।

আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার কারণ ও প্রতিকার অনুসন্ধান করে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ঝুঁকিপ্রবণ শিক্ষার্থীর পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দরকার হলে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কতজন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে তার ফলো-আপ করে তাদেরকে শিক্ষার্জনে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে পুনরায় ভর্তির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে যে বয়সী শিক্ষার্থীদের মাঝে ঝরেপড়ার প্রবণতা বেশী তাদেরকে শিক্ষকদের সহযোগিতায় কাউন্সিলিং প্রোগ্রামের আওতায় নিয়ে আসা দরকার।

এছাড়াও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ঝরেপড়া রোধে সরকার কর্তৃক শিক্ষাবৃত্তিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, যেন তাদের পরিবার নিজ নিজ সন্তানদের পড়াশোনার খরচকে কোনোভাবেই বোঝা মনে না করেন এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাধুলা, বিনোদনমূলক কার্যক্রম ও অন্যান্য সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীর পরিধিকে বিস্তৃতি ঘটানোর লক্ষ্যে সরকারী সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়াও অন্যদিকে করোনাকালীন অভিভাবকদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিদ্যালয়ভিত্তিক তালিকা তৈরী করে সরকারি সহযোগিতায় বিশেষ করে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণসহ প্রয়োজন অনুযায়ী মাসিক বৃত্তির প্রচলন করা এই মুহূর্তে অতীব প্রয়োজন।

অন্যদিকে বর্তমানে প্রযুক্তিগত সহায়তায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হলেও শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। উক্ত বিষয়ের আলোকে যে সমস্ত শিক্ষার্থী ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরমে যুক্ত হয়ে শিক্ষার্জন করছে তারা কতটুকু শিখনফল অর্জন করতে পেরেছে সেটি বিবেচনায় এনে প্রতিষ্ঠানসমূহকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মফস্বল কিংবা দুর্গম এলাকার যেসব শিক্ষার্থী কোনো মাধ্যমেই যুক্ত হতে পাচ্ছে না এ মুহূর্তে তাদের উপরও সমান গুরুত্ব দেয়া দরকার। আর এজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করা। আর এক্ষেত্রে কতজনের মধ্যে ভার্চুয়ালি শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পৌঁছেছে তা জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে আদমশুমারীর মত শিক্ষাশুমারীর ব্যবস্থা করে প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে এনে শিক্ষার প্রসারকে সুষম গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

দরকার হলে তাদের জন্য ভার্চুয়ালি শিক্ষার সুযোগ  নিশ্চিত কল্পে প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য সরকার কর্তৃক অন্ততপক্ষে একটি এন্ড্রয়েড মোবাইল ও বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবার সুযোগ নিশ্চিত করা দরকার। দেশে মানসম্মত শিক্ষার বিস্তারে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব শ্রেণিতে ফিরিয়ে এনে তাদেরও শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করে জাতীয় উন্নয়নকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সুচিন্তিত পদক্ষেপ থাকা জরুরি।

লেখক: সঞ্জয় চৌধুরী, শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।

পূর্বকোণ/সাফা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট