চট্টগ্রাম রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

থামছে না মৃত্যুর মিছিল সড়কদুর্ঘটনা কি অপ্রতিরোধ্যই থাকবে?

৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৩:০২ পূর্বাহ্ণ

নিরাপদ সড়কের জন্যে আন্দোলন-সংগ্রাম যেন অরণ্যরোদনে পরিণত হচ্ছে। সড়কদুর্ঘটনা থামছেই না। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়কদুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। এমন কোনো দিন নেই যে, সংবাদমাধ্যমে কোনো সড়কদুর্ঘটনায় হতাহতের খবর থাকে না। বাংলাদেশে সড়কনৈরাজ্য কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা আরেকবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সীতাকু-ের ফৌজদারহাট বাংলাবাজার এলাকায় সংঘটিত মর্মান্তিক এক সড়কদুর্ঘটনা। গত শনিবারের মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন দু’জন। পরে হাসপাতালে মারা গেছেন এক জন। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন দু’জন। এ দুর্ঘটনায় তছনছ হয়ে গেছে একটি সুন্দর সাজানো পরিবার। একইদিন দেশের অন্যান্য স্থানেও আরো কয়েকটি দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সড়কে এরকম প্রাণহানি মর্মান্তিক, অনাকাক্সিক্ষত।
দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সাইফুজ্জামান খান মিন্টু ছেলেমেয়ের পরীক্ষা শেষে কয়েকদিনের ছুটিতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বান্দরবান। প্রকৃতির রূপ দেখে-দেখে সেখানেই কাটান কয়েকদিন। কিন্তু বেড়ানো শেষে নিজের প্রাইভেট কারে চড়ে ঘরে ফেরার পথে শনিবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকু- থানাধীন ফৌজদারহাট বাইপাস মোড়ে মিন্টুর ঢাকামুখী প্রাইভেট কারটির সাথে চট্টগ্রামমুখী কনটেইনারবাহী একটি লরির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় বাবা ও দুই মেয়ে তিনজনই মারা যান। গুরুতর আহত স্ত্রী-ছেলেও সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালের শয্যায়। একটি সাজানো সুখের সংসার যেন নিমিষেই তছনছ।েেবড়ানোর আনন্দ শেষ না হতেই বিষাদের কালো মেঘ যেন গ্রাস করেছে পুরো পরিবারকে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, লরিটি একই সময় অপর একটি কারকেও ধাক্কা দেয়। তবে ঐ কারের কেউ মারা যায়নি। দুর্ঘটনার ধরন দেখে ধারণা করা হচ্ছে, লরিটির গতি ছিল বেপরোয়া অথবা চালকের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। প্রসঙ্গত, দেশে প্রতিদিন যতো দুর্ঘটনা ঘটছে, তার বেশির ভাগের মূল কারণ বেপরোয়া গতি এবং চালকের স্বেচ্ছাচারিতা।

বেশিরভাগ চালকই সংযত হয়ে নিয়ম অনুযায়ী যান চালান না। ফলে দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে উঠে। আর চালকের স্বেচ্ছাচারিতার প্রধান বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। যাত্রী কিংবা পথচারী। সারাবছরই এভাবে সড়কদুর্ঘটনায় একের পর এক প্রাণ ঝরছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে এতো আন্দোলন-সংগ্রামের পরও কেনো এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু এড়ানো যাচ্ছে না, কেনো থামানো যাচ্ছে না বেপরোয়া চালকদের, তা বোধগম্য নয়।

বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে সড়কদুর্ঘটনায় এক দশকে যত মানুষ মারা যায়, বড় বড় যুদ্ধেও এত মানুষ মারা যায়নি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়কে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ২১ হাজার প্রাণহানি ঘটছে। গত এক দশকে সড়কদুর্ঘটনায় বাংলাদেশে লক্ষাধিক মানুষ মারা গেছে। বাংলাদেশ সড়কযাত্রা এখন অনেকের কাছেই মৃত্যুযাত্রার শামিল। প্রতিদিনই বেপরোয়া ড্রাইভিং এবং চালকের গাফিলতি ও অদক্ষতার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এআরআই’র তথ্যানুযায়ী, ৫৩ শতাংশ সড়কদুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত গতি, ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে বেপরোয়া চলাচলের কারণে। কিন্তু আইনের কঠোর প্রয়োগ না হওয়ার কারণে এর প্রতিকার হচ্ছে না। দায়ীদের শাস্তির নজিরও তেমন নেই। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত বছরের আগস্টে আন্দোলনে নেমেছিল। তাদের আন্দোলনের মুখে সরকার সড়কপরিবহন আইন পাস করে, যাতে দুর্ঘটনায় শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। সড়কদুর্ঘটনা রোধে এবং সড়কপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে অ্যাকশন প্ল্যানও আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আইন, নির্দেশনা কোনো কিছুরই সঠিক বাস্তবায়ন নেই। ফলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল পিছু ছাড়ছে না। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গত ১০ বছরের মধ্যে সড়কে দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে চলতি বছর। কিন্তু এভাবে দেশের সড়ক পরিবহনব্যবস্থা চলতে পারে না।

আমরা মনে করি, এ বিষয়ে আর নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। সরকারের উচিত এমন আয়োজন নিশ্চিত করা যাতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দুটিই কমে আসে এবং পর্যায়ক্রমে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্যে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণসমূহের দিকে নজর দিতে হবে। ইচ্ছাকৃত অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে অত্যাধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার। বিভিন্ন দেশে ভিডিও ফুটেজ দেখে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ ও শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশেও তা অনুসরণ করা উচিত। মনে রাখা দরকার, ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করতে হলে নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, দুর্ঘটনার পর জরুরি সেবার মানোন্নয়নের বিকল্প নাই।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট