চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

এই দশকের শেষ সম্পাদকীয় সবার জন্য সুসংবাদ বয়ে আনুক একুশ শতকের তৃতীয় দশক

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

কালের অমোঘ নিয়মে আজ সূর্যাস্তের পর পুরনো হয়ে যাবে আরেকটি খ্রিস্টীয় বছর, বিদায় ২০১৯। একইসঙ্গে গত হয়ে যাবে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকও (২০১০-১৯)। কাল ঘন কুয়াশা সরিয়ে নতুন সূর্যোদয়ে শুরু হবে আরেকটি নতুন ইংরেজি বছর, ২০২০। একইসঙ্গে সূচনা হবে একুশ শতকের তৃতীয় দশকের (২০২০-২৯)। বিদায়ী দশকের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা-সংঘাত, পাওয়া-না পাওয়া, অর্জন-বিসর্জন সবকিছুই ঠাঁই নেবে স্মৃতির পাতায়। মহাকালের গর্ভে একটির পর একটি বছরের বিলীন হলেও নিয়মানুযায়ী নতুন স্বপ্নকে ধারন করেই প্রতিটি নতুন বছর ও নতুন দশককে মানুষ স্বাগত জানায়। বিদায়ী বছরের পাওয়া-না পাওয়া, আনন্দ-বেদনা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসেবভূমিতেই রচিত হয় নতুন স্বপ্ন-আশা ধারনে নতুন বছরের পথচলা। অসীমের পানে মহাকালের যাত্রায় একেকটি বছর আসে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে, নতুন প্রেরণা নিয়ে। সেই প্রেরণা নিয়েই শুরু হয়েছিল বিদায়ী বছরটি। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা করেছে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির সম্মিলন ঘটাতে। যদিও প্রত্যাশার শতভাগ পূরণ হয়নি, তবুও নানা হিসেব-নিকেশের মাধ্যমে অপূরণকৃত স্বপ্নের পরিপূরণ ঘটানোর নব-উদ্যমে প্রাণের উচ্ছ্বাসে বরণ করা হবে নতুন বছরকে, নতুন দশককে। ‘যাক পুরাতন স্মৃতি/যাক ভুলে যাওয়া গীতি,/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।’

বিদায়ী দশকে সুখকর ঘটনায় পুলকিত হওয়ার চেয়ে বিশ্বজুড়ে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়েছে বেশি। বিদায়ী দশকে বিশ্বজুড়ে প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়েছে একটি শব্দ ‘পপুলিজম’ বা লোকরঞ্জনবাদ। পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল ইত্যাদি সংকীর্ণ পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষের বিভক্তি আগের চেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব সংকীর্ণ পরিচয়কে পুঁজি করে যাঁরা রাজনীতিতে নেমেছেন, বিদায়ী দশকে বিভিন্ন দেশে তাঁদের সাফল্য লক্ষ করা গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত (ব্রেক্সিট), যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া এবং ভারতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার কর্তৃক এনআরসি প্রণয়ন ও নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন প্রভৃতি এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতি ও সাফল্যের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। বিদায়ী দশকে বিশ্বময় ইসলাম, খ্রিস্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের লেবাসে উগ্রবাদী তৎপরতাও ছিল উদ্বেগকর। উগ্রবাদীরা কোনো কোনো দেশে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছে। তথ্যফাঁসের বেশ কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ‘পানামা পেপারস’। উইকিলিকস যেমন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি ফাঁস করে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল, তেমনি পানামা পেপারস চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। আমরা জানতে পারি, ধনীরা কীভাবে কর ফাঁকি দেন। বিদায়ী দশক জুড়েই ছিল বিশ্বব্যাপী আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলা। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সরকারি বাহিনী ব্যাপক অত্যাচার, নির্যাতন শুরু করলে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রাণভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এখন ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে বসবাস করছে। এই মানবিক বিপর্যয় আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত। রোহিঙ্গা জেনোসাইডের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখন আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে বিচার চলছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রকাশ্যে ও গোপনে এ ধরনের জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলছে। এসব ঘটনা নিশ্চয়ই একটি সৌহার্দ্যময় বিশ্ব গড়ার অন্তরায়। বিদায়ী দশকে ম্যালেরিয়া জীবাণুর বিপজ্জনক সংস্করণ সুপার ম্যালেরিয়ার বিস্তারেও নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় গোটা বিশ্বে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন নিঃসরন কমানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের অঙ্গীকারও বাস্তবায়ন করেনি ধনী দেশগুলো। সর্বশেষ ২-১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনও (কপ২৫) কোনো যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে শিলোপন্নোত দেশগুলোর একগুয়েমির কারণে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পৃথিবীতে মানব-অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বেশি সময় লাগবে না। আইএস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াসহ বিদায়ী দশকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে দুয়েকটা আশাবাদী সংবাদ থাকলেও বাকি সবটাই ছিল হতাশার।

বিদায়ী দশকে বাংলাদেশের অর্জন ছিল আশা জাগানিয়া। বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংক নি¤œমধ্য আয়ের দেশ ঘোষণা করেছে। সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে ভিশন ২০২১। এর মাধ্যমে দেশ পুরোপুরি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ নানাক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিষ্ময়কর সাফল্য পেয়েছে। সারাবিশ্বেই বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মর্যাদাপূর্ণ আসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দারিদ্র্যমুক্তির সাফল্য দেখতে বিশ্বব্যাংকপ্রধানও বাংলাদেশ সফর করেছেন। মুগ্ধ হয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখে। বেশ কয়েকজনের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। কয়েকজনের মৃত্যুদ-ও কার্যকর করা হয়েছে। এতে জাতি হিসেবে সারাবিশ্বে যেমন আমাদের মর্যাদা বেড়েছে, তেমনি শহীদ পরিবারগুলো স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়েছে। কিছুটা হলেও মোছন হয়েছে জাতির গ্লানি। সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মহাকাশে বাংলাদেশ নিজস্ব স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। ভারত-মিয়ানমারের সাথে শান্তিপূর্ণ ফায়সালা হয়েছে সমুদ্রসীমার। ভারতের সাথে সম্পাদিত হয়েছে সীমান্তচুক্তি। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে দীর্ঘ ৬৮ বছরের বঞ্চনার ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে অবনতির চিত্র লক্ষণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত মানবসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। সে লক্ষ্য আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। দুর্নীতি, দলীয়করণ, আমলাতোষণ, স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানা অপকা- এখন পূর্বাপেক্ষা বেড়েছে। জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই মতৈক্য। সংকোচিত হয়ে গেছে গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রগুলোও। নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও হাস্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। এসব দেশ ও জনগণের জন্যে কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। বিদায়ী দশকে এসবের চর্চা দেখে দেশবাসী হতাশ হয়েছে।

এ চিত্রের অবসানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক ঐক্য দরকার। দরকার সবার মধ্যে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার ধারন, লালন ও পরিপূর্ণ চর্চা। প্রয়োজন পরিপূর্ণ সুশাসন। আমরা উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত পথ চাই। বিগত দিনের ব্যর্থতা, হতাশা আর বঞ্চনার অবসান চাই। চাই না ধ্বংস, হানাহানি সংঘাত আর মৃত্যুর অসুস্থ রাজনীতি। আমরা আর পেছনে ফেলে আসা দুঃখ-কষ্ট ও বেদনার কথা মনে করতে চাই না। বিদায়ী দশকের এই ক্ষণে আমরা আশা করতে চাই, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন বছরে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। আশা করবো, হিংসা ও বিদ্বেষের পথ পরিহার করে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং মানবসাম্যের পথে দেশ ও বিশ্ব এগিয়ে যাবে। একুশ শতকের তৃতীয় দশক সুসংবাদ বয়ে আনুক সবার জন্য।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট