চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মহানবীর (সা.) নবুয়তের প্রাথমিক জীবনে ইসলামের দাওয়াত

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

১৪ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:০৭ পূর্বাহ্ণ

বছর ঘুরে এলো পবিত্র মাহে রবিউল আউয়াল, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পয়দায়েশ কর্ম ও ওফাতের মাস। আমাদের সামনে ভেসে আসছে তাঁর জীবনের অনেক মহৎ কথা ও ত্যাগের স্মৃতি। ইসলামের সূচনাকালে কিছুদিন আঁ-হযরত (স.) নিজে একাকী নতুন ধর্মে বিশ্বাসী ও কর্মে ব্রতী থেকে পরে প্রচারকার্যে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু সারাদেশে ছিল মূর্খতা ও গুমরাহীর রাজত্ব। দুর্ধর্ষ আরবীয়রা গর্ব, আত্নম্ভরিতা এবং পূর্বপুরুষদের রীতিনীতিকে আঁকড়ে থাকতে অভ্যস্ত ছিল। তাদের সম্মুখে এই সনাতন ধর্ম হঠাৎ প্রকাশ পেলে জনশত্রুর মত সবাই খড়গহস্ত হয়ে দাঁড়াবে না, সম্ভব হলে এই নবীন ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আশংকাও ছিল। শৈশবকালেই এর প্রতি মানুষ বিরূপ ভাবাপন্না ও ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লে ভবিষ্যতে তার বিশ্বজনীন সংগ্রাম সাফল্যমন্ডিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে কি?

তাই আল্লাহ প্রথম অবস্থায় স্বীয় মাহবুবকে প্রকাশ্য স্থানে প্রচার করতে বলেন নি। আঁ-হযরত (স.) চুপি চুপি একান্ত বিশ্বস্ত লোকজনকে নতুন ধর্মের দিকে দাওয়াত দিতে লাগলেন। দাওয়াতের মূল বিষয় ছিল- সারা জাহানের মালিক আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, আমি তার প্রেরিত পুরুষ।’ এটাই ইসলামের মূলমন্ত্র-কালেমায়ে তাইয়্যেবা-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-।
নতুন ধর্মের সর্বপ্রথম দীক্ষা নিলেন হযরতের জীবন সঙ্গীনী ও মক্কার ধনাঢ়্য মহিলা হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রাদি.)। মুহাম্মদ (স.)-কে তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, পাহাড় টলতে পারে-কিন্তু তার স্মামী মিথ্যা বলতে পারেন না। সুদীর্ঘ জীবনে তিনি কোন দিন মিথ্যা বলেন নি; অন্যায়ও করেন নি।

হযরত আলী (রাদি.) ছিলেন মাত্র দশ বছর বয়স্ক বালক। বহুদিন যাবৎ হযরতের (স.) ঘরে পালিত হয়ে আসছিলেন। ভাইয়ের নিরাকারের উপাসনা ও নতুন ধর্মমতের বহু কিছু দেখে একদিন তিনি সাগ্রহে নিবেদন করলেন-ভাই: আমাকেও আপনার ধর্মমতে দীক্ষিত করে নিন। সুধী বন্ধুবর্গের মধ্যে সর্বপ্রথম আসলেন হযরত আবুবকর (রাদি.)। তিনি সমাজে একজন সম্মানী এবং প্রভাবশালী মাতবর ছিলেন। বাড়ীতে তার যথেষ্ট লোক সমাগম হত। এ সুযোগে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য লোকজনের মনে তিনি নতুন মতবাদের বীজ বপন করতে লাগলেন। হযরত ওসমান গণী, আবদুর রহমান ইবনে আ’উফ, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, যুবায়ের ইবনে আওয়াম, তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহ (রাদি.) প্রমূখ মান্যগণ্য ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণের মূলে ছিল আবুবকর (রাদি.)-এর প্রচেষ্টা।

ইসলামের প্রথম দিকে একদিন হযরত জিব্রাইল (আ.) সূরা ফাতিহা (আলহামদু লিল্লাহ) নিয়ে আসলেন এবং ডানার আঘাতে একস্থান থেকে পানি বের করলেন। সে পানিতে আঁ-হযরত (স.) ওজু শিক্ষা দিয়ে একসঙ্গে দুই রাকাত নামায আদায় করলেন। তখন হতে নব্য মুসলমানগণও ওজু করে গোপনে নামাজ পড়তে এবং অবতীর্ণ আয়াত সমূহ তিলাওয়াত করতে থাকেন।
ক্রমশ: দীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে চলল। কুরাইশ বংশের বিভিন্ন গোত্র হতে আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ, উবায়দা ইবনুল হারেস, সায়েদ ইবনে যায়েদ, আবু সালমা মখজুমী, খালেদা ইবনে সাঈদ, ওসমান ইবনে মযউন ও তদীয় দুই ভাই কুদামা ও ওবায়দুল্লাহ আকরাম ইবনে আকরাম (রাদি.) এবং আরো অনেকেই আঁ-হযরতের নতুন ধর্মে দীক্ষিত হলেন। প্রচারকার্য চলতে থাকে পুরোদমে। কোন বাহ্যিক কোন হইচই ছিল না বলে কুফর ও মুশরিক সর্দার বিষয়টিকে তেমন কোন গুরুত্ব না দিয়ে বরং উপেক্ষা করে চলতে থাকে। তারা মনে করল, পানির বুদবুদের মত উঠেছে আবার আপনা-আপনি মিশে যাবে। কিন্তু প্রচার ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ যখন ক্রমশ: জোরদার হয়ে উঠল এবং আঁ-হযরতের অনুগত শিষ্য সংখ্যা বেড়ে চলল, তখন তাদের ভুল ভাঙ্গল। সঙ্গে সঙ্গে অন্তরে শত্রুতার আগুণ জ্বলে উঠল।

হযরত আবু বকর (রাদি.) একদিন মার খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়েন। এমনকি মারের চোটে তার নাক-মুখ ফুলে একাকার হয়ে যায়। সে দৃশ্য দেখে আঁ-হযরত (স.) ও অশ্রু সংবরণ করতে পারেন নি। আঁ-হযরত (স.) শিষ্যদের শিক্ষার জন্য সাফা পাহাড়ের পাদদেশে আরকামের বাড়ীতে একটি ঘর নির্দিষ্ট করলেন। সেখানে গোপন বৈঠক এবং ধর্ম শিক্ষা দেয়ার কাজ চলতে লাগল।
সে সময় অনুগত সাহাবা (রাদি.) গণের সংখ্যা দাঁড়াল ত্রিশ জন। অথচ নামাজ পড়ার কোন নির্দিষ্ট স্থান না থাকায় যে যেখানে সুযোগ পেতেন নামাজ আদায় করে নিতেন। মহল্লা বা গ্রামবাসি দূরে থাক এমনকি নিজ পরিবারের লোকজন জানতে পারলেও মহাবিপদ ছিল। ভাইয়ের চোখের আড়ালে ভাই নামায পড়তেন। পিতা নামায পড়লে পুত্র জানত না। পুত্র নামায পড়েন পিতার খবর নেই। তাই কোন সময় জামায়াতে নামায পড়ার ইচ্ছা হলে কিংবা সুযোগের অভাব ঘটলে সাহাবাগণ পাহাড়ের কোথাও গিরী-গহবরে নামায পড়তেন।
আঁ-হযরত (স.)একদিন আলী (রাদি.) কে নিয়ে নামায পড়তে কোন একটি টিলার উপরে যান। আবু তালিব খবর পেয়ে তাদের পিছনে পিছনে গিয়ে দুই ভাইকে নামায পড়তে দেখে ফেললেন। বাড়ি ফিরার পথে পুত্রকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, একি দেখলাম আলী? হযরত আলী (রাদি.) দ্বিধাহীন কন্ঠে বলে ফেললেন নামায।

আবু তালিব: নামায কি? হযরত আলী-ইসলামের মূল ইবাদত।

আবু তালিব: ইসলাম আবার কি? হযরত আলী (রাদি.) ভাই মুহাম্মদ (স.)-এর প্রচারিত সনাতন ধর্ম।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি পিতাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে, এই ধর্মই খঁিটি এবং আমি এই ধর্মে দীক্ষিত হয়েছি।’ কথাগুলো আবু তালিবের খুব ভাল লাগল না। কিন্তু মুহাম্মদ (স.)- এর উপর তার প্রগাঢ় বিশ্বাস ও আস্থা ছিল। তাই শুধু এই বলে চলে গেলেন যে, মুহাম্মদ তোমাকে বিপথে চালিত করবে না……..।
তিনটি বছর এভাবেই কেটে গেলো সত্য একদিন না একদিন ফুটে উঠবেই। সত্যের জয় যে অবধারিত তিনটি বছরে এটাই প্রমাণিত হয়ে গেল। এর ফলে সাহাবাগণের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ত্রিশের উপর।

মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট