চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪

নিভৃতচারী সমাজসেবক বজল মিয়া

মুহাম্মদ মনির হুসাইন

৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৫৯ পূর্বাহ্ণ

জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর, ¯্রষ্টার সৃষ্টিকে সেবা করতে পারলেই ঈশ্বরকে সেবা করা হয়… এমন ব্রত নিয়েই চট্টগ্রামের বাংলাবাজার ঘাটস্থ নিবাসী প্রয়াত শিল্পপতি বজল আহমদ সওদাগর তাঁর জীবদ্দশায় মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে গেছেন। তাঁর পুরোনাম বজল আহমদ হলেও তিনি স্থানীয়ভাবে বেশিরভাগ পরিচিত ছিলেন বজল মিয়া নামে। বজল মিয়া একাধারে ছিলেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সাধারণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক নিভৃতচারী মানবতার এক মহিরূহ হিসেবে।

বিশিষ্ট এ ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক ১৯২৩ সনে কর্ণফুলীর তীরবর্তী গোসাইল ডাঙা সংলগ্ন বাংলাবাজারস্থ স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। বজল মিয়া ছিলেন একজন সম্পূর্ণ স্ব-প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর পিতা তমিজ গুলাল এবং মাতা আফিয়ান্নেছা নিতান্তই সাধারণ দরিদ্র মানুষ। পুত্রের ভাগ্যোন্নয়নে অর্থ বিত্ত দিয়ে সহায়তা করতে পারেননি। কিন্তু যে দার্শনিক উপদেশ দিয়ে উৎসাহিত করেছিলেন তা সর্বকালের জন্য প্রনিধান যোগ্য। তিনি পুত্রকে এই বলে উপদেশ দিতেন, “হে পুত্র মনে সব সময় হযরত আলীর (রা.) মত বল বা শক্তি, হযরত ওমর (রা.) এর মত বুদ্ধি বা বিদ্যা ধারণ কর। অর্থ বিত্তের (টাকা পয়সা) অপচয় বা অপব্যবহার করো না বা কখনো পুঁিজ হাতছাড়া করো না।” পিতার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন বজল মিয়া। পিতার এই উপদেশ বজল মিয়াকে পেঁছে দিয়েছিলো সফলতার এক অনন্য পর্বতে।

ছোট একটি ‘চা’ দোকান নিয়ে কোনমতে, জীবিকা নির্বাহকারী মৌলভি তমিজগুলাল ইন্তেকাল করলে খুব কম বয়সেই বজল আহমদকে স্কুল ছাড়তে হয় এবং এক পর্যায়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে পিতা তমিজ গুলালের চা দোকানের হাল ধরে এবং তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ব্যবসা শুরু করেন। কুন্ডুবাজার (বর্তমানে বাংলা বাজার) এলাকায় বজল মিয়ার চা’র দোকান হয়ে উঠে খুবই নামকরা একটি দোকান। দোকানের সুনাম ও সেবার কারণে মাস্টারদা সূর্য সেন, বিনোদ বিহারী ও তৎকালীন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাই আড্ডা জমাতেন বজল মিয়ার দোকানে। বেশ কিছুদিন নিজ মেধাবলে চা দোকান পরিচালনা করে কিছুটা পুঁজি সংগ্রহ করেন এবং তার ব্যবসাকে আরো বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। এরপর সেই সামান্য জমানো পুঁজি নিয়েই তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের মহেশখালী হতে পান, কুতুবদিয়া হতে লবণ এনে আড়ত করে রাখা শুরু করেন। এরপর কমিশন এর ভিত্তিতে ব্যবসায় শুরু করেন। এভাবে ধারাবাহিকভাবে ব্যবসা করার পর এখান থেকে তিনি বেশ কিছু অর্থ লাভ করেন এবং মোটামুটি আকারের পুঁজি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। এভাবে তিনি আরও কিছুদিন ব্যবসা করার পর বিপুল অর্থ সঞ্চয় করেন । মূলত এখান থেকেই বজল আহমদের অর্থনৈতিকভাবে উত্থান শুরু। পর্যায়ক্রমে তিনি রাইস মিল ও সল্ট মিল প্রতিষ্ঠা করেন। সিলেট থেকে ধান সংগ্রহ এবং কুতুবদিয়া থেকে কাঁচা লবণ সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে সেগুলো বাজারে ছাড়তেন। এভাবে পিতার দেওয়া ছোট একটি চা দোকান থেকে শুরু করে বজল আহমদ গড়ে তুলেছিলেন চাল কল, আটা ময়দার কল, কাঠ চেড়াই কল, খুচরা ও পাইকারী বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা। তিনি তার দক্ষতা, সুনাম ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এমনভাবেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যার দরুন সমসাময়িক অন্য ব্যবসায়ীরা তার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে উঠতে পারছিলো না। ক্রমাগত ব্যবসায়িক ঈর্ষণীয় সাফল্যের কারণে এভাবে তিনি হয়ে উঠেন সমাজের একজন বিত্তশালী ব্যক্তি।

তারই ধারাবাহিকতায় নাসিরাবাদ শিল্প এলাকাতে প্রতিষ্ঠা করেন মোহাম্মদিয়া টিন এন্ড সিট মেটাল, বজল অয়েল মিল, মোহাম্মদিয়া টিন এন্ড সিট রিরোলিং ইন্ডাস্ট্রীসহ আরও বেশ কয়েকটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। আর এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয় শত শত মানুষের। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে তিনি পাকিস্তানের নামকরা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দাদা লিমিটেড, আদম লির্মিটেড, আয়ন লিমিটেডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে লবণ, চাল ও মরিচ ব্যবসা করেন। এভাবে সেই আমলেই তিনি শহরের অভিজাত বনিক শ্রেণীর কাতারে নিজের নাম লেখান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাবাজারে তিনি বৃহাদাকারে ওয়্যার হাউজ নির্মাণ করেন এবং এ হাউজটি ভাড়া দিয়ে অনেক অর্থ লাভ করেন তিনি।

ধণাঢ্য ব্যক্তি হয়েও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল কিন্তু দৃঢ়চেতা একজন মানুষ। অন্যায় অনাচার এর বিরুদ্ধে সোচ্চার এই মানুষটির আর একটি বিরল গুণ ছিল। তিনি ছিলেন একজন স্বভাব কবি এবং সুমধুর কন্ঠের অধিকারী বাউল ও কাউয়ালি গানের গায়ক। বজল আহমদ সম্পর্কে চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগ কর্তৃক প্রকাশিত “জননেতা জনাব আমীর হোসেন দোভাষ” স্মারক গ্রন্থে বিভিন্ন লেখকের লিখিত প্রবন্ধের উল্লেখ আছে। চট্টগ্রাম শহর জয় বাংলা বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা নূর মোহাম্মদ চৌধুরী তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেন “১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেওয়ার পূর্বে বাংলা বাজারে আমীর হোসেন দোভাষ এর বাস ভবনে আওয়ামীলীগের এক বিরাট কর্মীসভা হয়েছিল। সভাপতিত্ব করেছিলেন আমীর হোসেন দোভাষ। বজল মিয়া, বালির বাপ (নুরুল ইসলাম), আবুল খায়ের চৌধুরী ও আমীর হোসেন দোভাষের তৎপরতায় বাংলা বাজার তথা সাবেক পাকিস্তান বাজার তখন আওয়ামীলীগের এক শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। বজল মিয়া রাজনৈতিক গায়ক ছিলেন। সুন্দর বলিষ্ঠ গলা ছিল তার। ঘোড়ার গাড়িতে করে শহরের রাস্তায় আওয়ামীলীগের পক্ষে গান গেয়ে গেয়ে তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন।” (তথ্য: জননেতা আমীর হোসেন দোভাষ স্মারক গ্রন্থ, পৃষ্ঠা-৭২)। দোভাষ এর ছায়াসঙ্গী হিসেবে সব কাজেই সহযোগিতা করেছেন বজল মিয়া। একই গ্রন্থে প্রবীণ আওয়ামীলীগ নেতা ও চারণ কবি বদন দীদারি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বজল মিয়া লাল দিঘী ময়দানে আওয়ামীলীগের প্রথম জনসভায় স্বরচিত গান গেয়েছিলেন। পরে আসলেন পতেঙ্গার আলী মুন্সি আর সন্দীপের মোঃ শফি, আমি গান লিখতাম তারা গাইতো (পৃ: ৬৯)। বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক গাজী গোফরান এর লেখায়ও সত্যতা মিলে বজল মিয়ার গায়কী সত্তা ও রাজনৈতিক সত্তার। (তথ্য সূত্র: জ: আ: হো: দো: স্মা: গ্রন্ত্র, পৃষ্ঠা-৫৯) ।

বজল আহমদ এর সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল কৈশোরে। তাঁর বাবার ছোট চা দোকানে খুব গোপনে এসে মিটিং করতেন চট্টলার সিংহপুরুষ মাস্টার দা সূর্য সেন, অম্বিকার চক্রবর্ত্তী, অনন্ত সিংহ প্রমুখ বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব। সেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গের ছোঁয়া অবচেতন মনে দাগ কেটেছিল তাঁর জীবনে। সেই থেকে স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন তিনি। তিনি রাজনৈতিক জীবনে খুবই প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সে সময় রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে তার প্রভাব চট্টগ্রাম থেকে সুদূর কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। চট্টগ্রামে আওয়ামীলীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করতেন তিনি।

রাজনীতি আর ব্যবসা বাণিজ্যের মাঝেই নিজেকে সীমিত রাখেন নি বজল মিয়া। সমাজসেবা ও জনসাধারণের কল্যাণেও তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন অকৃত্রিম ও অকৃপণভাবে। মানুষকে সেবা করার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন সন্তুষ্টি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি অত্যন্ত ধার্মিক হলেও ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তার ধারক বাহক, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তান শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময়ে তিনি হিন্দু ও অমুসলিম সম্প্রদায়কে ক্ষতির মুখ হতে রক্ষাকল্পে প্রায়ইশ গভীর রাতে পাহারা দিতেন। তাঁর রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগত প্রভাবের কারণে তিনি পাহারা দেওয়ার সময়ে কেউ কখনো হিন্দুদের বাড়িতে হামলা করার সাহস পেত না। এভাবে অনেক নিদ্রাহীন রজনী পার করেছেন বজল মিয়া। তাঁর এসকল গুনাবলির কারণে তিনি হিন্দু-মুসলিম ও সকল ধর্মের সম্প্রদায়ের নিকট ছিলেন একজন আস্থাভাজন ব্যক্তিত্ব।

জনপ্রতিনিধি হিসেবে বজল মিয়া সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে সেবা করেছে। পঞ্চাশের দশকে প্রবল পরাক্রমশালী মুসলীমলীগ নেতা ধনকুবের আবদুল জলিল এবং বাদশা মিয়া সওদাগর এর বিপরীতে প্রতিদ্বন্ধিতা করে ১৭২০ ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়ে ছিলেন, মাদার বাড়ি থেকে গোসাইল ডাঙ্গা নিয়ে গঠিত বৃহাদাকারের এক ওয়ার্ডের কমিশনার। নিরংহকারী এই ব্যক্তিত্ব কখনো মানুষকে সেবা করার বিনিময়ে কোন কিছু আশা করেন নি, নিজের সন্তুষ্টি হতেই যতটুকু পেরেছেন মানুষকে সেবা করে গেছেন। হয়তো এই নীতিই তাঁকে জনসাধারণের নিকট অমর করে রাখতে সহায়তা করেছেন। বজল আহমদ তার নিজ প্রচেষ্টায় সমসাময়িকে মাদ্রাসা, মক্তব, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ আরও অনেক জনকল্যাণমূলক কাজের সাথে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই জনদরদি ব্যক্তি ১৯৮৮ সনের ৫ ডিসেম্বর ইহকাল ত্যাগ করেন। তিনি পরলোক গমন করলেও তাঁর নিরংহকারী ও মানবহৈতষি মনোভাবের জন্য তিনি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে সাধারণ মানুষের মনে স্থান করে নিতে পেরেছেন এবং নিজ কর্মগুণে তিনি আজও বেঁচে আছেন কঠোর পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী ব্যক্তিত্বের এক প্রতীক হয়ে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট