চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিশ^বিদ্যালয় হোক জ্ঞান সৃষ্টির আঁতুড়ঘর

কাজী আশফিক রাসেল

২৩ জানুয়ারি, ২০২০ | ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

কবি হেলাল হাফিজ তাঁর ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ নামক কবিতায় লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। কবির এ কথার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের সুযোগ কারও আছে বলে মনে হয়না। যৌবন হচ্ছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি, যা আমাদের জীবনকে করে তুলে গতিশীল ও প্রত্যাশাময়। সমস্ত জীর্ণ পুরোনো সংস্কারকে ধ্বংস করে মনের মত নতুন জগত রচনার সাধনায় অগ্রসর হতে এক দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ দুর্বার শক্তি এই যৌবন। যৌবন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। সেই শ্রেষ্ঠ সময়টি কাজে লাগাতে তৎপর থাকে ব্যক্তি স্বয়ং, সমাজ ও রাষ্ট্র। বিশ^বিদ্যালয় আর যৌবনের ধর্ম এক ও অভিন্ন। বিশ^বিদ্যালয়গুলো যৌবনের প্রতীক। বিশে^র প্রতিটি বিশ^বিদ্যালয় চিরযৌবনা। যৌবনের ধর্ম যেমন সৃষ্টিশীলতা, তেমনি সৃষ্টিশীলতার মিছিলে অংশগ্রহণ করা যেকোনো বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য অত্যবশ্যকীয় কাজ। প্রকৃতপক্ষে, বিশ^বিদ্যালয় হচ্ছে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির আঁতুড়ঘর।

নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি অর্থাৎ গবেষণায় যে বিশ^বিদ্যালয় যত বেশি অভ্যস্ত, সে বিশ^বিধ্যালয়ে শিক্ষার মান তত বেশি উন্নত। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোর পশ্চাৎপদতা বেশ স্পষ্ট। লন্ডনভিত্তিক উচ্চশিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রতিবছর বিশ^ব্যাপী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠা নিয়ে জরিপ করে। এবার তারা ৯২টি দেশের ১ হাজার ৩০০ বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে একটি জপির করেছে। তাতে বিশে^র সেরা এক হাজার বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ^বিদ্যালয়ের নাম নেই। অথচ সেরা এক হাজার বিশ^বিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের ৩৬টি, পাকিস্তানের ৭টি ও শ্রীলঙ্কার ১টি বিশ^বিদ্যালয় জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়াও গত মে মাসে সাময়িকীটি এশিয়ার সেরা বিশ^বিদ্যালয়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকায়ও এশিয়ার ৪১৭টি বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের একটি বিশ^বিদ্যালয়েরও উল্লেখ ছিলনা। বিষয়টি আমাদের জন্য কেবল দুঃখজনকই নয়, লজ্জাজনকও বটে। টাইমস হায়ার এডুকেশন মানক্রমে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়, তা হলো শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম, সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, এ খাত থেকে আয় এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতা। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না বাংলাদেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান যে ক্রমেই নিচের দিকে যাচ্ছে তা জানতে বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপের প্রয়োজন হয় না। প্রতিদিন বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার নামে যেসব অনাচার ঘটে চলেছে, তা শিক্ষার পরিবেশের পরিপন্থী।

বিশ^বিদ্যালয় হচ্ছে বিশে^র বিদ্যার আলয় বা নিকেতন। স্বাধীন জ্ঞানচর্চা, সৃজনশীলতা ও মুক্তচিন্তার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। কলেজ আর বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে কলেজে কাঠামোবদ্ধ পড়ালেখা হয়, সেখানে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি ও জ্ঞান বিকাশের সুযোগ থাকে সীমিত। অন্যদিকে বিশ^বিদ্যালয় কেবল জ্ঞান বিতরণ করে না, জ্ঞান সৃষ্টিও করে। উন্নত দেশে বিশ^বিদ্যালয় জ্ঞান সৃষ্টি করে, আর স্কুল-কলেজ সেই সৃষ্ট জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। আমাদের দেশে তা কল্পনা, বাস্তবতা নয়।

একটা দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সে দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলো। আধুনিক বিশ^বিদ্যালয়ের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে প-িত জওহর লাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘একটি দেশ ভালো হয় যদি সে দেশের বিশ^বিদ্যালয়গুলো ভালো হয়।’ বিশে^ যেসব দেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে, তার মূলে রয়েছে উন্নত শিক্ষা। পৃথিবীতে এমন একটি দেশ পাওয়া যাবে না যে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতি করেছে। দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা শিক্ষা বলতে বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়াতে যতটা সক্রিয়, শিক্ষার মান ধরে রাখতে ততটাই নিষ্ক্রিয়। ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায়, কিন্তু যারা জেগে ঘুমানো ভান করে, তাদের জাগানো দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ও বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ঘুম যত দ্রুত ভাঙ্গবে ততই জাতির মঙ্গল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট